Skip to main content

কবি জিতেন্দ্ৰ নাথ-এর মনোজাগতিক কাব্যগ্ৰন্থ 'অন্য এক রূপসি নগরে'




কবি জিতেন্দ্র নাথ। বরাক উপত্যকার বলিষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম। অথচ প্রচারের আলোয় তাঁকে দেখা যায় না তেমন করে। একক গ্রন্থ এবং সংকলন - সব মিলিয়ে এ যাবৎ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দশেরও অধিক। তাঁর অন্যতম একক কাব্যগ্রন্থ ‘অন্য এক রূপসি নগরে’। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিজের শহর হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ২৮তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন মঞ্চে। কবি তাঁর এই গ্রন্থটি ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে উয়সর্গ করেছেন দু’দফায়। প্রথমে উপত্যকার ১৪ জন কবি সাহিত্যিকদের উদ্দেশে এবং দ্বিতীয় দফায় তাঁর এগারো  জন পূর্বপুরুষ (যাঁদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর প্রমাতামহ, মাতামহ, মাতামহী এবং অতিবৃদ্ধপ্রপিতামহ থেকে শুরু করে পিতা অবধি) সহ তাঁর কাকা এবং শ্বশুরকে।
‘কবিকথা শীর্ষক ভূমিকায় কবি জানিয়েছেন যে আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাসমূহ ১৯৯৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিখা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে লিখা কবিতার মধ্য থেকে নির্বাচিত সব কবিতগুলো পাঠ করলেও এক বিবর্তন কিন্তু লক্ষ করা যায়। মাত্র দুই লাইনের কবিতা থেকে শুরু করে আছে পৃষ্ঠাজোড়া কবিতা যার মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু সরাসরি কথন এবং কিছু গভীর ভাবব্যঞ্জনা। আছে একগুচ্ছ স্মৃতিমেদুর কবিতা যার মধ্য দিয়ে ভেসে আসে কবির অভিজ্ঞতাপ্রসূত মনোগত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ -
এখনও একটি ছবি অ্যালবামে যত্ন করে
সামলে রেখেছি। মাঝে মাঝে একান্ত সময়ে
অ্যালবামের পাতা উল্টে ছবিটি দেখে নিই।
বারেবারে, দু’চোখ ভরে ...
ছবিটি এখনও যেন চোখে-চোখে
কথা বলে, প্রাণ জুড়ে দেয়
আমার মনের সঙ্গে।
(কবিতা - ছবি)
কিংবা - 
চিঠিগুলি আছে
কাঠের সিন্দুকে
মাঝে মাঝে একলা সময়ে
লাজুক মনে পড়ি।
সেই সময়ের স্মৃতিগুলো
ন্যাপথালিনের গন্ধে পুরোনো
বাতাস বয়ে আনে একলা ঘরে।
(কবিতা - চিঠি)
এই চিঠিরই সূত্র ধরে কবি বেশ ক’টি কবিতার মাধ্যমে তাঁর মনোগত বার্তা পৌঁছে দিয়েছে তাঁর প্রিয়জনদের কাছেও। কবিতার হাত ধরে কবি যেন মেলে ধরেছেন নিজেকে। তাঁর ভাবনার জগৎ সরল, অকপট কথনে তুলে দিয়েছেন প্রেম ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতার মোড়কে।
এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই কবির মনোজগতের পরিচিত ছবিগুলোকেই যেন নিয়ে এসেছে প্রকাশ্যে। শব্দে, লালিত্যে সযতনে সাজানোর এক আন্তরিক প্রচেষ্টা অনুভব করা যায় প্রতিটি কবিতায়। বলতে গেলে প্রতিটি কবিতাই এক একটি স্বপ্ন কিংবা কবির ভাষায় বলা যায় স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আরোও এক স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা -
সব স্বপ্ন কি ফিরে আসে ?
তবুও স্বপ্ন দেখি
ফেরি করি স্বপ্ন,
ভোরের আলোয় ঘুম ঘুম চোখে
পাখিদের ডাক শুনে শুনে
আবার নতুন করে স্বপ্ন গড়ি 
স্বপ্নের ভেতর পায়চারি করি
আরেক স্বপ্নকে ছুঁয়ে নিতে।
(কবিতা - স্বপ্ন ফেরি করি)।
আবার কবিমননে ধরা দেয় অধরা স্বপ্নের প্রতি তাঁর অভিমান। শব্দেরা আসে মিছিল করে, তবু থেকে যায় অধরা। এখানেও কবির ভরসা সেই কবিতাই -
ঘুমোতে চাইলে ঘুমোতে পারিনা 
এপাশ ওপাশ করি বিছানায়
ভ্যাপসা গরমে, ভোর হয়
তারপর ক্রমাগত 
শব্দেরা মিছিল করে আসে
পিঁপড়ের মতো
তাকে ধরেও ধরতে পারি না।
বড় অভিমানী তুমি
কোন একদিন
কবিতায় ধরা দেবে।
(কবিতা - শব্দেরা মিছিল করে)।
এই গ্রন্থের সম্পদ কিছু অণু কবিতার উল্লেখ অপরিহার্য। স্বল্প কথার অন্দরে বৃহৎ ভাবনার অনুপম প্রকাশ এই অণু কবিতাগুলি -
বাড়ি বদলের সাথে সাথে
ঠিকানাও বদলে যায়। (কবিতা - ঠিকানা),
বন্ধু বন্ধু ভাব
এ তো সব ভালো
শরীর-টরীর নিয়ে মাখামাখি ছাড়া
আর বাকি সব ভালো। (কবিতা - বন্ধু), 
মৌমাছিটির মতন
বারেবারে আসি
তবুও তো হয় না কো
বইগুলো বাসি। (কবিতা - বই)।
আছে গ্রন্থনামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি কবিতাও। রং-এর ছটায় কবিকল্পনার পরিভ্রমণ -
এত রং মেখেছ সমস্ত শরীর জুড়ে
লালে লাল জবা ফুলের মতো ...
তারপর
আমিও রং-এর ছটাগুলো দুহাত ভরে
সারা গায়ে মেখে, অপূর্ব আনন্দে ভেসে
গেলাম - অন্য এক রূপসি নগরে।
কবি জিতেন নাথের কবিতা বরাবরই সরল পথচারী কবিতা। তবু গায়ে মেখে চলে কাব্যগন্ধ। এই বইয়ের ৭৬টি কবিতাও তেমনই। কোথাও কোনো দুর্বোধ্যতা নেই, নেই কোনও ইঙ্গিতবাহী ধোঁয়াশা কিংবা স্যাটায়ার আদি। তবু কবিতা হয়ে দাঁড়ায় কবিতাগুলি।
গ্রন্থের মানানসই প্রচ্ছদের সৌজন্যে স্বপন নন্দী। সূচিপত্র বড্ড অবিন্যস্ত। কবিতা-নাম কিংবা পৃষ্ঠাসংখ্যা খুঁজে পেতে কসরত করতে হয়। কিছু কিছু কবিতার পঙতি বিন্যাসে আরোও খানিকটা যত্নবান হওয়া যেত। তবু সব কিছু ছাপিয়ে কবিতাগুলো জায়গা করে নিয়েছে নিজগুণে। এবং এটাই শেষ কথা। 
‘অন্য এক রূপসি নগরে’
জিতেন্দ্র নাথ
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৩৬৫১৬০৭৩৩

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...