Skip to main content

'মাটির পৃথিবী' বই-এর আলোচনা - ৩



২০২১ এর শেষ পর্বে হাতে পেলাম উপহার হিসেবে ‘মাটির পৃথিবী’। বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যাক্তিত্ব, সুলেখক, কবি, গল্পকার,গ্রন্থ সমালোচক এবং এক আন্তরিক শিল্পকর্মী শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্তী মহাশয়ের কাব্য পুস্তিকা। একশত কবিতার সমাহার সেখানে।
কবিতাগুলিকে তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। বিভিন্ন এবং বিচিত্র সব প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে কবিতা সকল। প্রকৃতির নিবিড় রূপ , মানবহৃদয়ের রহস্যময়তা, আশা নিরাশার দোলাচল সব কিছু নিয়েই কবি রয়েছেন কবিতার পাশে। করছেন ঘর –সংসার, কবিতার সঙ্গেই। সচেতন পার্থিব যন্ত্রনার পাশেই অপার্থিব অমিয়ের হাতছানি প্রতিনিয়ত অনুভব করেন বলেই তিনি নির্বিকার ভাবে লিখে যেতে পারেন জীবনের পদাবলী। তার ‘’প্রথম কবিতা’’র অন্তিম পংক্তি ‘’…আমি কবির পায়ের পথ মাড়ানো ধুলো হব’’ বলে দিয়ে যায় কবি ও কবিতার প্রতি মগ্ন ভালোবাসার কথা।
শব্দের জটিলতায় বিশ্বাসী নন কবি। সহজ সরল শব্দ চয়নে ছুঁয়ে যেতে চেয়েছেন কবিতার অবয়ব।
‘’সরল ও পাইনের সরলরেখায়
সেই যে শুরু শব্দের মায়াজাল-
সেই তো প্রোথিত মূল
এই তো আমার প্রেম ।“
সন্নিষ্ঠ প্রেমও সরলই হয়। প্রত্যাশাবিহীন, জটিলতামুক্ত, আনন্দময়।নিজেকে নিংড়ে দেওয়া, বিলিয়ে দেওয়া। শ্রাবণের ধারার মতো নিজেকে ঝরিয়ে দেওয়া সকল ক্ষতের বেদনার্ত উষ্ণতায়।
‘’…আবার আসে ফিরে অনন্ত প্রতীক্ষা বেলা
আবার কবে মন যমুনায় উঠবে লহর,
পড়বে ঝরে ভালোবাসার গোপন কথা যত
এমনি আরেক আষাঢ় শেষের-
শ্রাবণ ধারার মতো।‘’
কবি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী নিশ্চিতভাবেই বর্তমান সময়ের কবি। বাক রীতিতে বা শব্দচয়নে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাচীনপিয়াসী হলেও তার কবিতার স্বর কিন্তু আধুনিক ও নাগরিক।সমসাময়িক শহুরে সভ্যতার নানা টানাপড়েন, পরিস্থিতির অসহায়তা, বিবর্ণ অসুখাক্রান্ত সময় বারেবারেই তার কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।ফেলে আসা রামধনু রঙের দিনগুলি কবির অনুভবী মনকে বেদনার্ত করে তোলে বাস্তবের অভিঘাতে
“কোথায় যেন হারিয়ে গেল রামধনুর ওই সাতটি রঙ
বসতবাটী একই আছে মন জানালায় ধরছে জং।
যাচ্ছিল দিন হেসে খেলে মিথ্যে কথার ফুলঝুরি
তাই শিখেছি তাই বুঝেছি বুঝিনি তা বুজরুকি।…”
কবি নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করেছেন সৃষ্টি, সভ্যতা ও ইতিহাসের নিদারুণ সত্য। তাঁর বলিষ্ঠ কলম তাই বলে ওঠে
“ মাটি ও মানুষ এভাবেই রিক্ত হয়,
বিধ্বস্ত ঐতিহ্যের আর্তনাদ
প্রকট হয় অবৈধ লালসায়-
ঠুলি পরা নীললোহিতের
উন্মত্ত খেয়োখেয়িময় চাতুর্যে।“
জীবন ও বেঁচে থাকার সংকট মানুষের সামাজিক অবস্থানে কত সুকঠিন আঘাত হানতে পারে, নিরীহ মানুষ হয়ে পড়ে কঠিন পরিস্থিতির শিকার, সেই নির্মম বাস্তব প্রকাশ পেয়েছে “নতুন মোনালিসা” কবিতাটিতে।
এভাবেই প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত। শব্দসারি ইঙ্গিত দিয়ে গেছে স্বপ্নিল ভবিষ্যতের।আর সেই স্বপ্নময় দিগন্ত দিনের শেষে মায়াবী আলো নিয়ে মিশে গেছে দূরের কোনো মাটির পৃথিবীতেই। যে মাটি আমাদের চেনা হয়েও অচেনা। যে মাটিকে ঋদ্ধ করে অগণিত সৎ সম্ভাবনার বীজ। শুধু জেনে নিতে হবে কৃষিকাজ। তবেই আগামীর সোনালী ফসলে উপছে পড়বে মাটির পৃথিবীর খামারবাড়ি।
কবিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
কবিতাপুস্তিকা ঃ মাটির পৃথিবী
কবি ঃ বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক ঃ ভিকি পাব্লিশার্স, গুয়াহাটি

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়