বুড়িমাসি আসছেন।
অন্ধ বুড়ি। কেউ তাঁর নাম জানতো না। তিনি নিজেও কি জানতেন ? কীজানি ? সবারই তিনি - ‘বুড়িমাসি’।
চওড়া পথটি দু’দিকেই প্রায় সমান দূরত্বে গিয়ে পড়েছে দুই পাকা সড়কে। পাকা বলতে মোরাম বিছানো পথ, ধুলির স্বর্গরাজ্য। সড়ক দু’টি ধরে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দিনে গোটা চারেক বাস্ যাতায়াত করে দূরবর্তী শহরে। সময় হিসেবেই তাদের নামকরণ। ন’টার বাস্, বারোটার বাস্, তিনটার বাস্ কিংবা পাঁচটার বাস্ ইত্যাদি - যদিও নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা পরেই সেগুলো এসে পৌঁছতো। তাতে অবশ্য বিশেষ আপত্তির কিছু ছিল না গ্রামবাসীর। সময়ের এত অভাব তখন ছিল না বলেই হয়তো বা। লোকেদের মুখে প্রায়শঃ প্রশ্ন শোনা যেত - ‘আজ বারোটার বাস্ ক’টায় এল ?’
কোনও এক উদাস দুপুরে বাস্ রাস্তা থেকে ফিরে
আসার পথে দেখতে পেলাম বুড়িমাসিকে হাতে ধরে এগিয়ে নিয়ে আসছে একটি অপরিচিত ছোট্ট মেয়ে। আমার চাইতে ছোটই হবে। এর আগেও দেখেছি তাঁকে
এভাবে কারো সাহায্য নিয়ে আসতে। বুড়িমাসিকে দেখেই বুঝে গেলাম তিনি আমাদের বাড়িতেই আসছেন। এই বুঝে নেওয়ার পেছনে এক গূঢ় কারণ
ছিল।
বুড়িমাসি অন্ধ ছিলেন। এবাড়ি ওবাড়ি টইটই করে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে বারকয়েক তাঁর বাড়িতেও গেছি। সংসারে তাঁর কেউ ছিল না। শুনেছিলাম এককালে সবই তাঁর ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সব হারিয়ে এখন তিনি নিতান্তই একা। তাঁর নাকি ছেলেও আছে বাইরে। সেও খোঁজখবর রাখে না। দুই চোখে দৃষ্টি না থাকলে চলার পথ কতটা কঠিন তখন সেসব বুঝতাম না। আমার চোখে তাঁর অন্ধত্বটাই স্বাভাবিক ছিল। গ্রামের সবাই তাঁকে যতটা সম্ভব সাহায্য করত। তিনিও হাত পেতে তা নিতেন। কখনো কখনো তিনি দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে গ্রামেরই কোনো বাড়িতে স্বনিমন্ত্রিত হয়ে দুপুরের আহার সারতেন। এই হাতে গোনা কিছু পরিবারের মধ্যে আমাদের ঘরটিও ছিল - যদিও আমাদের নিজেদেরই তখন নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। অথচ তাঁর ক্ষেত্রে আমার মা ছিলেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। কোথা থেকে কী করে যে যাহোক কিছু করে তাঁকে খাইয়ে ছাড়তেন তা তিনিই জানতেন। খাওয়াদাওয়ার পদের ব্যাপারে বুড়িমাসির কোন পছন্দ অপছন্দ ছিল না। ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া। যতক্ষণ তিনি থাকতেন ততক্ষণই গল্পগুজবে জড়িয়ে থাকতেন মায়ের সঙ্গে। সাথে পথ দেখিয়ে যে নিয়ে আসতো তারও ভাগ্যে জুটে যেত দুপুরের খাওয়া। অলিখিত অধিকার বটে।
সুতরাং বাস্রাস্তা থেকে ফেরার পথে বুড়িমাসিকে এদিকে আসতে দেখেই দৌড়ে এসে মা’কে খবরটি দিলাম। সেদিন বোধ করি হাঁড়ি চড়ানোর মতো কোনো সুবিধে ছিল না মায়ের হাতে, তাই অন্ধ বুড়িমাসির আগমনবার্তা শুনে মুষড়ে পড়লেন মা। তখন প্রায়ই হাঁড়ি চড়ত না আমাদের ঘরে। যদিও আমি তা টের পেতাম খুব কম। আমার জন্য যাহোক কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যেত। বড়দের দেখেছি প্রায়শ অনাহারে থাকতে কিংবা আটার গোলা সেদ্ধ বা কাঁঠালবিচি সেদ্ধ করে খুব জম্পেশ করে খেতে। তখন বুঝতাম না এসব ছিল বিকল্প আহার।
অগত্যা মা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন গিয়ে সেই পাশের ঘরের জ্যেঠিমার কাছে। এই একটাই ছিল ভরসার স্থল। ফেরাতেন না জ্যেঠিমা। দিনের পর দিন জুগিয়ে গেছেন আকস্মিক আবশ্যকতা। মা হিসেব রাখতেন জ্যেঠিমার থেকে এ যাবৎ মোট ক’কৌটো চাল ধার হলো।
- ও দিদি, অন্ধ বুড়ি নাকি আসছেন। ঘরে চাল নেই এক কৌটোও। তাঁকে কী বলে ফেরাই ?
জ্যেঠিমাও পড়লেন সমস্যার গভীর জালে। অগত্যা উপযুক্ত পরিমাণ চাল, সাথে খানিকটা সবজিও তুলে দিলেন মায়ের হাতে। জ্যেঠিমার দেওয়া চালেই উদরপূর্তি হলো বুড়িমাসি ও তাঁর পথসখা মেয়েটির।
খেতে বসে - ‘ও দিদি, আপনিও বসে পড়ুন’ - বুড়িমাসি মা’কে আহ্বান জানালেন।
- আর বলবেন না, আজ আমার উপোস।
- আজ আবার কীসের ব্রত ?
মা হয়তো মনে মনে বারের হিসেব কষে বললেন - ‘সুমতি’। বা - ‘সঙ্কটা’।
সঙ্কট থেকে তখন বোধ করি এরাই রক্ষা করতেন অসুরক্ষিত মানবমানবীদের। কত ব্রতের যে কথা শুনতাম তখন। মঙ্গলচণ্ডী, সূর্যব্রত, ঝটপট, বিপদনাশিনী ......। তিন চারটি ঘর মিলে একসাথে ব্রত উদ্যাপন হতো। একা একা ব্রতের উপচার জোগানোর মতো ক্ষমতা বোধ করি সবার ছিল না। তাই এই যৌথ ব্যবস্থা। সকাল থেকে উপোস করে দুপুরে ব্রতকথা পাঠ করে বা মুখে মুখে শুনিয়ে এর পর যৌথ আহার।
- ঠিক আছে তবে, বলে খেতে শুরু করলেন বুড়িমাসি। কাছেই বসে মা। কত গল্প, কত কথা।
ছেড়ে আসা দেশের গল্প, নিজের অভাগা জীবনের কষ্টকথা। মাও মাঝে মাঝেই মেলে ধরতেন নিজেকে। যেন কাছের বন্ধু। অন্ধ বুড়িমাসিকে পাশে বসিয়ে খাইয়ে বাসনকোসন ধুয়ে মায়ের মুখে যে এক প্রশান্তি তা আমার চোখ এড়াত না। ছিন্নমূলের নতুন জীবনের বন্ধুর পথ চলার কষ্টকর অভিজ্ঞতার বর্ণনে ভারী হয়ে উঠত বাতাস। তখন এসব কথার এতসব মানে বুঝতাম না।
বিকেলে আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই নিজের ঘরের উদ্দেশে পা বাড়াতেন বুড়িমাসি। শিশুসখার হাতে বাঁ হাত আর ডান হাতে অন্ধের লাঠি।
###
আজ তিরিশ বছর পর কত কিছু পালটে গেছে
পৃথিবীতে। গ্রামের
পায়ে হাঁটা পথগুলো পাকা হয়েছে, বাসরাস্তা চওড়া হয়েছে। এখন সারা দিন রাত ধরে রকমারি গাড়ির
ছুটোছুটি। আমাদের
সেই বাড়িটি আর নেই। বুড়িমাসি
তাঁর জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন কবেই। জীবনসংগ্রাম শেষে মা’ও গত হয়েছেন আজ দু’বছর আগে। এখন সেখানে গেলে পরিবেশ পরিস্থিতির এতসব উন্নয়ন দেখেও যেন ভালো
লাগে না কিছুই। মনে
হয় হারিয়ে গেছে সব কিছু। কেন এমন হয় ? মা-বাবার স্মৃতি এসে
জাপটে ধরে আপাদমস্তক। বাবার অবসরের পর একা তাঁরা দু’জনের পক্ষে আর বেশিদিন
সেখানে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক বুক বিষাদকে
সঙ্গী করে নিজেদের হাতে গড়ে তোলা ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন আমাদের, পুত্রদের কাছে
- দূরে দূরান্তরে।
এতদিনে চাকরিবাকরি করে সংসারী হয়েছি
আমিও। বদলির
চাকরির সুবাদে নানা জায়গায় গিয়ে থিতু হয়েছি অস্থায়ী ভাবে। জীবনের শেষ দিনগুলিতে মা যেন হারিয়ে
গিয়েছিলেন নিজের মধ্যেই। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে সব জাগতিক ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন জীবনের
শেষ দেড়-দু’বছর। চির শয্যাশায়ী। আমার সহধর্মিণীর সেবাযত্নের ছবি আমার
কাছে এক নতুন প্রাপ্তি। নারীর অন্তরে চির বিদ্যমান সেবাধর্মটির পরিচয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই অন্ধ বুড়িমাসির প্রতি মায়ের সেবাভাব
আজও আমাকে স্মৃতির ভারে নিমজ্জিত করে রাখে। নিজে না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে অন্ধজনে,
আতুরজনে বিলিয়ে দেওয়া এই মানবতার সাক্ষী হতে পেরেছিলাম বলেই হয়তো আজ
মাথা উঁচু করে সমাজের একজন হয়ে থাকতে পারছি।
মায়ের মৃত্যুর পর প্রায় দু’বছর হলো আমি আবার বদলির
সামনে দাঁড়িয়ে। যেখানেই যাই নতুন করে অনেক আসবাবপত্র কিনতে হয়। তাই পুরোনো জিনিসপত্র যেগুলো প্রায়
ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে সেগুলো পুরোনো জায়গায় ফেলে এসে নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন করে
ঘর সাজাতে হয়। এভাবেই
চলে আসছে অন্যূন পনেরো বছর ধরে।
বদলির চাকরির অনেক হ্যাপা। আমি যেখানে ছিলাম, মায়ের শেষ কিছু দিন যেখানে কেটেছে সেখানকার সামাজিক পরিস্থিতি আমাদের পারিবারিক জীবনশৈলীর সাথে খাপ খাচ্ছিল না। একমাত্র মেয়েটি বড় হচ্ছিল। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সেই মুহূর্তে ওখান থেকে বদলিটা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। অন্যথা মেয়েটির এই বেড়ে ওঠার বয়সে সামাজিক, নান্দনিক কোনো শিক্ষার সুযোগই সে পাবে না। এই চিন্তাটি আমরা স্বামী স্ত্রী দু’জনকেই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়ে সেই জায়গাটি থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূর এক জেলা সদরে বদলির আবেদন করলাম এবং যথাসময়ে তা অনুমোদনও পেয়ে গেল। এবার শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ, আবার পাততাড়ি গোটানোর পালা। বদলি বড় সহজ কথা নয়। পুরোনো জায়গাটি একেবারে খালি করে দিয়ে নতুন জায়গায় যথাযথ বাসাবাড়ির সন্ধান করে নতুন সংসার সাজাতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়। কী করে কী করবো ভেবে যখন দিশেহারা অবস্থা তখন মৌলিই নিজে থেকে উপায় বাতলে দিল -
- রামনগরে তো ছোটমামারা
থাকেন। তুমি
নাহয় সেখানে গিয়েই ওঠ প্রথম বার। সেখানে থেকেই বাসাবাড়ির খোঁজখবর করতে
পারবে।
আমার মনে ছিল ছোটমামাদের কথা। কিন্তু যেহেতু আজ অনেকদিন ধরে তেমন কোনও যোগাযোগ নেই, তাছাড়া হাজার হলেও শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয় তাই মুখ ফুটে আর বলিনি কথাটি। মৌলিই যখন পথ দেখিয়ে দিল তখন আর অন্য চিন্তা করে লাভ নেই।
একদিকে অফিসে বদলির আগের যুদ্ধকালীন কাজকর্ম অন্যদিকে মেয়ের স্কুল থেকে বদলির সার্টিফিকেট আনা, গ্যাস কানেকশন, বিদ্যুতের কানেকশন, পুরোনো বাসা মালিকের সঙ্গে কথা বলে হিসেব পত্র করা, ব্যাঙ্কের পাসবুক বদলি ইত্যাদি হাজারো ঝামেলায় বলতে গেলে নাস্তানাবুদ অবস্থা। তখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। ডায়েরি ঘেটে ছোটমামাশ্বশুরের ফোন নম্বর বের করে এক রাতে ডায়াল করলাম। প্রথমেই কথা বলে ভূমিকাটা সেরে নিল মৌলি। এরপর আমিও কথা বললাম। নিঃসন্তান ছোটমামা অসম্ভব রকমের একজন ভালো মানুষ। সহজ, সরল, নিখাদ ভদ্রলোক যাকে বলে। কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে কাজ করেন। তবে তাঁর বদলির চাকরি নয়। তাই রামনগরেই বাড়ি বানিয়ে দু’জনে বসবাস করেন। মামিটিও তাঁর সঙ্গে মানানসই। আমাদের বিয়েতে তাঁদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। অনেকবার যাবার কথা বলেছিলেন যদিও যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি এত দিনেও।
আসলে সেই যে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর ধারা তার রেশ যেন আর কাটতেই চাইছে না আজ এতগুলো বছরেও। অবস্থা পাল্টেছে নির্ঘাত বহুগুণ কিন্তু সেই অবাধ সাচ্ছল্য, খুশিমতো টাকাপয়সা খরচ করার স্বাধীনতা আসেনি সে অর্থে আজও। ছিন্নমূলের বোধ করি দুই প্রজন্মেও চারাগাছ আর মহিরুহ হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। হাত খুলে তাই মনের সব ইচ্ছে আর পূরণ করতে পারি না। এখনো হিসেব কষেই চালাতে হয় সংসার। তার মধ্যে বিয়ে করে আনা স্ত্রীরত্নটি কিংবা নিজের ঔরসজাত সন্তানটির সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দায়ভার যখন নিয়েছি মাথা পেতে সুতরাং এ বিষয়টাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে বৈকি। বোধ করি আমার মতো সব পুরুষেরই এক অবস্থা। যখনই নিজের জন্য সামান্য কিছু একটা করার প্রয়োজনীয়তা এসে দাঁড়ায় তখনই দেখা যায় স্ত্রী কিংবা সন্তানেরও এই মুহূর্তে এমন কিছু দরকার যার মূল্য আমার কাছে ততটা না হলেও ওদের কাছে প্রায় সাংঘাতিক। তখন অনায়াসে নিজের ইচ্ছেটাকে আরো কিছু অনন্ত সময়ের জন্য মুলতুবি করে রাখাটাই বুদ্ধিমানের এবং তৃপ্তির কাজ। ধরা যাক আমার নিত্য ব্যবহারের চামড়ার স্যান্ডেলটির শুকতলা ক্ষয়ে ক্ষয়ে এবং একাধিকবার মুচির হাতে মেরামতি করিয়ে নেওয়ার পর যখন আর কিছুতেই টেনে চলা যাচ্ছে না এবং এবার অনেক সাহস করে একটি স্যান্ডেল কিনেই নেব বলে মনস্থির করেছি ঠিক তখনই দেখা গেল তাদেরও একজোড়া করে স্যান্ডেলের দরকার এবং সেটা এমন হতে হবে যে বাইরেও পরা যায় এবং ঘরেও পরা যায়। এমন অনেক নতুন জুতো নাকি বাজারে বেরিয়েছে। খুব সুবিধের। সবাই এখন এগুলোই পরে, সুতরাং এখনই চাই। অথচ বাইরে এবং ঘরে পরার মতো বেশ কয়েক জোড়া স্যান্ডেল তাদের আছে। আমার কিন্তু সাকুল্যে একটি। সেদিকে কারো নজর বড় একটা পড়ে না। অগত্যা বাজারে গিয়ে নিজেদের পছন্দের স্যান্ডেল জুতো এবং সাথে হঠাৎ করে নজরে পড়া খুব সুন্দর এবং লেটেস্ট ডিজাইনের একটি করে বাড়তি স্যান্ডেলও পছন্দ হয়ে গেল। সবার সামনে সরাসরি কিছু বললে সেটা শোভন হয় না। একমাত্র সন্তান কিংবা একমাত্র স্ত্রী বলে কথা। অন্যথা হলে আমার ভেতরের দয়ামায়ার উপস্থিতি সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়বে উপস্থিত সবাই। সুতরাং মনের আনন্দে দু’জোড়া করে স্যান্ডেল নিয়ে এবং শহুরে কায়দায় ফাউ হিসেবে দশটাকার স্ন্যাক্স্ পঞ্চাশ টাকায় খেয়ে বাড়ি ফেরা। নিট ফল আমার নতুন জুতো কেনার পরিকল্পনা বেশ ক’দিনের জন্য আবারো মুলতুবি হয়ে যাওয়া। ভেতরে ভেতরে একটা দুঃখ রয়ে যায় তাই সব সময়। তবু তাদের মুখে তৃপ্তির এই হাসিটুকুতেই যেন বেঁচে থাকা। ভবিষ্যতটাকে সুরক্ষিত করে রাখার আপ্রাণ কৃচ্ছসাধনই হলো পুরুষের জীবনের ব্রত। কে আর বোঝে সেসব কথা। তবে বলে মাঝেমাঝে - ‘তোমার জন্য এটা ওটা কিনে নাও’। সে কথায় আমি আর তেমন গা করি না, ওরাও ভুলে যায়। এমনি করে করে একাধিক আলমারি আর সুট্কেস ভর্তি হয়ে গেছে ওদের পুরোনো জামা আর শাড়িতে যার অধিকাংশই আর এখন পরা হয় না। তবু কী যে এক অমোঘ মায়া সেই কাপড়গুলোতে তা আর বলে বুঝানোর নয়। ক’দিন পরে পরেই খুলে রোদে দেয়, দেখে তারিয়ে তারিয়ে। আমি দূর থেকে মুচকি হাসি। ক্বচিৎ কখনো কাজের মাসির ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে অবশ্য।
এত এত মাইনের পরও আমার সঞ্চয়ের ঘর বরাবরই শূন্য। সংসারের খরচের উপরেও বড় ভাইদের সংসারেও কিছু অবদান রাখতে হয়। ছেলেদের এটা ওটা চাই। নতুন বাড়ি, গাড়ির ভীষণ দরকার ওদের। আমার জীবনে মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে ওদের অবদান বিশাল। শেকড়চ্যুত বাবার পক্ষে চার চারটে সন্তানের মুখে ভাত জুগিয়ে মানুষ করার পর আর অবশিষ্ট কিছুই ছিল না, থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে কষ্ট করে নিজেরা পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করে আমাকেও পড়িয়েছে, নান্দনিক শিক্ষা দিয়েছে, বাইরের জগৎটাকে চিনিয়েছে আমার দাদা, দিদিরাই। সুতরাং আমারও কিছু কর্তব্যাকর্তব্য থেকে যায়। সবকিছু সামলেসুমলে এখন এই বদলির ব্যাপারে আবার একগুচ্ছ খরচাপাতির পর পকেট প্রায় ফাঁকাই হয়ে রইল।
ছোটমামা খুব খুশি হলেন আমি রামনগরে বদলি হয়েছি শুনে। সন্তানহীন দম্পতির একটি অন্তত কাছের মানুষকে কাছে পাওয়ার এক আলাদা খুশিও থাকবেই স্বাভাবিক। তাছাড়া ছোটমামারও বয়স হয়েছে। শুনেছি এর মধ্যেই নাকি অবসর নেবেন। এমনিতেও ওরা দু’জনই খুবই আন্তরিক এবং স্নেহবৎসল - সে আমার জানা। সব কিছু গুছিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগদানের উদ্দেশে গাড়িতে উঠে বসলাম অবশেষে। ছোটমামার ঘরে গিয়ে উঠলাম এবং পরদিনই কাজে যোগদান করলাম। ছোটমামি নিজের হাতে রান্না করে আমাকে খাইয়ে খুব খুশি। আবার যেন অনেক দিন পর অন্য রূপে মা’কে খুঁজে পেলাম।
একদিন ছোটমামা নিজে থেকেই বললেন - ‘বিজন, নতুন করে এসে এখানে কাজে যোগ দিয়েছ, অফিসিয়াল ফর্মালিটি শেষ হয়ে বেতন পেতে হয়তো দেরি হবে খানিকটা। তাছাড়া জিনিসপত্র নিয়ে আসার খরচও আছে। তোমার টাকাপয়সার দরকার হলে বলো আমাকে। সংকোচ করো না।’ আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম তাঁর কথায়।
ছোটমামার সঙ্গে গিয়ে নতুন বাসা দেখে ঠিকঠাক করে এলাম। প্রায় দিন দশেক এভাবেই ছোটমামার ঘরে থেকে অফিস করলাম। এরপর ছুটি নিয়ে পুরোনো জায়গায় ফিরে এসে একদিন সবাইকে নিয়ে আবার চলে এলাম রামনগর। পকেটকে যথাসম্ভব হিসেব কষে কষে সামলে রাখলাম। তথাপি নতুন আস্তানা গড়তে কিছু আবশ্যক খরচ তো থাকেই। তবে নতুন জায়গায় বেতন পেতে কিছু দেরি হতেই পারে অফিসিয়াল নিয়মকানুন মেনে সব কিছু ঠিকঠাক করতে। সে আমার জানা ছিল বলে খুব সমঝে চলছি একেকটা দিন। যদিও আবশ্যক জিনিসপত্রগুলোকে তো আর বাদ দেওয়া যায় না। এর মধ্যে মৌলি একদিন বলেই ফেলল -
- নতুন আলমারিটা কিন্তু তাড়াতাড়ি কিনতে হবে। কাপড়চোপড়গুলো নাহলে নষ্ট হয়ে যাবে। বললাম - ‘বেতনটা হয়ে যাক, তারপর কিনব।’
মোটামুটি মন্দ লাগছে না নতুন জায়গায় এসে। প্রতিবারই এমন হয়। নতুন পরিবেশে মনটা অনেকখানি ফুরফুরে হয়ে থাকে। নতুন ঘরে খেতে বসতে, ঘুমোতে এক আলাদা আমেজ যেন অনুভূত হয়। অফিসেও নতুন পরিবেশ, নতুন দায়িত্ব। মাঝে মাঝে ছোটমামাদের ঘরে ঘুরতে যাওয়া। ইতিমধ্যে আমার বাজাজ স্কুটারটি এসে পৌঁছে গেছে রামনগর। তাই চলাফেরায় আর বিশেষ অসুবিধে নেই। কিন্তু প্রথম মাসের বেতন পেতে দেরি হওয়ায় কিছুটা শঙ্কিত হয়ে আছি। হঠাৎ করে যদি বিশেষ কোন প্রয়োজন এসে পড়ে তাহলে সমস্যায় পড়ে যাবো। ব্যাঙ্কের একাউন্ট বদল হয়নি তখনো। আর হলেও লাভ বিশেষ হতো না, কারণ দু’টি একাউন্টই প্রায় খালি। এখানে তেমন চেনাজানাও নেই কারো সাথে যে এসেই টাকা ধার চাইব। তাছাড়া এই কাজটিতে আমি বরাবরই খুব অস্বস্তি অনুভব করি। তাই কারো কাছে টাকা ধার চাইতেই পারিনা। আবার ঠিক এর বিপরীতে কেউ ঠাকাপয়সা ধার চাইলে চট করে নাও বলতে পারিনা। ফলে বেশ কয়েকবার কিছু টাকা গচ্চাও গেছে। এখানে একমাত্র কাছের মানুষ হলেন ছোটমামা। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় বলে তাঁর কাছেও হাত পাতাটা ভীষণ লজ্জার হবে। ছোটমামা যদিও বলেই রেখেছেন যে বেতন পেতে দেরি হলে প্রয়োজনে বলতে। তবু একটা সংকোচ থেকেই যায়। ভাগ্নি জামাই-এর আর্থিক অবস্থা করুণ রূপটি দেখতে কোন মামারই বা ভালো লাগবে ? একটা সম্মানজনক পদে কাজ করি বলে এমনিতেই তাঁদের কাছে একটা আলাদা সম্মান আছে আমার। আছে এক গর্ব। এখন টাকা ধার চাইলে কী ভাববেন তাঁরা ?
আলমারির কথাটি মাঝে আবারও একদিন বলেছে মৌলি। এবার সুর খানিকটা চড়া মনে হলো। আবারও বুঝিয়ে নিরস্ত করলাম মৌলিকে। আমার অবাক লাগে খাওয়া দাওয়া বা অন্যান্য কোনকিছুর জন্যই মৌলির কোন অভাববোধ নেই। কিন্তু অগোছালো কাপড়চোপড়ের যত্নের কথায় সে যেন একেবারেই অবুঝ। অথচ আমার কাছে এ নিতান্তই এক অদরকারি বিষয়। মাস দুয়েক যদি কাপড়গুলো বিছানা কিংবা অন্য কোনো আসবাবের উপর পড়ে থাকে তাহলে কী আর এমন আসে যায় ? কিন্তু এ বিষয়ে মৌলির চিন্তাধারা একেবারেই ভিন্ন। আমিও মনে মনে হিসেব কষেছিলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে হাজার পাঁচেক টাকার সংস্থান আমার সীমার বাইরে। তাই চুপ করেই ছিলাম।
মাসের শেষ সপ্তাহে এসে মৌলির মেজাজ একদিন সপ্তমে চড়ে গেল -
- আর কত দিন লাগবে তোমার একটি আলমারি আনতে ? পকেট যদি গড়ের মাঠ করে রেখেছ তাহলে ছোটমামার থেকে ধার নিলেই তো পারো। বেতন পেয়ে দিয়ে দিলেই হলো। আমার আলমারি চাই কালকের মধ্যে। এভাবে আর থাকতে পারবো না। যেভাবেই হোক টাকার জোগাড় করো। একটা আলমারি কেনার টাকাও যদি তোমার হাতে থাকে না তাহলে সংসার করেছিলে কেন ? কী যে চাকরি করো তুমিই জানো।
আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম মৌলির কথা। একটিবার আমার সম্মানের কথা ভাবলো না ? স্বামীর টাকা রোজগারের পথটি কেমন হবে তা নিয়ে স্ত্রীর কি কোনো মাথাব্যথা থাকতেই পারে না ? এ কেমন বোঝাপড়া ? সামান্য একটি আসবাবের জন্য এমন করে বলতে পারলো ? মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেল।
না, আর দমিয়ে রাখা যাবে না মৌলিকে। মৌলির কাছে ছোট হওয়ার চাইতে ছোটমামার কাছে ছোট হওয়াটাই ভালো। তাই সেদিন রাতে ছোটমামার ঘরে গিয়ে টাকা ধার চাইলাম। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম যেন। প্রচণ্ড এক অপমানবোধে ভেঙে পড়ছিলাম ভেতরে ভেতরে। সিক্ত হয়ে উঠেছিল দুই চোখের কোণ। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল শৈশবের সব খণ্ডচিত্র যখন নিত্যদিন বিকেলে কারো কাছ থেকে দু’টাকা চার টাকা ধার করেই বাজার খরচ জোগাড় করতে হতো বাবা, দাদাকে। তখনও নিত্যদিন টাকা ধার দিয়ে সংসারটিকে খেয়ে পরে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছিলেন কিছু উদার ব্যক্তি, যাঁদের কাছে আমার প্রজন্ম অবধি চিরঋণী হয়ে থাকতে হবে। আজও ছোটমামা আমার বলার সাথে সাথেই আমার হাতে তুলে দিলেন নগদ পাঁচ হাজার টাকা।
পরদিন অফিস ছুটির পর মৌলিকে নিয়ে গিয়ে দোকান থেকে কিনে আনা হলো বাঞ্ছিত সেই আলমারি। মৌলির মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি যার মধ্যে লুকিয়েছিল আমার বুকফাটা ব্যথার ছোঁয়া, মানসিক এক বিবমিষা - মৌলির অগোচরে। আমি কি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করে দিতে পারবো ?
আমি মৌলির মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছিলাম অপলক নয়নে। আর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক অনন্য কোলাজ - অন্ধ বুড়িমাসিকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন আমার নিঃস্ব রিক্ত অভুক্ত মা।
অন্ধ বুড়ি। কেউ তাঁর নাম জানতো না। তিনি নিজেও কি জানতেন ? কীজানি ? সবারই তিনি - ‘বুড়িমাসি’।
চওড়া পথটি দু’দিকেই প্রায় সমান দূরত্বে গিয়ে পড়েছে দুই পাকা সড়কে। পাকা বলতে মোরাম বিছানো পথ, ধুলির স্বর্গরাজ্য। সড়ক দু’টি ধরে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দিনে গোটা চারেক বাস্ যাতায়াত করে দূরবর্তী শহরে। সময় হিসেবেই তাদের নামকরণ। ন’টার বাস্, বারোটার বাস্, তিনটার বাস্ কিংবা পাঁচটার বাস্ ইত্যাদি - যদিও নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা পরেই সেগুলো এসে পৌঁছতো। তাতে অবশ্য বিশেষ আপত্তির কিছু ছিল না গ্রামবাসীর। সময়ের এত অভাব তখন ছিল না বলেই হয়তো বা। লোকেদের মুখে প্রায়শঃ প্রশ্ন শোনা যেত - ‘আজ বারোটার বাস্ ক’টায় এল ?’
বুড়িমাসি অন্ধ ছিলেন। এবাড়ি ওবাড়ি টইটই করে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে বারকয়েক তাঁর বাড়িতেও গেছি। সংসারে তাঁর কেউ ছিল না। শুনেছিলাম এককালে সবই তাঁর ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সব হারিয়ে এখন তিনি নিতান্তই একা। তাঁর নাকি ছেলেও আছে বাইরে। সেও খোঁজখবর রাখে না। দুই চোখে দৃষ্টি না থাকলে চলার পথ কতটা কঠিন তখন সেসব বুঝতাম না। আমার চোখে তাঁর অন্ধত্বটাই স্বাভাবিক ছিল। গ্রামের সবাই তাঁকে যতটা সম্ভব সাহায্য করত। তিনিও হাত পেতে তা নিতেন। কখনো কখনো তিনি দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে গ্রামেরই কোনো বাড়িতে স্বনিমন্ত্রিত হয়ে দুপুরের আহার সারতেন। এই হাতে গোনা কিছু পরিবারের মধ্যে আমাদের ঘরটিও ছিল - যদিও আমাদের নিজেদেরই তখন নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। অথচ তাঁর ক্ষেত্রে আমার মা ছিলেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। কোথা থেকে কী করে যে যাহোক কিছু করে তাঁকে খাইয়ে ছাড়তেন তা তিনিই জানতেন। খাওয়াদাওয়ার পদের ব্যাপারে বুড়িমাসির কোন পছন্দ অপছন্দ ছিল না। ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া। যতক্ষণ তিনি থাকতেন ততক্ষণই গল্পগুজবে জড়িয়ে থাকতেন মায়ের সঙ্গে। সাথে পথ দেখিয়ে যে নিয়ে আসতো তারও ভাগ্যে জুটে যেত দুপুরের খাওয়া। অলিখিত অধিকার বটে।
সুতরাং বাস্রাস্তা থেকে ফেরার পথে বুড়িমাসিকে এদিকে আসতে দেখেই দৌড়ে এসে মা’কে খবরটি দিলাম। সেদিন বোধ করি হাঁড়ি চড়ানোর মতো কোনো সুবিধে ছিল না মায়ের হাতে, তাই অন্ধ বুড়িমাসির আগমনবার্তা শুনে মুষড়ে পড়লেন মা। তখন প্রায়ই হাঁড়ি চড়ত না আমাদের ঘরে। যদিও আমি তা টের পেতাম খুব কম। আমার জন্য যাহোক কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যেত। বড়দের দেখেছি প্রায়শ অনাহারে থাকতে কিংবা আটার গোলা সেদ্ধ বা কাঁঠালবিচি সেদ্ধ করে খুব জম্পেশ করে খেতে। তখন বুঝতাম না এসব ছিল বিকল্প আহার।
অগত্যা মা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন গিয়ে সেই পাশের ঘরের জ্যেঠিমার কাছে। এই একটাই ছিল ভরসার স্থল। ফেরাতেন না জ্যেঠিমা। দিনের পর দিন জুগিয়ে গেছেন আকস্মিক আবশ্যকতা। মা হিসেব রাখতেন জ্যেঠিমার থেকে এ যাবৎ মোট ক’কৌটো চাল ধার হলো।
- ও দিদি, অন্ধ বুড়ি নাকি আসছেন। ঘরে চাল নেই এক কৌটোও। তাঁকে কী বলে ফেরাই ?
জ্যেঠিমাও পড়লেন সমস্যার গভীর জালে। অগত্যা উপযুক্ত পরিমাণ চাল, সাথে খানিকটা সবজিও তুলে দিলেন মায়ের হাতে। জ্যেঠিমার দেওয়া চালেই উদরপূর্তি হলো বুড়িমাসি ও তাঁর পথসখা মেয়েটির।
খেতে বসে - ‘ও দিদি, আপনিও বসে পড়ুন’ - বুড়িমাসি মা’কে আহ্বান জানালেন।
- আর বলবেন না, আজ আমার উপোস।
- আজ আবার কীসের ব্রত ?
মা হয়তো মনে মনে বারের হিসেব কষে বললেন - ‘সুমতি’। বা - ‘সঙ্কটা’।
সঙ্কট থেকে তখন বোধ করি এরাই রক্ষা করতেন অসুরক্ষিত মানবমানবীদের। কত ব্রতের যে কথা শুনতাম তখন। মঙ্গলচণ্ডী, সূর্যব্রত, ঝটপট, বিপদনাশিনী ......। তিন চারটি ঘর মিলে একসাথে ব্রত উদ্যাপন হতো। একা একা ব্রতের উপচার জোগানোর মতো ক্ষমতা বোধ করি সবার ছিল না। তাই এই যৌথ ব্যবস্থা। সকাল থেকে উপোস করে দুপুরে ব্রতকথা পাঠ করে বা মুখে মুখে শুনিয়ে এর পর যৌথ আহার।
- ঠিক আছে তবে, বলে খেতে শুরু করলেন বুড়িমাসি। কাছেই বসে মা। কত গল্প, কত কথা।
ছেড়ে আসা দেশের গল্প, নিজের অভাগা জীবনের কষ্টকথা। মাও মাঝে মাঝেই মেলে ধরতেন নিজেকে। যেন কাছের বন্ধু। অন্ধ বুড়িমাসিকে পাশে বসিয়ে খাইয়ে বাসনকোসন ধুয়ে মায়ের মুখে যে এক প্রশান্তি তা আমার চোখ এড়াত না। ছিন্নমূলের নতুন জীবনের বন্ধুর পথ চলার কষ্টকর অভিজ্ঞতার বর্ণনে ভারী হয়ে উঠত বাতাস। তখন এসব কথার এতসব মানে বুঝতাম না।
বিকেলে আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই নিজের ঘরের উদ্দেশে পা বাড়াতেন বুড়িমাসি। শিশুসখার হাতে বাঁ হাত আর ডান হাতে অন্ধের লাঠি।
###
বদলির চাকরির অনেক হ্যাপা। আমি যেখানে ছিলাম, মায়ের শেষ কিছু দিন যেখানে কেটেছে সেখানকার সামাজিক পরিস্থিতি আমাদের পারিবারিক জীবনশৈলীর সাথে খাপ খাচ্ছিল না। একমাত্র মেয়েটি বড় হচ্ছিল। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সেই মুহূর্তে ওখান থেকে বদলিটা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। অন্যথা মেয়েটির এই বেড়ে ওঠার বয়সে সামাজিক, নান্দনিক কোনো শিক্ষার সুযোগই সে পাবে না। এই চিন্তাটি আমরা স্বামী স্ত্রী দু’জনকেই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়ে সেই জায়গাটি থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূর এক জেলা সদরে বদলির আবেদন করলাম এবং যথাসময়ে তা অনুমোদনও পেয়ে গেল। এবার শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ, আবার পাততাড়ি গোটানোর পালা। বদলি বড় সহজ কথা নয়। পুরোনো জায়গাটি একেবারে খালি করে দিয়ে নতুন জায়গায় যথাযথ বাসাবাড়ির সন্ধান করে নতুন সংসার সাজাতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়। কী করে কী করবো ভেবে যখন দিশেহারা অবস্থা তখন মৌলিই নিজে থেকে উপায় বাতলে দিল -
আমার মনে ছিল ছোটমামাদের কথা। কিন্তু যেহেতু আজ অনেকদিন ধরে তেমন কোনও যোগাযোগ নেই, তাছাড়া হাজার হলেও শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয় তাই মুখ ফুটে আর বলিনি কথাটি। মৌলিই যখন পথ দেখিয়ে দিল তখন আর অন্য চিন্তা করে লাভ নেই।
একদিকে অফিসে বদলির আগের যুদ্ধকালীন কাজকর্ম অন্যদিকে মেয়ের স্কুল থেকে বদলির সার্টিফিকেট আনা, গ্যাস কানেকশন, বিদ্যুতের কানেকশন, পুরোনো বাসা মালিকের সঙ্গে কথা বলে হিসেব পত্র করা, ব্যাঙ্কের পাসবুক বদলি ইত্যাদি হাজারো ঝামেলায় বলতে গেলে নাস্তানাবুদ অবস্থা। তখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। ডায়েরি ঘেটে ছোটমামাশ্বশুরের ফোন নম্বর বের করে এক রাতে ডায়াল করলাম। প্রথমেই কথা বলে ভূমিকাটা সেরে নিল মৌলি। এরপর আমিও কথা বললাম। নিঃসন্তান ছোটমামা অসম্ভব রকমের একজন ভালো মানুষ। সহজ, সরল, নিখাদ ভদ্রলোক যাকে বলে। কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে কাজ করেন। তবে তাঁর বদলির চাকরি নয়। তাই রামনগরেই বাড়ি বানিয়ে দু’জনে বসবাস করেন। মামিটিও তাঁর সঙ্গে মানানসই। আমাদের বিয়েতে তাঁদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। অনেকবার যাবার কথা বলেছিলেন যদিও যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি এত দিনেও।
আসলে সেই যে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর ধারা তার রেশ যেন আর কাটতেই চাইছে না আজ এতগুলো বছরেও। অবস্থা পাল্টেছে নির্ঘাত বহুগুণ কিন্তু সেই অবাধ সাচ্ছল্য, খুশিমতো টাকাপয়সা খরচ করার স্বাধীনতা আসেনি সে অর্থে আজও। ছিন্নমূলের বোধ করি দুই প্রজন্মেও চারাগাছ আর মহিরুহ হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। হাত খুলে তাই মনের সব ইচ্ছে আর পূরণ করতে পারি না। এখনো হিসেব কষেই চালাতে হয় সংসার। তার মধ্যে বিয়ে করে আনা স্ত্রীরত্নটি কিংবা নিজের ঔরসজাত সন্তানটির সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দায়ভার যখন নিয়েছি মাথা পেতে সুতরাং এ বিষয়টাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে বৈকি। বোধ করি আমার মতো সব পুরুষেরই এক অবস্থা। যখনই নিজের জন্য সামান্য কিছু একটা করার প্রয়োজনীয়তা এসে দাঁড়ায় তখনই দেখা যায় স্ত্রী কিংবা সন্তানেরও এই মুহূর্তে এমন কিছু দরকার যার মূল্য আমার কাছে ততটা না হলেও ওদের কাছে প্রায় সাংঘাতিক। তখন অনায়াসে নিজের ইচ্ছেটাকে আরো কিছু অনন্ত সময়ের জন্য মুলতুবি করে রাখাটাই বুদ্ধিমানের এবং তৃপ্তির কাজ। ধরা যাক আমার নিত্য ব্যবহারের চামড়ার স্যান্ডেলটির শুকতলা ক্ষয়ে ক্ষয়ে এবং একাধিকবার মুচির হাতে মেরামতি করিয়ে নেওয়ার পর যখন আর কিছুতেই টেনে চলা যাচ্ছে না এবং এবার অনেক সাহস করে একটি স্যান্ডেল কিনেই নেব বলে মনস্থির করেছি ঠিক তখনই দেখা গেল তাদেরও একজোড়া করে স্যান্ডেলের দরকার এবং সেটা এমন হতে হবে যে বাইরেও পরা যায় এবং ঘরেও পরা যায়। এমন অনেক নতুন জুতো নাকি বাজারে বেরিয়েছে। খুব সুবিধের। সবাই এখন এগুলোই পরে, সুতরাং এখনই চাই। অথচ বাইরে এবং ঘরে পরার মতো বেশ কয়েক জোড়া স্যান্ডেল তাদের আছে। আমার কিন্তু সাকুল্যে একটি। সেদিকে কারো নজর বড় একটা পড়ে না। অগত্যা বাজারে গিয়ে নিজেদের পছন্দের স্যান্ডেল জুতো এবং সাথে হঠাৎ করে নজরে পড়া খুব সুন্দর এবং লেটেস্ট ডিজাইনের একটি করে বাড়তি স্যান্ডেলও পছন্দ হয়ে গেল। সবার সামনে সরাসরি কিছু বললে সেটা শোভন হয় না। একমাত্র সন্তান কিংবা একমাত্র স্ত্রী বলে কথা। অন্যথা হলে আমার ভেতরের দয়ামায়ার উপস্থিতি সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়বে উপস্থিত সবাই। সুতরাং মনের আনন্দে দু’জোড়া করে স্যান্ডেল নিয়ে এবং শহুরে কায়দায় ফাউ হিসেবে দশটাকার স্ন্যাক্স্ পঞ্চাশ টাকায় খেয়ে বাড়ি ফেরা। নিট ফল আমার নতুন জুতো কেনার পরিকল্পনা বেশ ক’দিনের জন্য আবারো মুলতুবি হয়ে যাওয়া। ভেতরে ভেতরে একটা দুঃখ রয়ে যায় তাই সব সময়। তবু তাদের মুখে তৃপ্তির এই হাসিটুকুতেই যেন বেঁচে থাকা। ভবিষ্যতটাকে সুরক্ষিত করে রাখার আপ্রাণ কৃচ্ছসাধনই হলো পুরুষের জীবনের ব্রত। কে আর বোঝে সেসব কথা। তবে বলে মাঝেমাঝে - ‘তোমার জন্য এটা ওটা কিনে নাও’। সে কথায় আমি আর তেমন গা করি না, ওরাও ভুলে যায়। এমনি করে করে একাধিক আলমারি আর সুট্কেস ভর্তি হয়ে গেছে ওদের পুরোনো জামা আর শাড়িতে যার অধিকাংশই আর এখন পরা হয় না। তবু কী যে এক অমোঘ মায়া সেই কাপড়গুলোতে তা আর বলে বুঝানোর নয়। ক’দিন পরে পরেই খুলে রোদে দেয়, দেখে তারিয়ে তারিয়ে। আমি দূর থেকে মুচকি হাসি। ক্বচিৎ কখনো কাজের মাসির ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে অবশ্য।
এত এত মাইনের পরও আমার সঞ্চয়ের ঘর বরাবরই শূন্য। সংসারের খরচের উপরেও বড় ভাইদের সংসারেও কিছু অবদান রাখতে হয়। ছেলেদের এটা ওটা চাই। নতুন বাড়ি, গাড়ির ভীষণ দরকার ওদের। আমার জীবনে মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে ওদের অবদান বিশাল। শেকড়চ্যুত বাবার পক্ষে চার চারটে সন্তানের মুখে ভাত জুগিয়ে মানুষ করার পর আর অবশিষ্ট কিছুই ছিল না, থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে কষ্ট করে নিজেরা পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করে আমাকেও পড়িয়েছে, নান্দনিক শিক্ষা দিয়েছে, বাইরের জগৎটাকে চিনিয়েছে আমার দাদা, দিদিরাই। সুতরাং আমারও কিছু কর্তব্যাকর্তব্য থেকে যায়। সবকিছু সামলেসুমলে এখন এই বদলির ব্যাপারে আবার একগুচ্ছ খরচাপাতির পর পকেট প্রায় ফাঁকাই হয়ে রইল।
ছোটমামা খুব খুশি হলেন আমি রামনগরে বদলি হয়েছি শুনে। সন্তানহীন দম্পতির একটি অন্তত কাছের মানুষকে কাছে পাওয়ার এক আলাদা খুশিও থাকবেই স্বাভাবিক। তাছাড়া ছোটমামারও বয়স হয়েছে। শুনেছি এর মধ্যেই নাকি অবসর নেবেন। এমনিতেও ওরা দু’জনই খুবই আন্তরিক এবং স্নেহবৎসল - সে আমার জানা। সব কিছু গুছিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগদানের উদ্দেশে গাড়িতে উঠে বসলাম অবশেষে। ছোটমামার ঘরে গিয়ে উঠলাম এবং পরদিনই কাজে যোগদান করলাম। ছোটমামি নিজের হাতে রান্না করে আমাকে খাইয়ে খুব খুশি। আবার যেন অনেক দিন পর অন্য রূপে মা’কে খুঁজে পেলাম।
একদিন ছোটমামা নিজে থেকেই বললেন - ‘বিজন, নতুন করে এসে এখানে কাজে যোগ দিয়েছ, অফিসিয়াল ফর্মালিটি শেষ হয়ে বেতন পেতে হয়তো দেরি হবে খানিকটা। তাছাড়া জিনিসপত্র নিয়ে আসার খরচও আছে। তোমার টাকাপয়সার দরকার হলে বলো আমাকে। সংকোচ করো না।’ আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম তাঁর কথায়।
ছোটমামার সঙ্গে গিয়ে নতুন বাসা দেখে ঠিকঠাক করে এলাম। প্রায় দিন দশেক এভাবেই ছোটমামার ঘরে থেকে অফিস করলাম। এরপর ছুটি নিয়ে পুরোনো জায়গায় ফিরে এসে একদিন সবাইকে নিয়ে আবার চলে এলাম রামনগর। পকেটকে যথাসম্ভব হিসেব কষে কষে সামলে রাখলাম। তথাপি নতুন আস্তানা গড়তে কিছু আবশ্যক খরচ তো থাকেই। তবে নতুন জায়গায় বেতন পেতে কিছু দেরি হতেই পারে অফিসিয়াল নিয়মকানুন মেনে সব কিছু ঠিকঠাক করতে। সে আমার জানা ছিল বলে খুব সমঝে চলছি একেকটা দিন। যদিও আবশ্যক জিনিসপত্রগুলোকে তো আর বাদ দেওয়া যায় না। এর মধ্যে মৌলি একদিন বলেই ফেলল -
মাসের শেষ সপ্তাহে এসে মৌলির মেজাজ একদিন সপ্তমে চড়ে গেল -
আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম মৌলির কথা। একটিবার আমার সম্মানের কথা ভাবলো না ? স্বামীর টাকা রোজগারের পথটি কেমন হবে তা নিয়ে স্ত্রীর কি কোনো মাথাব্যথা থাকতেই পারে না ? এ কেমন বোঝাপড়া ? সামান্য একটি আসবাবের জন্য এমন করে বলতে পারলো ? মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেল।
না, আর দমিয়ে রাখা যাবে না মৌলিকে। মৌলির কাছে ছোট হওয়ার চাইতে ছোটমামার কাছে ছোট হওয়াটাই ভালো। তাই সেদিন রাতে ছোটমামার ঘরে গিয়ে টাকা ধার চাইলাম। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম যেন। প্রচণ্ড এক অপমানবোধে ভেঙে পড়ছিলাম ভেতরে ভেতরে। সিক্ত হয়ে উঠেছিল দুই চোখের কোণ। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল শৈশবের সব খণ্ডচিত্র যখন নিত্যদিন বিকেলে কারো কাছ থেকে দু’টাকা চার টাকা ধার করেই বাজার খরচ জোগাড় করতে হতো বাবা, দাদাকে। তখনও নিত্যদিন টাকা ধার দিয়ে সংসারটিকে খেয়ে পরে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছিলেন কিছু উদার ব্যক্তি, যাঁদের কাছে আমার প্রজন্ম অবধি চিরঋণী হয়ে থাকতে হবে। আজও ছোটমামা আমার বলার সাথে সাথেই আমার হাতে তুলে দিলেন নগদ পাঁচ হাজার টাকা।
পরদিন অফিস ছুটির পর মৌলিকে নিয়ে গিয়ে দোকান থেকে কিনে আনা হলো বাঞ্ছিত সেই আলমারি। মৌলির মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি যার মধ্যে লুকিয়েছিল আমার বুকফাটা ব্যথার ছোঁয়া, মানসিক এক বিবমিষা - মৌলির অগোচরে। আমি কি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করে দিতে পারবো ?
Comments
Post a Comment