Skip to main content

অপরাজিতা


মন খারাপ করা এক হৈমন্তী সকালে আনমনে বারান্দার বাইরে তাকিয়ে আছে অপরাজিতা ভোরের শিশিরের আস্তরণ খসে যেতেই উঠোনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা অতসীগুলো প্রথম সূর্যের আলো গায়ে মেখে নিজেদের পাপড়িগুলো মেলে ধরছে আপন গরিমায় শিশিরবিন্দু মাখা জালগুলো গুটিয়ে নিচ্ছে দুষ্টু মাকড়সাগুলো কিছুই নজর এড়ায় না অপরাজিতার কামিনীর গন্ধে ম ম করছে সারা বাড়ি উঠোন জুড়ে কাল রাতের ধান মাড়াইয়ের পর ধানী গন্ধে ছেয়েছিল চরাচর রাতে কামিনী তার সৌরভ ছড়িয়ে আচ্ছা জব্দ করেছে ধানের গন্ধকে সব মিলিয়ে এক নতুন আবেশ যেন ছেয়ে থাকে বাড়িটার আনাচে কানাচে ওপাশের শিউলিও রোজ রাতে ফুল ঝরায় এখনো রূপ আর সৌরভের যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে এখন চলবে বহুদিন সেই শেষ চৈত্র ইস্তক দেখে অপরাজিতা - তারিয়ে তারিয়ে আর ভাবে যতই তোরা জারিজুরি দেখাস না কেন কে আর তোদের দিকে ফিরে তাকায় ? এ বাড়ির আদি বাসিন্দা হয়েও তোরা একাই থাকিস অথচ এই আমাকে দেখ উদ্বাস্তু হয়ে এসেও আমি কেমন আদরে যত্নে রসেবশে থাকি অবশ্য তোদের সাথে আমার তো আর তুলনা চলে না প্রাণে প্রাণেও ফারাক থাকে তোরা থাকিস বাইরে পড়ে আর আমি মালিকের খাস মহলে
মাঝবয়েসী অপরাজিতার এমনি কত ভাবনাজালে আবদ্ধ কথার ফোড়ন মুখ ফুটে না হলেও বুক ফুটে তো বটেই
দেখছে, ভাবছে বটে কিন্তু মন ভালো নেই অপরাজিতার থাকার কথাও নয় মন খারাপ হয়ে আছে আজ অনেক দিন থেকেই সেই যেদিন ওম অর্থাৎ এই ঘরের মালিক ; মালিক না ছাই, রোজ কথায় হারে কবিতার কাছে - সেই ওমপ্রকাশ, যে কি না এসব সাতে পাঁচে থাকেই না সে-ই কিনা কবিতাকে ডেকে নিয়ে এলো বারান্দায় - থুড়ি বারান্দার এই এক চিলতে ঘুপচি ঘরটায়
কী হয়েছে ?’ - আগ্রহে প্রশ্ন করে কবিতা
চুপিচুপি ফিসফিসিয়ে বলে ওম - দ্যাখো, দ্যাখো তোমার পিয়ারি অপরাজিতার কাণ্ড কেমন বাড় বেড়েছে দেখো, বলে তর্জনীর ইশারায় দেখিয়ে দেয় কেমন মাথা উঁচু করে জানালার উপরের ভেন্টিলেটর দিয়ে ভেতরে উঁকি মারছে অপরাজিতা উঁকি মারাই যায় অনায়াসে জানালাটা একেবারেই নিচু, তাই মাথার সমান উচ্চতায় ভেন্টিলেটর তা বলে এভাবে - - - - -
এতটা ভাবেনি কবিতাও। সত্যি বাড় বেড়েছে অপরাজিতার। এসব কী অসভ্যতা ?
ওম এবার ইঙ্গিত করে অপরাজিতার পায়ের দিকে - ‘কেমন নোংরা হয়ে থাকে দ্যাখো। এসব কী হয়েছে ? কোনও চর্মরোগ কিছু বাঁধিয়ে বসেছে কি ? কত বার বলেছি তোমাকে কবিতা, এভাবে হাবিজাবি এনে ঠাঁই দিও না এখানে। না, তুমি শুনবে কেন ?’ - বলে গজগজ করে ফিরে আসে ঘরের ভেতর। কবিতার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছিল না কথা বাড়ানোর। তাই চুপ করে গেল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কবিতা বুঝে গেল সব, কিংবা হেরে গেল ওমের কাছে। এই মুহূর্তে সত্যি সত্যি ভীষণ রাগ উঠে আছে অপরাজিতার উপর। কত করে বুঝায়, কত যত্নআত্তি করে তবু তার কি কোনও হেলদোল আছে ? রাগে গজগজ করতে থাকে কবিতা। মুখে কিছু না বলে সোজা ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা পর্দা টাঙানোর লাঠিটা নিয়ে এসে ঠেলা মেরে ভেন্টিলেটরটি বন্ধ করে দেয়এমন কিছু উঁচু নয় ভেন্টিলেটর, ইচ্ছে করলেই হাত দিয়ে এ কাজটা সারতে পারতো কবিতা। কিন্তু ইচ্ছে করেই অপরাজিতাকে লাঠিটা দেখিয়ে এমনটা করলো। নিজের অপকর্মে লজ্জিত অপরাজিতা যেন কুঁকড়ে গেল ব্যথায় বন্ধ হতে থাকা ভেন্টিলেটরের ধাক্কায় আঘাতও পেল খানিকটা। মনে হচ্ছে মাথার দিকটায় ছড়েও গেছে কিছু। অপরাজিতার একলা একা জীবনের ব্যথা বুঝে কবিতাও। কিন্তু বুঝে কী হবে, বলে তো কিছু শোনানো যাবে না। সেই এ ঘরে আসা ইস্তক মূক হয়েই আছে অপরাজিতা। অপরাজিতা বস্তুতঃ জন্মাবধিই মূক। কিন্তু সব দেখতে পায়, বুঝেও সব। আর বুঝবে নাই বা কেন ? বয়সও তো আর কম হলো না। সেই কত ছোট থাকতেই তো একা একা কবিতার হাত ধরে চলে আসা এ বাড়ি। ঘরের কাজকর্মের জন্য কিংবা সাজসজ্জার জন্য কবিতার কোনও হেল্পারের দরকার নেই। তাই আগেই বলে দিয়েছে ‘বাইরেটা দেখবি অপরাজিতা। ঘরে ঢুকবি না।‘ সব মনে আছে অপরাজিতার। কিন্তু আজ যতটা না মাথায় ব্যথা পেল তার চাইতে ওমের কথায় হয়তো অন্তরের ব্যথাটাই বড় হয়ে উঠলো। তার মানে অপরাজিতা হাবিজাবি ? অথচ এমন তো ছিল না দিন। যেদিন হাতে হাত ধরে কত মমতায় অপরাজিতাকে এখানে নিয়ে এসেছিল কবিতা। তবে নিয়ে না এলে কী হতো তা ভাবলেও শিউরে ওঠে অপরাজিতা। সেদিন কবিতা যদি এখানে না নিয়ে আসতো তাহলে জীবন রক্ষার আর কোনও পথই হয়তো খোলা থাকতো না। মায়ের করুণ মুখখানি আজো স্পষ্ট ভাসে চোখের সামনে। যাযাবর জীবন থিতু হয় না কোথাও।
মায়ের অনুভব নিজের অনুভবের সাথে একাকার করে দিয়েছিল অপরাজিতা। সেই বয়সেই। উদ্বাস্তুর ডাইরিটা খুব ভালোই পড়েছিল সে। অজানা অচেনা ভবিষ্যতের পথে নিঃস্ব অবস্থায় চলে আসা। যুগ যুগ ধরে শুধু বাসা বদলের ইতিকথা। সব মনে আছে। স্থান থেকে স্থানান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। কারো না কারো দয়ার পাত্রী হয়ে জীবন যাপনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা শুধু। বিনিময়ে নিজের যা আছে তা সবটুকু উজাড় করে দেওয়া। তবু সবাই কি আর এদের মতো উদার হয় ? এই যেমন কবিতার কথা। অন্তরটি বড্ড মোলায়েম কবিতার। অপরাজিতাকে বলতে গেলে নিজের হাতেই বড় করে তুলেছে কবিতা। স্বজনহারা অপরাজিতাকে নিজের ঘরের বারান্দার একটুকু জায়গায় এক পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিয়ে জীবনটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বৈকি। নিজেই যত্নআত্তি করে বড় করে তুলেছে পরম মমতায়। তবু মানুষের মন তো। তাই কখনো রাগও করে কবিতা। তাতে এতটুকু দুঃখ পায় না অপরাজিতা। বরং কী করে কবিতার মন জয় করা যায় সেই ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে অপরাজিতারও। সেই বোধটুকু থাকতে হবে তো তাদেরও। যদিও প্রথম অবস্থায় অপরাজিতাকে অভিজাত ঘরের বলে ভুল বুঝেছিল কবিতা। পরে ভুল ভাঙতে মুষড়ে পড়েছিল যদিও দুর দুর ছ্যা ছ্যা করে তাড়িয়ে তো দেয়নি। বরং এতদিনে এক মায়ার বন্ধনে যে জড়িয়ে গেছে কবিতার অন্তরে সে কথাটি খুব ভালোই জানে অপরাজিতা।
আগে যেখানে ছিল অপরাজিতারা সেই জায়গাটি এখান থেকে অনেকটাই দূর। ছোট হলেও স্পষ্ট মনে আছে। মায়ের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে এমনি একচিলতে একটুকু জায়গায় ভালোই ছিল ওরা। বাবার কথা কিছু বলতে পারবে না অপরাজিতা। কিছুই মনে নেই আর। কখনো দেখেছে বলেও মনে পড়ে না। মা-ই তাকে আগলে রাখতো আপন ছায়ায়সেই ঘরের মালিকও কিন্তু খুবই সজ্জন ছিলেন। তখনও বিয়ে থা হয়নি তাঁর। খুব ভালোবাসতেন অপরাজিতাদের। নিজের হাতে সযতনে এটা ওটা এনে দিতেন। খাওয়া দাওয়ার অভাব হতে দিতেন না। মা ছেলের সংসারে এক কোনায় মন্দ ছিল না অপরাজিতারা। কিন্তু এভাবে তো আর জীবন চলে না। তাই তার কথা ভেবেই সেই ঘরের মালিক মায়ের নীরব সম্মতিতে অপরাজিতাকে তুলে দিলেন কবিতার হাতে। ওনারা নাকি আত্মীয়। যদিও আত্মীয় কাকে বলে তা জানতো না অপরাজিতা কিন্তু এখন বুঝে এই শব্দটির মানে। এই যেমন কবিতা তো আত্মীয়ই বটে না হলে কোথা থেকে আসে এই মায়ার বন্ধন, এই আত্মার আত্মীয়তা ? সন্তানের সুখী ভবিষ্যতের আশায় মায়ের বুক ফাটলেও সম্মতি জানিয়েছেন নীরবে। অপরাজিতাও ছলছল হৃদয়ে শেষবারের মতো মায়ের মুখখানার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কবিতার সফরসঙ্গী হয়ে চলে এসেছিল এখানে।
আজ এতগুলো বছরে সব শিখেছে অপরাজিতা। এখন বয়স হয়েছে তারও। মাঝে মাঝেই মনে হয় মায়ের কথা। এতদিনে কি আর জীবিত আছে মা ? মনে হয় না। একটু যে খোঁজখবর নেবে তারও জো নেই। বিধাতা সব দিয়েছেন, দেননি শুধু জবান। কবিতা কত কথা বলে। সব শুনে যায় তাই নীরবে। ইশারায় কিছু বুঝিয়ে দিতে চায় কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না কবিতা। তাই সেই চেষ্টা আর এখন করে না অপরাজিতা। এই তো সেদিন সকাল হতেই জল আর খাবারদাবার নিয়ে এসে একেবারে হাঁটু গেড়ে সটান বসে পড়লো অপরাজিতার কাছে। বসেই শুরু কথা - ‘ইস। কত শুকিয়ে গেছিস রে। এত ব্যস্ত থাকতে হয় জানিসই তো। এখন সব সময় অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তোকে আর আগের মতো দেখতে আসতেও পারি না।‘
লজ্জা পেয়ে যায় অপরাজিতা। মনে মনে বলে -‘কত ভালো গো তুমি। তুমি যা করেছো তার সিকিভাগও কি আর ফিরিয়ে দিতে পেরেছি আমি ? কত সাধ করে অভিজাত ঘরের ভেবে এনেছিলে ঘরে। বড় হয়ে যখন আমার সেই না দেখা ধূসর সাদা রূপটি দেখতে পেলে তখন তো আর দূরে ছুঁড়ে ফেলে দাওনিলাই দিয়েছ আমাকে। নিজের মতো করে বড় হতে দিয়েছ। এ ঋন কি আর জীবন দিয়েও মেটানো যায় ?’
বুঝলো কিনা বুঝা গেল না। কিন্তু খানিক বাদেই উঠে গেল কবিতা - ‘না, যাই রে। আজ বেরোতে হবে একটু। ওমও ঘরে নেই। তুই পাহারা দিস ঘর। কেমন ?’ - বলে উঠে ঘরের ভেতর চলে গেল কবিতাদীর্ঘশ্বাস ফেলে অপরাজিতা ভাবে -‘আমার কি আর সে সাধ্যি আছে গো কবিতা দিদিমণি ?’
ওমকে বেশি পছন্দ নয় কবিতার। এমনিতে মানুষ হিসেবে বেশ ভালোই। কিন্তু কেমন যেন দায়সারা। এই যে কবিতা দিদিমণি সারাটি দিন ধরে এই ঘরের পেছনে খাটাখাটুনি করে থাকে, কই একদিনও একটি বারের জন্যও তো হাত লাগায় না কাজে। সারা দিন ধরে শুধু কীসব লিখতেই থাকে। না হলে নিজের কাজটুকু - এই যা। চান, খাওয়া, ঘুম আর কলমের সাথে কলমবাজি। পারেও বটে। একবার ফিরেও তাকায় না যেন কবিতার দিকেতাকালেও যেন দেখে না কিছুই। অন্যমনষ্ক হয়ে থাকে। অন্য কিছু ভাবে সব সময়। আজ কী যে হলো ? এমনিতে বারান্দায় এলেও ফিরে তাকায় না অপরাজিতার দিকে আজ একটু উঁকি মেরেছি ঘরের ভেতর অমনি এসে দেখে ফেললো। কপাল মন্দ হলে যা হয় আরকি। আর তার পরেই কী হম্বিতম্বি। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল আজ। এরকম না করলেই ভালো ছিল। মিছিমিছি কবিতা দিদিমণিরও চক্ষুশূল হতে হলো। ওমের বলা ‘হিজিবিজি’ শব্দটা অনবরত যেন দগদগে ক্ষতের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতরটা। আসলে এভাবে এর আগে কেউ এমন করে বলেনি তো, তাই। তবু যতটা সম্ভব নিজের মতোই থাকতে চেষ্টা করে অপরাজিতা। মনের দুঃখটা মনেই চেপে নিজের কাজটুকু করে যায় নীরবে। নিজে চেষ্টা করেও পায়ের দিকের ত্বকে সৃষ্টি হওয়া ফাঙ্গাস জাতীয় অসুখের দাগ সারাতে পারে না অপরাজিতাসত্যিই দেখতে বড্ড নোংরা লাগছে। আগে ছোটখাটো কিছু হলে কবিতাই নিজের হাতে যত্নে পরিচর্যায় সারিয়ে তুলতো তাকে। আজকাল বড় হয়ে গেছে অপরাজিতা - অনেকটাই আর সেও ব্যস্ত থাকে ভীষণ। চোখের সামনে অনেকটাই বড় হয়ে গেল কবিতাও। পুচকি মেয়েটা অবশ্য ভালোই বাসে অপরাজিতাকে। মায়ের মতো সেও মাঝে মাঝেই এসে তাকায়, কথা বলে তার সঙ্গে। এটা ওটা খাবারদাবারও এনে দেয় বটে। মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা। কী সুন্দর গান করে। রাতে নিজে বাজনা বাজিয়ে যখন গান করে তখন কান খাড়া করে শোনে অপরাজিতা। ভারি মিষ্টি আওয়াজ। আজকাল তো ওর গান না শুনলে যেন ঘুমই আসে না অপরাজিতার। অথচ সন্ধে হলেই ঘুম এসে যেত আগেউঠোনের বাইরে কিংবা রাস্তার পাশের অন্য সব যারা অপরাজিতারই মতো উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে তারা সবাই কেমন ঘুমিয়ে থাকে আঁধার হলেই। যাঁদের নিজস্ব আস্তানা আছে তাঁরাও তো ঘুমিয়ে থাকে সাতসন্ধেতেই। আশপাশের গাছগাছালিগলোও সন্ধে হতেই ঘুমে কাতর ঘুমোতে দেরি হলেও অপরাজিতার ঘুম ভেঙে যায় একেবারেই ভোরবেলায়। শিউলি ঝরা রাতের শেষে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে চরাচর, পুচকিটা ঘুমেই থাকে তখন। কবিতা উঠে যায় খানিক বাদেই। অপরাজিতা বারান্দার বাইরে তাকিয়ে দেখে জাগ্রত ভোর। দেখে ঋতু বদলের দৃশ্য বাইরে তাকিয়ে তখন ইশারায় কথা বলে গাছগাছালি আর ফুলেদের সাথে, কথা বলে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিমূলের ডালে এসে বসা অগণিত পাখিদের সাথে অসম, অসমাপিকা কথায় ভরে ওঠে পরিবেশ কে যে কার কথা কতটা শুনে তা জানেন একমাত্র প্রকৃতি দেবতা তবু বলে অপরাজিতা অষ্ফুট কথাগুলো যেন ভেসে বেড়ায় পাখিদের, ফুলেদের কানে কানে চুপকথারা উড়ে বেড়ায় মায়াময় প্রকৃতি জুড়ে, বন থেকে বনান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে ভাগ্যিস ওম দেরি করে উঠে। নাহলে হয়তো এর জন্যও কটু কথা শুনতে হতো তাকে।
শুনতে হলো তবু। তবে শুধু কটু কথা নয়। একেবারে সাংঘাতিক ভয়ের ব্যাপার। কয়েকদিন পরের কথা। আবার সেদিন ওম এলো বারান্দায়। এমনিতে সচরাচর আসে না কিন্তু মাঝেমাঝে, কালেভদ্রে এসে দাঁড়ায় খানিকক্ষণ কিংবা বসে বাইরের দিকে তাকায়, আবার উঠে চলে যায় ভেতরে। সেদিন কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে এদিক ওদিক তাকাতে গিয়েই নজর পড়ল অপরাজিতার দিকে। বয়সের ভারে হতশ্রী অপরাজিতা যেন নিজের সাথে নিজেই লড়াই করে টিকে আছে কোনওক্রমে। ওমের কপালে কিছু কুঞ্চিত রেখার আভাস স্পষ্ট ফুটে উঠল যেন। উঠে চলে গেল বারান্দার সংলগ্ন লেখালেখির কোঠায়। খানিক বাদে সকালের জলখাবার নিয়ে কবিতা যখন এলো তার কাছে তখনই অপরাজিতা শুনতে পেল কথাটি। সচরাচর এ সময় ব্যস্ত থাকে দু’জনেই, কথাবার্তা বড় একটা হয় না অপরাজিতার কান খাড়া থাকে সব সময়। সে জানে কখন কে কী বলে। অবাক হয়ে তাই শুনছিল ওম আর কবিতার কথা।
- বহুদিন তো হলো। তোমাকে আগেও বলেছি। এবার অপরাজিতাকে বিদায় দাও কবিতা। কেমন নোংরা ছড়াচ্ছে দেখছো না ?
- আশ্চর্য। এভাবে ঝেড়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে ওম ? এতদিন ধরে ওর কাছ থেকে যতটুকু আমি পেয়েছি সব ভুলে উপড়ে ফেলবো তার ঠিকানা ? কোথায় যাবে ও ? মেরে ফেলতে তো পারি না। একা একা থাকে।
- তা বলে আমার ঘরের বারান্দাটিকে তো আর নোংরামিতে ভরিয়ে রাখা যায় না কবিতা। বোঝার চেষ্টা করো একটু। তাছাড়া এখন তো আর ও তোমার কোনও কাজেই লাগছে না। দেওয়ার মতো আর কিছুই তো নেই ওর। শুধু শুধু একটা আপদ বই আর কিছু তো নয়। মেরে ফেলা বা কেটে ফেলার কথা তো বলছি না। অন্তত অন্য কোথাও বিদেয় তো করাই যায়। যেমন করে পারে নিজের জীবনটা নিজেই বাঁচিয়ে রাখুক নাহয়।
কথা আর আগ না বাড়িয়ে চলে যায় কবিতা। ভয়ে বুক দুরুদুরু করে অপরাজিতার। এই বয়সে কী করে সে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভেবে পায় না। মনে পড়ে যায় একেবারে ছোট বেলায় দেখতো এক অন্ধ বুড়ি কীভাবে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে খাবারের সন্ধান করতো। আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ অপরাজিতার তো সেই এলেমটুকুও নেই। অন্ধবুড়ির তদারকিতে একটি মেয়ে ছিল, অপরাজিতার কে আছে ? এখন এভাবে ঘুরে বেড়ানো কি আর সম্ভব। তার অক্ষমতা সব জেনেও ওম কী করে বললো কথাটা ? ভয়ভীত অপরাজিত সন্ত্রস্ত হয়ে দিন গুজরান করে। মনে মনে মৃত্যু কামনা করে ঈশ্বরের কাছে। সন্তান সন্ততি কিছুই নেই তার। কে তাকে দেখবে ? মায়ের কথা মনে পড়ে আবার। মায়েরও হয়তো একই দশা হয়েছে সেখানে। সন্তান থেকেও তো নেই মায়ের। কিন্তু কামনা করলেই তো আর ঈশ্বর এসে সব কামনা পূর্ণ করে দেন না তাঁর আছে অন্য হিসেব সে হিসেব অপার্থিব
পরদিন সকাল হতেই কবিতা এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। অপরাজিতা সচকিত হয়ে ঊঠে। কবিতার হাতের ছুরিটার দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে অপরাজিতা। মৃত্যু কামনা করলেও হঠাৎ করে মৃত্যু এসে যখন হানা দেয় দুয়ারে তখন এভাবেই শিউরে ওঠে প্রাণ। মায়াময়ী কবিতা কি শেষে এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে ?
, কবিতা এত নিষ্ঠুর নয় অপরাজিতার গায়ে এতটুকু আঁচড় ফেলে না কিন্তু হাতের ছুরিটা দিয়ে ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে অপরাজিতার ঘর। পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে অপরাজিতার। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে প্রাণভিক্ষা জানায় কবিতার কাছে। শেষের ডাক শুনতে পায় অপরাজিতা তিলে তিলে মৃত্যুর সুর শুনতে পায় যেন ইচ্ছে হয় শেষবারের মতো পুচকির গলায় শুনে নেয় সেই গানটি। খুব দরদ দিয়ে গাইত পুচকি - আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ - - - । বলতে পারে না কিছুই আজন্ম মূক অপরাজিতা। প্রতিরোধের কোন ইচ্ছেই জাগে না প্রাণে দেখে - কবিতার চোখ সিক্ত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। পার্থিব চাহিদার কাছে হার মেনেছে কবিতা। আজ পরাজিত হয়, সিক্ত হয় অপরাজিতাও। এবার ধীরে ধীরে অবচেতনে শেষ উপহারটি দিয়ে যেতে চায় কবিতাকে।
কাজ শেষ করে কবিতা এবার শেষবারের মতো তাকায় অপরাজিতার পূর্ণ অবয়বের দিকে। প্রায় নিস্তেজ, ঝরে পড়া পাতার মতো ক্ষীণ, জীর্ণ অপরাজিতার গায়ে শেষবারের মতো ফুটে ওঠে আরোও একটি ধূসর সাদা ফুল। দু’চোখ জুড়ে জলধারা গড়িয়ে পড়ে কবিতার। ফুল এনে ভগবানের আসনে নিবেদন করে অস্ফুটে বলে ওঠে - ঠাকুর, অপরাজিতাকে তুমি অক্ষয় করে দাও।
- - - - - - - - -

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়