Skip to main content

প্রবাহ - ৩৩/২


অনুবাদ সাহিত্যের সম্ভার নিয়ে প্রকাশিত

সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রবাহ’


প্রকাশিত হলো গবেষণাধর্মী, সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রবাহ’। প্রচ্ছদে লিখা আছে যদিও - ‘লিটল ম্যাগাজিন’ অর্থাৎ ছোট পত্রিকা, কিন্তু একটি আড়াইশো পৃষ্ঠার পত্রিকা কী করে লিটল হয় , কিংবা লিটল বা ছোট হতে পারে কি না সে আলোচনার দায় বোদ্ধাদের জন্য তুলে রাখা হলো। 

বর্ষ ৩৩, সংখ্যা দুই। অর্থাৎ ‘প্রবাহ’ এখন যথেষ্ট পরিণত। এবং একের পর এক সংখ্যায় সেই ছাপটুকু চূড়ান্ত পেশাদারিত্বে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন বহু যুদ্ধের ঘোড়া -  সম্পাদক আশিসরঞ্জন নাথ। হাইলাকান্দি জেলার ক্ষুদ্র শহর লালাবাজারের মতো জায়গায় থেকে একের পর এক অসাধ্য সাধন করে চলেছেন এই অক্লান্ত সাহিত্যিক তথা সফল সম্পাদক। 

এবারের সংখ্যার বিষয় - অনুবাদ সাহিত্য। অনুবাদ অর্থাৎ Translation বা Transmission. মানুষ আজীবন তো এই অনুবাদের মাধ্যমেই তার যাবতীয় বোধকে আহরণ করে চলেছে। মায়ের মুখের ভাষাকে নিজের ভাবনায় অনুবাদ করেই তো শুরু পথ চলা। সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য ধারা এই অনুবাদ সাহিত্যকে নিয়ে ‘প্রবাহ’-এর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। অনুবাদ নিয়ে ৪টি প্রবন্ধ এবং ২১টি অনুবাদ গল্প, একগুচ্ছ অনুবাদ কবিতার বাইরেও পাঠকদের জন্য ফাউ হিসেবে রয়েছে ৬টি গল্প নিয়ে ‘গল্প ক্রোড়পত্র’। এক কথায় বিশাল আয়োজন। ছোটপত্রিকার সম্পাদনা মনে হয় এই সম্পাদকের কাছে জলভাত। নাহলে বিষয় ভিত্তিক সূচিপত্রের বাইরে আবার ক্রোড়পত্র যুক্ত করে আড়াইশো পৃষ্ঠার ওজনদার পরিবেশনার সাহস ক’জন সম্পাদক দেখাতে সাহস করেন - তাও আবার বছরে দু’বার - সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকতেই পারে। 

ছিমছাম প্রচ্ছদ এঁকেছেন অজিত দাশ (বাংলাদেশ)। পরিপাটি এবং প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয়তে সম্পাদক অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি পাঠক মনে একটা অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলার প্রয়াস করেছেন। ‘পাঁচিল ভাঙায় অনুবাদ - প্রেক্ষিতে আসামের অসমিয়া ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক দীপেন্দু দাশ খুবই পরিকল্পিত ভাবে এবং অবশ্যই অত্যন্ত সঠিক দিশায় আলোচনা করলেন এ রাজ্যের দুই মূল ভাষার অনুবাদ সাহিত্যের অআকখ। পাশাপাশি পাঠকবর্গকে অনুবাদ সাহিত্য পঠনের ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধও করলেন নিঃসন্দেহে। অনুবাদ কী, অনুবাদ সাহিত্যই বা কী - এসব নিয়ে চুলচেরা আলোচনা লিপিবদ্ধ হলো অঞ্জলি সেনগপ্তের ‘অনুবাদ সাহিত্য তত্ত্ব এবং - - -‘ প্রবন্ধে। সম্পাদক আশিসরঞ্জন নাথ এক ফাঁকে সেরে নিয়েছেন তাঁর দায়িত্ব। প্রবন্ধ ‘বরাক উপত্যকার অনুবাদ সাহিত্য’ ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল হয়ে থাকবে বলেই বিশ্বাস। চূড়ান্ত অধ্যবসায়ে তুলে এনেছেন অদ্যাবধি এ উপত্যকার অনুবাদ সাহিত্যের খুঁটিনাটি। মিশনারি তথা কাছাড়ি রাজাদের আমলের সাহিত্য থেকে শুরু করে একেবারে হাল আমলের সম্পূর্ণ অনুবাদ সাহিত্যের ইতিহাস জলের মতোই স্বচ্ছ লেখনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন সম্পাদক। এই প্রবন্ধে একটি নাম সম্ভবত অজানিতেই বাদ পড়ে গেছে। অধ্যাপক সুশান্ত কর কর্মসূত্রে উজান আসামের বাসিন্দা হলেও মূলতঃ তিনি বরাক উপত্যকারই বাসিন্দা। তাঁর একাধিক অনুবাদকৃতি এক কথায় অনস্বীকার্য। সম্পাদক অবশ্য প্রবন্ধের শেষে এরকম অনিচ্ছাকৃত বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাটি নিজেই ব্যক্ত করেছেন। বিকাশ রায়ের প্রবন্ধ ‘বিদ্যাসাগরের অনুবাদ চর্চা’ নিঃসন্দেহে তথ্যবহুল এবং নবীন পাঠকদের জন্য এক অতি আবশ্যকীয় পঠনবিষয়। অনুবাদ যে আক্ষরিক না হয়ে প্রায়োগিক হওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই কথাটি বিদ্যাসাগরের অনুবাদ চর্চার স্বরূপ উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। একাধারে চারটি প্রবন্ধই অতি মূল্যবান এবং ইতিহাস স্বরূপ সাহিত্যকৃতি। 

অনুদিত গল্পের সম্ভারও নেহাত কম নয়। বিভিন্ন লেখক ও গল্পকারদের কলম থেকে অনুদিত হয়েছে অসমিয়া, কার্বি, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, বোড়ো, চাকমা, মগ, খাসি, পঞ্জাবি, গুজরাটি, ইংরেজি, হিন্দি, ডোগরী, ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার গল্পের বাইরেও লিবিয়া, মিশর ও জার্মানির গল্প। অনুবাদের মুন্সিয়ানায় মন কেড়েছেন বাসুদেব দাস, জয়রাজ সিংহ, রাখি পুরকায়স্থ, রিমা দাস। এছাড়াও অনুবাদ গল্প লিখেছেন বরুণ কুমার সাহা, সুশান্ত কর, তপন মহন্ত, এল বীরমঙ্গল সিংহ, সুশীলকুমার সিংহ, উল্কা মণ্ডল (বাড়ৈ), পদ্মকুমারী চাকমা, ক্রইরী মগ চৌধুরী, অনিতা দাস ট্যাণ্ডন, অভিজিৎ লাহিড়ী, কল্লোল চৌধুরী, রণবীর পুরকায়স্থ, শম্পা রায়, শ্যামল ভট্টাচার্য, রুখসানা কাজল, মাজহার জীবন এবং গৌরাঙ্গ হালদার। প্রতিটি গল্পের শেষে মূল গল্পকারদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও সাহিত্যচর্চার যেভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ঠিক তার পাশাপাশি অনুবাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি থাকলে আরোও ভালো লাগত নিঃসন্দেহে। এক গুচ্ছ কবিতার অনুবাদ করেছেন অভিজিৎ লাহিড়ী, সুবোধ বাগচী, রবীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, প্রদীপকান্তি রায়, এস গম্ভিনী, সন্তোষ সিংহ এবং জাভেদ হুসেন। 

গল্প ক্রোড়পত্রে আছে মোট ছয়টি গল্প। উল্লেখযোগ্য বিজয়া দেব ও মেঘদূত সেন-এর গল্প। এর বাইরেও গল্প লিখেছেন বরুণকুমার সাহা, শর্মিলা দেব কানুনগো, সুব্রতা মজুমদার ও ফাল্গুনী চক্রবর্তী। 

এত বিশাল সাহিত্য সম্ভারের আয়োজনে সম্পাদকের ভূমিকার আবারও উল্লেখ করতে হয় এর জন্য যে মোট আড়াইশো পৃষ্ঠার এই পত্রিকায় খুঁজে পেতে আড়াইখানা ভুল বানানও হয়তো পাওয়া যাবে না। শেষ পাতায় স্মরণ করা হয়েছে কিংবদন্তি অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রাসঙ্গিক এবং যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি। এক কথায় এবারও আক্ষরিক অর্থেই এ অঞ্চলের ভাষা সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হয়ে রইল ‘প্রবাহ’।


- - - - - - - - - - -

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। 


Comments

  1. খুবই সুন্দর আলোচনা ,পড়ে ভালো লাগলো।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়