Skip to main content

‘অস্ফুটে দ্রোহ’ - কবিতায় একরাশ অনুচ্চারিত প্রতিবাদ


আদিমা মজুমদার মূলতঃ গল্পকার উত্তর-পূর্বের অবিসংবাদিত সফল গল্পকার অথচ কবিতায়ও যে একজন গল্পকার এতটা স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল তা শিরোনামে উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থটি না পড়লে বোঝা-ই যেত না পড়তে পড়তে বারে বারে অনুভূত হয় সেই আপ্তবাক্য - যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।
‘অস্ফুটে দ্রোহ’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে - সাইমা পাব্লিকেশনের প্রকাশনায়। গল্পকার থেকে কবি হওয়ার পথে যে ভাবনাটি সব চাইতে বেশি কাজ করেছে তা হলো গল্পের দীর্ঘ বর্ণনে যে কথাটি বলতে গেলে পোড়াতে হয় বহু কাঠখড় সেই চিন্তাটিই কবিতার মাধ্যমে স্বল্প কথায় উচ্চারণ করা যায় কম আয়াসে। এবং সেই সূত্রে আদিমা মজুমদারের কবি হয়ে ওঠাটি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল খুব। কারণ কথার পাহাড়, প্রতিবাদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা জমে জমে যেন পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছিল সময়ের সাথে সাথে। সমাজের তথাকথিত নিয়মাবলির ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্যায়, অবিচার আর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তাই কলম ধরতেই হতো এই প্রতিবাদী সত্ত্বাটিকে। সেই কাজটিই স্পষ্ট আর সরল ভাষায় সেরেছেন কবি। কোনও রাখঢাক না রেখেই উন্মোচিত করেছেন ভেতরের অনুচ্চারিত ব্যথাকেপাঠকের দরবারে সরাসরি পৌঁছে দিয়েছেন সত্যের স্বরূপ। বিদ্রুপে, শ্লেষে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছেন সামাজিক আর ধর্মীয় অনুশাসনের মিথ্যে পর্দাকে। সাহসী শব্দোচ্চারণে নিজেকেও করেছেন ঋদ্ধ, উন্মুক্ত।
৯৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ৬৪টি কবিতা এবং বেশ কিছু ছড়া। কবিতাগুলো কতটুকু কবিতা হয়েছে সে খেয়াল পাঠকের থাকে না। কবিতার মাধুর্যের চাইতে এখানে কবিতার বক্তব্যই ধারে ও ভারে প্রকট। অথচ কবিতার অনর্নিহিত ছন্দেও ব্যাঘাত ঘটেনি কখনো। ব্যাকরণগত ছন্দ হয়তো এখানে অনুপস্থিত কিন্তু সহজ পঠনের পথে কথার চাবুকের শব্দ নিরলস ধ্বনিত হয় পাঠকের শ্রবণেন্দ্রিয়তে। একের পর এক কবিতায় শুধু খোলস ভাঙার আয়োজন। একটি কথাও উচ্চারিত হয়নি কাউকে রেয়াত করে।
বিষয় বৈচিত্রে খামতি নেই মোটেও একটি কাব্যগ্রন্থে কবি নিজেকে মেলে ধরেছেন আদ্যন্ত কী নাই এখানে ? কবিতায় কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের পরিচয় থেকে নিজের জীবিকাগত জীবনের সুখ দুঃখের খতিয়ান দিয়েছেন প্রেম ভালোবাসা থেকে শুরু করে মৃত্যুর মতো করাল অনুভবের ফিরিস্তি
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর সোজাসপটা প্রতিবাদ অধিকাংশ কবিতারই মূল বক্তব্য এই বিষয়টি নিয়েই
কবি লিখছেন -
দুলাভাই পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন
- - - - - - - - -
সেদিন পত্রিকায় দেখি
আমার দুলাভাইমোস্ট ওয়ান্টেড
সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম অভিযুক্ত
হায় খোদা
কেলেঙ্কারির জন্য
নামাজ পড়তে হয় বুঝি ?  
(কবিতা - কেলেঙ্কারি)
এমনি এমনি আরোও অসংখ্যবার তীব্র শ্লেষে কবি বিদ্ধ করেছেন অন্যায়কে উল্লেখযোগ্য - ‘স্বাধীনতা হীনতার উপাখ্যান’, ‘সর্বংসহা মা’, ‘দেহদান’, ‘বাবনের জন্মদিনে’, ‘আতঙ্ক’, ‘মেন্স’, ‘আবার আসিব ফিরে’, ‘এবং প্রতিস্রোত’, ‘চল্লিশ লক্ষ’, ‘বিস্বকাপ’, ‘নারী’, ‘বাবরি’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘আমার জন্মদিনইত্যাদি
আছেআমি দুর্গা’, ‘বইমেলাগোছের কিছু ব্যতিক্রমী চিন্তাধারারও কবিতা আছে নস্টালজিয়া - ‘আমাদের গ্রাম’, ‘প্রিয় গ্রাম’, ‘নস্টালজিয়াকবিতায় আছে কিছু মনস্তাত্ত্বিক উচ্চারুণ -
পুরুষটা সবার সামনে বলে দিল
তালাক - তালাক - তালাক
আসলে সে বোঝেইনি
মেয়েটি তাকে মনে মনে তালাক দিয়েছে
আরও অনেক আগে - - -
(কবিতা - তালাক)
কিংবা -
তুমি সাত আসমানের উপর কী করো ?
আমার ছেঁড়া কাঁথার তলে একবার এসো
- - - - - - -
ঈশ্বর তোমার অপেক্ষা আর অপেক্ষা
(কবিতা - ঈস্বর)
কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন -পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানে বিনা পারিশ্রমিকে আজীবন খেটে অ্যামনেশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে হেলে পড়া তাঁর মায়ের মতো হাজারো নারীদের কুহেলি দেবরায়-এর প্রচ্ছদ এবং ভেতরের স্কেচগুলো গ্রন্থটির আলংকারিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি কিন্তু প্রচ্ছদের নামলিপিতে চালু ফন্টই অধিক মানানসই হয় সাধারণত গ্রন্থে বানান ভুল প্রায় নেই বললেই চলে তবে সূচিপত্রে অনেকগুলো ভুল পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখে খানিকটা ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক পঠনের গরিমা
আদিমা যে কথাটি লিখেছেন ভূমিকায় - “আমি চাই বাংলা কবিতা ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে, চর্চা জারিত থাক ভাষা বাঁচুক” - সেই কথাটিই উঠে এসেছে তাঁর একাধিক কবিতায়ও
শেষপাতে মোট ২৩টি ছড়ায় ঋদ্ধ হয়েছে কাব্যগ্রন্থ এখানেও আছে বৈচিত্র আছে আফসোস, আছে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াস প্রথম ছড়া -
এসো ডোবা জল ভরে - করে ছল ছল
বর্ষায় বুক ভরা মনসা মঙ্গল
ডিটেনশন ক্যাম্প পুরো ষোল আনা
মৃত্যুর মিছিল আর বেহুলা যন্ত্রণা
শেষ ছড়া -
গদ্যের সাথে আড়ি দিয়ে
পদ্য নিয়ে খেলো
অক্ষাংশ আর বিষুব রেখা
ঠিক করে চলো
গল্পকার আদিমার গদ্যের সাথে আড়ি যেন কবিতায়ই লিখা থাকে বাস্তবে নয় এতকিছুর পরেও তাই বলতেই হয় আজকের দিনে শারীরিক ভাবে অসুস্থ কবি, গল্পকার আদিমা - পাঠকের জন্য বেঁচে থাকুন দীর্ঘকাল অসুস্থতা হোক ক্ষণস্থায়ী, অন্যায় - অবিচারের বিরুদ্ধে গদ্যে পদ্যে কলম চলুক দীর্ঘস্থায়ী অনুচ্চারিত অস্ফুটের আওতা থেকে বেরিয়ে দ্রোহ হোক সরব, সোচ্চার
 
অস্ফুটে দ্রোহ
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২৭২৩৪৯৬
- - - - - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

  1. এ আমার পরম প্রাপ্তি। তোমার কলমে ফুলচন্দন পড়ুক।ভালো থেকো।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়