Skip to main content

‘মধুবর্ষী প্রলয়ের খোঁজে’ - কবিতায় স্বপ্নপূরণের দায়

 

দুহাতে জড়িয়ে ঘনমেঘ, এক সূর্য তাপস
বেদমন্ত্রের স্বরলালিত্যের জড়তা কাটাতে
আড়মোড়া ভাঙে, আর সাবলীল জোছনার
হাসির ফাঁকেই অমোঘ শান্তি দৌত্য
পথ চলার ক্লেশে ধারণ করে জড়তীর বেশ
 
তখন এক সবুজ গাছ
বর্ণমালার ক্রমাগত ঋজু আলাপে
জর্জরিত হতে হতে ক্রমশ
বিদগ্ধতার হোমবহ্নি জাগিয়ে তোলে
 
তন্দ্রাতুর উদোম অনাবাদি পৌষের মেঘ অবশেষে
কোটরগত চোখের এক প্রাচীন বটের
মানসপুত্র হয়ে জন্মায়
(কবিতা - সূর্য তাপস)
 

সম্প্রতি হাতে এলো ডঃ শান্তনু রায়চৌধুরির প্রথম কাব্য সংকলন - ‘মধুবর্ষী প্রলয়ের খোঁজে প্রকাশক - পূর্বকল্প এবং ভিকি পাবলিশার্স, গুয়াহাটি ৮৬ পৃষ্ঠার ছিমছাম কাব্য সংকলনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ৪০টি কবিতা অর্থাৎ সহজ অংকে চার-সারিতে দায় সারেননি কবি মনের ভাবকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করেছেন বিস্তৃত পরিসরে স্বপ্নপূরণের দায় মেটাতে দায়সারা ভাবনাকে ঠাঁই দেননি মোটেও

একের পর এক কবিতায় কাব্যসুষমা যেন সযতনে লেপন করে দিয়েছেন কবিতার শরীরে অথচ অসাধারণ নৈপুণ্যে নিজের সোজাসাপোটা বক্তব্যকেও সটান ব্যক্ত করেছেন অবলীলায় কবিতা যে কবির ধ্যান ও ধারণার মানসসঞ্জাত সৃষ্টি তা যেন কবিতার পরতে পরতে উপলব্ধি করা যায় শ্রী রায়চৌধুরির কবিতার রসাস্বাদনেনিজের কথায় সেই কথাটিই লিখেছেন কবি - ‘মধুবর্ষী প্রলয়ের খোঁজেকবিতা সংকলনের কবিতাগুলোর অধিকাংশই এক মন্থনজাত প্রক্রিয়ার ফসল

একাধিক কবিতায় ব্যঞ্জনার অসাধারণ প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় - অথচ কোথাও জটিলতার আবহে বিভ্রান্ত হতে দেননি পাঠককে সহজ সরল পরিবেশনায় বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন পাঠকের দরবারে - অথচ প্রতিটি কবিতার প্রতিটি স্তবকে ভাষা ও জ্ঞানসঞ্জাত উপলব্ধিকে কবিতার আঙ্গিকে উপস্থাপন করে নিজের জাত চিনিয়ে দিতে পেরেছেন অনায়াসে এক দিকে যেমন কল্পনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন অশুভের বিরুদ্ধে শুভ বার্তা অন্য দিকে তেমনি বর্তমান সময়ের অন্ধত্ব, বধিরতাকে সরাসরি বক্তব্যে করেছেন অনাবৃত

অধ্যাপনাসঞ্জাত প্রজ্ঞায় কিছু কবিতার শরীরে অনবদ্য স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করেছেন প্রাচীন চর্যাপদের শব্দাবলি ও পদসমূহ কবিতা যেন হয়ে উঠেছে ছন্দসুষমামণ্ডিত

ঈশ্বরবাবু নামের এক অলীক ভদ্রলোকের কাছে
অবশেষে নতজানু হয়ে সান্ত্বনা চাইতেই
দেখা গেল বাঁ পাশে
আম-জাম-হিজলের ছায়াঘেরা এক সুরম্য পান্থনিবাস -
দরজায় তার তথতা প্রহরী,
আর দরজার ওপর
নিয়নবাতির আলোয় ঝলমল
ছয় ফুট বাই তিন ফুটের সাইনবোর্ড -
নিয়ডি বোহি মা জাহু রে লাঙ্ক
(কবিতা - অমরাবতীর উপাখ্যান)

ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির অবক্ষয় ভাবিয়ে তোলে কবিকে তাই কিছু সহজ কথায় ঝরে পড়ে তীব্র প্রতিবাদ, কিছু কাব্যিক আকুতির হাত ধরে ভেসে আসে যন্ত্রণার আভাস

রবীন্দ্র জলসার ভরা আসরে
কেবলই নাচ গান আর হাসিখেলা
পণ্ডিতি কথকতা তো আসলে
বায়ুভরা রঙচঙে সব কথার ফানুস !
মনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ
কান পেতে কি কোথাও শুনতে পারা যায় ?
একা একা নীরবে গুমরে কাঁদে রবীন্দ্রবাণী
(কবিতা - প্রজ্ঞাবাহকেরা ইদানীং)

অবশেষে কবিরই কথায় ফুটে ওঠে আশার ভবিষ্যৎ -

হায় দুঃখিনী বর্ণমালা !
ততোধিক দুঃখিনী সংখ্যামালা !
 
এদিকে বর্ণমালাকে দুঃখিনী বলতেই
ধেয়ে এলেন ইতিহাস-পুরুষ -
তাঁর এক পায়ে অতীত জড়িয়ে,
অন্য পায়ে ভবিষ্যত
দেহে অনেক ক্ষত, চড়াই-উৎরাই
তাঁর এক হাতে আলাওলেরপদ্মাবতী’,
আরেক হাতে মনোয়েল দ্য আসসুম্পসাঁউ
খুব হাসলেন তিনি,
প্রাণখোলা সেই হাসির দমকে
অনেক কৌতুক কথা আর অনেক রহস্যের সমাবেশ
তাঁর সে হাসি দিগন্ত থেকে দিগন্ত ছুঁয়ে
ছড়িয়ে পড়ল এপার বাংলা, ওপার বাংলা, ঈশান বাংলা,
এমনকি সাত সমুদ্দুর পারের অনেক ভুবনে
 
তাঁর সেই দিগন্ত ছোঁয়া হাসি মিলিয়ে যেতেই
পিতৃ-পুরুষের বুড়ো প্রপিতামহের দেহে জেগে ওঠে
বাংলার নদী-খেত-মাঠ আর আলো ভরা প্রাণ
 
এইসব ভালোবেসে একদল লোক
নিজেরাই নেয় বহনের ভার
গেয়ে ওঠে গলা ছেড়ে গান -
মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা
(কবিতা - ভাষা দিবসের কবিতা)

বিষয় বৈচিত্রে যেমন ভরপুর হয়ে আছে গোটা সংকলন তেমনি প্রায় প্রতিটি কবিতার মুন্সিয়ানাময় নামাকরণেও যেন এক যাদুস্পর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন কবি সেই - ‘নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে’ - ধরণের শিরোনামেই বাজিমাত হয়েছে অনেক কবিতা তেমনই কিছু চমৎকার কবিতার চমৎকার শিরোনাম - এষণার কাহন কড়ি, চিত্রগুপ্ত ফুটেজ, ঋতুবদলের কিছু কথা, স্বপ্নপূরণের দায়, তৎসবিতুর্বরেণ্যম, প্রবাদকল্প, খেজুর্গময়, জল-মহোৎসব, সপ্তপদীর ফন্দি-ফিকির ইত্যাদি

কবির ভাবনায় বাদ যায়নি আত্মপরিচয়ের বিড়ম্বনার শোকগাথা, বাদ যায়নি নাগরিক জীবনের স্বার্থসর্বস্ব পরিচিতির গোপন কথাও যদিও সংকলনের শেষের দিকের কিছু কবিতা প্রথমাংশের কবিতার মায়াময়তার আবেশ ছেড়ে হয়ে উঠেছে কঠোর বাস্তবতায় ঘেরাবন্দি তথাপি ব্যাহত হয়নি কবির অনায়াসসাধ্য সহজপটুতা এভাবেই মায়াময় ব্যঞ্জনা আর কল্পনাসঞ্জাত মধুবর্ষী আলাপচারিতার শেষে নিরস বাস্তবতায় ফেরত যাত্রা ঘটে পাঠকের

স্বর্গের নিষ্কর ভূমিরাজস্বে কোনো আস্থা না রেখে
যাপিত জীবনের দিকে তাকিয়ে অপাঙ্গে
কোনোদিনেও যারা তোলেনি প্রশ্ন ভ্রুভঙ্গে
শাদা ক্যানভাসে তারাই শুধু
আনমনে আর অগোচরে
ব্রাশ টেনে অগোছালো ফুটিয়ে তোলে
বিমূর্ততার মায়া।
 
কোনো এক সরল বিশ্বাসে, আমিও অমৃতপ্রভা,
খুঁজে ফিরি কি মধুবর্ষী এক প্রলয়ের সন্ধান ?
 
‘মধুবর্ষী প্রলয়ের খোঁজে’
প্রচ্ছদ - নয়নজ্যোতি শর্মা
অক্ষর বিন্যাস - ভিকি কম্যুনিকেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।
মূল্য - ১০০ টাকা।
যোগাযোগ - ৯১০১৪১৩২১১
shantanuroychowdhury9@gmail.com
- - - - - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...