Skip to main content

'কবিতার বারান্দায় প্রথম পড়েছে আলো' - গোপাল চক্রবর্তী



প্রথম কবিতা সত্যিকার অর্থেই আমার প্রথম কবিতা, এখানে কোন ভেজাল নেই আর যেহেতু প্রথম কবিতা তাই এই বই আমার কাছে এক এক্সপেরিমেন্ট - আমি কী লিখি, সে উত্তরের আশায় এক পাঠক আরেক পাঠকের চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকবে অনেকদিন কবিতা আসলে কী ? আমিই বা কী লিখলাম ? কবিতার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আমি এখনো পাইনি খুঁজে, হয়তো কোনদিনই পাব না লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো তবু একটা ধারণা টের পেয়েছি কোথাও গহীনে - কবিতা এমন কিছু শব্দ বন্ধন, পড়তে পড়তে এক ক্রাইসিসের জন্ম দেয় ভিতরে, বেজে ওঠে পড়তে পড়তে শেষ হয়ে যাওয়ার আফসোস কবিতা সহজ মানুষের মতো সহজেই দুলিয়ে যাবে মানুষের মন, তাই কঠিন শব্দ ব্যঞ্জনার পিছনে ছুটে যাওয়া বৃথাই মনে হয়েছে আমার আপাতত এটাই আমার কাছে কবিতা …… এই বই এর নব্বই শতাংশই প্রেমের কবিতা, এইপ্রেমশব্দের সাথে জড়িয়ে আছে বিরহ, প্রেমে সুখের কবিতা এখানে খুবই কম, কবিতা যেহেতু যাপন আশ্রয় তাই কবিতাযাপনে অন্য মানুষের উপস্থিতি গৌণ নির্জনে কবিতা বেড়ে ওঠে কবিতা লিখার কোন কারণ নেই, সে আসে, ধরা দেয় নির্জনে, আবার হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় বলেই কবি ধরে রাখার চেষ্টা করেন, শব্দে আটকে রাখেন তারে - যেন ঘোর বিবাগী কোন প্রেমিকা যে চলে যাবে, যেন অভিমানী, তাই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় প্রেম প্রকাশিত হয়েই যায় কবিতায় এই প্রেম জীবনপ্রেম, এই প্রেম মানবপ্রেম, সর্বোপরি প্রকৃতি প্রেম ……”
ভূমিকায়নিজের কথাশিরোনামে এভাবেই নিজেকে এবং কবিতাকে বিশ্লেষণ করেছেন, ব্যক্ত করেছেন, কাটাছেঁড়া করেছেন এই মুহূর্তে এ অঞ্চলের সবচাইতে সাড়া জাগানো কবি গোপাল চক্রবর্তী তাঁর সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ - ‘কবিতার বারান্দায় প্রথম পড়েছে আলোতে এবং এই সূত্র ধরেই এগিয়েছে তাঁর একের পর এক কবিতা - বলা যায় কবিতায় কবিতাযাপন। অসাধারণ এক গদ্য কবিতা ‘অমানুষরা’তে কবি লিখছেন -
‘আমাদের জন্য কবিতা লিখেনি কেউ, আমরাই আমাদের নাম লিখে যাই পাতায় পাতায় ফুলে ফুলে, ধানের মুকুলে, ঘাসের দানায়, আমাদের নাম শুকায়ে যায়, দলিয়ে যায় পায়ে পায়ে, মিটে যায় মুছে যায় ধূলায় লুটায়, হাওয়ায় ওড়ায়’ - অথচ ‘কবিচরিত’ কবিতায় এই বেদনা ছেড়ে আবার জেগে ওঠেন কবি - ‘কবিতাকে ভালোবেসে এখনও বাঁচা যায় ...।’
আগরতলার ত্রিষ্টুপ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ৮৮ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে যে ৯০ টি কবিতা তার অধিকাংশ কবিতাই হলো কবিতার প্রেমে নিমজ্জিত এক কবির অনাবিল শব্দসন্ধান। কবিতায় কোথাও কোন অস্পষ্টতা, কোন দুর্বোধ্যতা নেই। শব্দের নিপুণ বিব্যাসে কবিতাময়তার চরমে পৌঁছে যায় সব কবিতা অনায়াস সাবলীলতায়। শব্দেরা যেন আপন খেয়ালে খুঁজে নেয় প্রতিশব্দ। প্রতিটি কবিতাই কোটেশনযোগ্য, আলাদা করে আলোচনার যোগ্য। এখানে উৎকৃষ্ট কবিতা বাছতে হয় না, এখানে ত্রুটি খুঁজে পেতে উচ্চ শক্তির আতস কাঁচের প্রয়োজন। কবির সাকিন অজান্তেই যেন ফুটে ওঠে কবিতায় - আসে সুরমা তীরের কথা, কুশিয়ারার কথা, জম্পুই পাহাড়ের কথা।
গোপাল-এর কবিতার বিচিত্র সব অবয়ব। অনায়াস দক্ষতায় লিপিবদ্ধ হয় বিশাল গদ্য কবিতা, গদ্যসম কবিতা, তন্বী কবিতা। দুই মলাটে ঘোর লাগা কবিতার ছড়াছড়ি। কবিতার প্রেম আর প্রেমের কবিতা হয়ে গেছে একাকার। বিচ্ছেদে যে লুকিয়ে থাকে কত প্রেম তা যেন পরতে পরতে মূর্ত হয়ে উঠেছে একাধিক কবিতায়।
কাল সারা রাত আমি তোমারেই দেখেছি
ডেফোডিলস্‌ ছুটেছিল মৃত্যুকাননে।
জলে জল রেখে ভেঙে গেছো বুঁদ
ভেসেছি বৃষ্টিতে লেখা ভুল বানানে।
.........
তুমি রচেছিলে ভাঙনের ইতিহাস
তুমিই দিয়েছিলে সর্বনাশা মেঘ।
আমি কেবল লিখেছি জীবনপত্রে তোমারে
“মেঘবালিকা” - বৃষ্টি দিনের আবেগ।
(কবিতা - মেঘবালিকা)।
সব কবিতার নীচে তারিখ দেওয়া আছে বলে দেখা যায় এপ্রিল ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২১ এর মধ্যেই লিখা সব কবিতা। প্রায় সব কবিতাই প্রথম পুরুষে লিখা। অর্থাৎ কবি সরাসরি নিজের কথাই বলতে চেয়েছেন কবিতায় - যেখানে কোথাও সামান্যতম প্রকাশও পায়নি প্রথম কাব্যগ্রন্থের কোনও ধরণের জড়তা। সপাট সহজ উচ্চারণে সেজে উঠেছে সব চমৎকারিত্বে মোড়া কবিতা। গ্রন্থের শেষ কবিতাটির নাম শিরোনামহীন। সাতটি কবিতার সমাহারে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এই চমৎকারিত্ব।
কবিতাসজ্জায় কিছু খামতি থেকে গেছে গ্রন্থে। পৃষ্ঠার যেকোন জায়গা থেকেই শুরু হয়ে গেছে পরবর্তী কবিতা। সারাংশে হেরফের না হলেও বিন্যাসে অবিন্যস্ত বোধ হয় বৈকি। প্রতিটি কবিতায় ‘নেই’ শব্দটি ‘নাই’ হয়ে আছে - যা কখনো বিসদৃশ লেগেছে পঠনে। গান (২) নামে একটি কবিতা আছে অথচ গান (১) নেই।
নির্ভুল বানানে পুরো গ্রন্থ জুড়ে ছড়িয়ে আছে যে বিশাল কাব্যসুষমা তার কাছে এই সামান্য বাহ্যিক বৈসাদৃশ্য ছাপ ফেলতে পারে না কোনওভাবেই। যথাযথ প্রচ্ছদ ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্যের। কবি তাঁর এই প্রথম গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর - ‘স্নান সেরে ফিরে আসেনি যে ভাই - শঙ্কুকে’। পাঠশেষে সার্থক হয়ে ওঠে কবির ভাবনা - ‘কবিতা এমন কিছু শব্দ বন্ধন, পড়তে পড়তে এক ক্রাইসিসের জন্ম দেয় ভিতরে, বেজে ওঠে পড়তে পড়তে শেষ হয়ে যাওয়ার আফসোস’
আজকাল কবিতা লিখছেন অনেকেই। ভালো লক্ষণ। নবাগতরা নির্দেশিকা গ্রন্থ হিসেবে নিজের চয়নে রাখতেই পারেন এই গ্রন্থ। সহজ বোধগম্যতায় আধুনিক কবিতার স্পষ্ট রূপরেখা সম্বলিত এই গ্রন্থের মাধ্যমে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবী ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন কবি গোপাল চক্রবর্তী - বরাকের সঞ্জয়।

 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

 

‘কবিতার বারান্দায় প্রথম পড়েছে আলো’
গোপাল চক্রবর্তী
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯১২৭০১২৬৪০

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়