Skip to main content

বিন্যস্ত ভাষ্যে অনন্ত ব্যথার কাব্যগ্রন্থ - ‘নগ্ন পায়ের মেয়ে’


ভালো লাগে ডিঙি নৌকায় চড়ে ভাসতে
প্রজাপতি বুনোহাঁস ভালো লাগে দেখতে, জানালার কোণে বসে উদাসী বিকেল দেখে, ভালোবাসি এক মনে কবিতা পড়তে
- এবং লিখতে, সম্ভবতঃ বাদ পড়ে গেছে কিংবা এড়িয়ে গেছেন স্বেচ্ছায়
এভাবেই নিজেকে মেলে ধরেছেন কবি সোমা মজুমদার ব্লার্বেনগ্ন পায়ের মেয়ে’ কবির প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ প্রচ্ছদ শিপ্রা দত্ত চৌধুরী, প্রকাশক অনুল্লেখিত যদিও পরিবেশনায় কথা বিকল্প পরিবার, শিলচর। অঙ্গসজ্জা ও প্রুফ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করেছেন ডঃ কাত্যায়নী দত্ত চৌধুরী ও ডঃ মধুমিতা ঘোষ। এর আগে কবির যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে দুটি - জানা গেল ব্লার্ব থেকেই
মোট ৭১ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থে আছে ৬০ টি কবিতা। পৃষ্ঠাসংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা ছিল। দু’একটির বাইরে গদ্য কবিতা নেই অথচ অনেকটাই দীর্ঘ কবিতাগুলি। সেক্ষেত্রে কবিতার অবয়ব ভেঙে পংক্তিগুলোকে একত্রিত করে পৃষ্ঠাসংখ্যা কমানো হয়েছে। এতে কবিতার কাব্যধর্ম ব্যাহত হয়েছে, অনেকটাই উবে গেছে কবিতাময়তাও। কবিতার পংক্তিবিন্যাস যথাযথ না হলে যা হয় আরকি। এভাবে স্বকৃত অবিন্যস্ততার বিড়ম্বনা সত্ত্বেও কবিতার শরীরে কবি এঁকে দিতে পেরেছেন যথাযথ শব্দবিন্যাসের মুনশিয়ানা। সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দের প্রয়োগ সোমার কবিতার অন্যতম সম্পদ।
কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবের কথা যদি বলতে হয় তাহলে দেখা যায় প্রায় প্রায় সবক’টি কবিতাই নারী জীবনের অপ্রাপ্তি এবং তার ব্যথা বেদনার মর্মগাথা। আছে কিছু প্রেম ভালোবাসারও কবিতা - সেখানেও ব্যর্থ প্রেমের খতিয়ান। অথচ যে সময়ে কবি এই বিষয়টিকে নিয়ে কবিতা লিখছেন সেখানে তার প্রতিবাদী সত্তার পরিচয় তুলে ধরাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ভূমিকা থেকে শুরু করে কোথাও কোন প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো না কবিতায়। পরিবর্তে যে শব্দগুলো ফিরে এসেছে বার বার তা হলো - শূন্যতা, যন্ত্রণা, মন খারাপি, ব্যথা, দীর্ঘশ্বাস, বিষণ্ণতা, কষ্ট।
ভূমিকায় কবি লিখছেন - ‘... প্রতিটি মেয়েকে খালি পায়ে কাঁটার আঘাত সইতে হচ্ছে, অথবা লড়াই করে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে। প্রতিটি মেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে পারুক, সেই কান্নার জন্য যেন তাকে বর্ষার অপেক্ষা করতে না হয়। নারীর পরিচয় হোক সেও একটা মানুষ, সেও নিজের মতো করে বাঁচতে পারুক, দীর্ঘশ্বাসের গল্পগুলো মন খুলে বলতে পারুক।’ ...
ভূমিকার পরই আছে কথাবিকল্প পরিবারের সূচিমুখ - যে পরিবারের কথাপ্রান্তিক বিজয়াকে উৎসর্গ করা হয়েছে গ্রন্থটি। ব্লার্ব থেকে শুরু করে সূচিমুখ হয়ে কবিতার শরীরে যতি চিহ্নের প্রয়োগে যথেষ্ট বিসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। বিসঙ্গতি আছে কবিতার শুরুতেই। প্রথম কবিতা ‘অসমাপ্ত পথযাত্রা’ - অথচ সূচিপত্রে রয়েছে ‘আমার পথযাত্রা’। সূচিমুখ এবং প্রথম কবিতার মধ্যে একটি সাদা পৃষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। যা না থাকাতে বোঝা যায় না কখন কবিতার পঠন শুরু হয়ে গেল - অনেকটা সাইরেন না বাজিয়ে স্টেশন থেকে রেলের ছুটে চলার মতো।
সেই পদ্যকে ভেঙে গদ্যের অবয়বে স্থাপিত করার ফলে উদ্ভুত অস্বস্তির পরদাটি সরিয়ে দিতে পারলে সোমার কবিতা বয়ে আনে এক অনাবিল, অন্তর্নিহিত ভাব-ভাষা ছন্দ। অবিন্যস্ত অবয়বের ভেতর যেন বিন্যস্ত এক কাব্যজগৎ। প্রথম কবিতা থেকেই যা অনুভূত হয় আপন মহিমায়। উদাহরণ হিসেবে প্রথম কবিতার কিয়দংশ তুলে ধরা যায় স্বচ্ছন্দে - অবশ্যই গ্রন্থগত পংক্তি বিন্যাসে -
‘এক নদী হিরণ্য জলে যখন স্নাত হচ্ছিল আমার নীলাভ আঁচল, তুমি তখন আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বলেছিলে জানো তো অনিন্দিতা এই নদীর বুক চিরে একটা পথ মিশে গেছে সমুদ্রের গভীরে। ...
......
তুমি যখন কথাগুলি বলছিলে আমার চোখে তখন খেলা করছিল এক সহস্র সোনালি সকাল।
এই পথ দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে আমরা এসে দাঁড়িয়েছিলাম একটি বাঁকে।
তুমি শক্ত করে আমার হাতটি ধরে অভয় দিয়ে বলেছিলে, ভয় পেয়ো না অনিন্দিতা, এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের নবযৌবনের সূর্যোদয়।
 
তারপর থেকে আর কোন সূর্যোদয় হলই না। কেবলই হল সূর্যাস্ত।
ঢেউগুলো চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে দিয়ে গেলো
পথের দু’ধারে পড়ে রইলো অপূর্ণ ইচ্ছেরা...
ফুলের সৌরভগুলো মিশে গেলো সমুদ্রের নোনা জলে...।
অসমাপ্ত রয়ে গেলো পথযাত্রা...
.........’
এভাবেই প্রতিটি কবিতায় সূর্যোদয় নয়, শুধু সূর্যাস্তের কাহিনি। হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের গল্প, হেরে যাওয়া জীবনের কান্না আর ধূ ধূ শূন্যতার গল্প। তাই তো ‘সকাল নয়, সন্ধ্যা’ই কবির প্রিয়। প্রথম কবিতা (অসমাপ্ত পথযাত্রা) থেকে শেষ কবিতা (মধ্যরাতের মনখারাপি) জুড়ে অনন্ত এক অতৃপ্তি আর অ-সুখের বাখান। অথচ প্রতিবাদ নয় পালিয়ে যাওয়াই যেন কবির কাঙ্ক্ষিত -
‘পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সব প্রেম মুছে গেলে হেরে যাওয়া প্রেমিক আত্মারা যদি
বিদ্রোহ ঘোষণা করে তবে আমি একদিন খুব ছোট্ট একটা পাখি হয়ে যাবো। আর
এই ছোট্ট ফাঁক দিয়ে উড়ে গিয়ে খুঁজে নেবো মন কেমনের অন্য ঠিকানা। ......’
(কবিতা - একদিন হবো তোমার বসন্তের পাখি)
একাধিক কবিতায় সব মন খারাপের সমাধান এসেছে - কবিতায়। অথচ বৈপরীত্যে তিনিই লিখছেন -
‘বুকের ভেতর একরাশ শূন্যতা চেপে রেখে কখনো মন ভালো করে নেওয়ার মতো
কবিতা লিখা যায় না রে পাগলি।’
(কবিতা - মিতার জন্য)।
এরই মধ্যে ‘একা আছি বেশ আছি’ এবং সামান্য হলেও ‘অলীক সুখ’ কবিতায় মৃদু প্রতিবাদের ছোঁয়া লক্ষ করা যায় - জোরালো নয় যদিও, ইচ্ছেগুলো ফিরে আসে আবারো। কাব্য সুষমা সবখানেই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত -
‘... তোমার অলীক সুখের ছোঁয়ায় আমি কেমন নদী হয়ে যেতাম, ভালোবাসা মেপে
মেপে কেমন বৃষ্টি হয়ে যেতাম।।
বারবার ভুল করতাম।
...... তোমার অলীক সুখের ছোঁয়ায় আমি আবার নদী হতে চাই।
ঘুমন্ত পাড়ার ভেজা পথ ধরে চুপিচুপি হেঁটে গিয়ে আবার বেপরোয়া হতে চাই ...।
ভালোবাসা আগলে রেখে বৃষ্টি হতে চাই ...
(কবিতা - অলীক সুখ)।
আছে কিছু অন্ত্যমিলের ছন্দ কবিতাও তবে এখানেও ছন্দের চাইতে ভাষার টান অধিক। বিষাদময়তা যদি কাব্যগ্রন্থের আদ্যোপান্ত বিষয় হয় সেখানে প্রতিটি কবিতাই ভাব, ভাষায় গম্ভীর, স্বচ্ছন্দ এবং সুবিন্যস্ত নিঃসন্দেহে। আলাদা করে কবিতার উল্লেখ করা যায় না পুরো গ্রন্থের মূল নির্যাস কিন্তু সেই শব্দসমূহের সঠিক সামঞ্জস্য, ভাষার যথার্থ প্রয়োগ এবং সুবিন্যাস। সর্বোপরি এক সুখপাঠ্য কাব্যগ্রন্থ।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘নগ্ন পায়ের মেয়ে’
সোমা মজুমদার
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৬০০১৮৩৮৬৬১

Comments

  1. আমার আগামী বই প্রকাশের সময় এই আলোচনা টা যথেষ্ট দরকার ছিল, এতো সুন্দর গঠনমূলক আলোচনা যদি পাই তবেই সঠিক পথে এগোতে পারবো বলে আশাকরি। অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় লেখক। 🙏♥️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়