“বেলাভূমি
মিলনক্ষেত্র যেন শান্তিনীড়, চিরবিদায়ের আগে এখানে ভূমিকন্যারা শেষ প্রণাম রেখে
যায়” - স্মৃতি পাত্র।
বৃদ্ধ
এবং স্বভাবতই বৃদ্ধাশ্রম শব্দতে আজকাল এক মৃদু আপত্তির সুর শোনা যায়। সেক্ষেত্রে
বৃদ্ধাবাস কিংবা বৃদ্ধাশ্রমের জায়গায় এই ’মিলনক্ষেত্র’ শব্দটি পরিবেশ, পরিস্থিতির
সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। তাই করিমগঞ্জ শহরের সুকল্প ভট্টাচার্য মেমোরিয়েল ওল্ড এজ
হোম ‘বেলাভূমি’ প্রকৃতার্থেই এক মিলনক্ষেত্র। পরিচালনায় বরিষ্ঠ নাগরিকদের কল্যাণে
নিয়োজিত সংস্থা - ‘সেবা’। এবং তাঁদেরই প্রচেষ্টায় নিয়মিত প্রকাশিত ছোট পত্রিকা
‘সেবা’। নামেই ‘ছোট’। আয়তনে কিংবা সম্ভারে তা নয় মোটেও। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে
‘সেবা’ পত্রিকার চতুর্দশ বর্ষ, ২৭/২৮ - অক্টোবর ২০২২ যুগ্ম সংখ্যা। ১লা অক্টোবর দিনটি
বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব বরিষ্ঠ নাগরিক দিবস হিসেবে। এবং
‘সেবা’ পত্রিকাটিও ‘বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি নিবেদিত’ একটি
পত্রিকা। যার প্রতিটি বিষয়বস্তু এই সুরেই থাকে বাঁধা। তাই এর প্রকাশকালও যথেষ্ট
প্রাসঙ্গিক। বরাবরের মতোই এবারের সংখ্যার সম্পাদকও কবি, গল্পকার এবং ‘বেলাভূমি’র
তত্ত্বাবধানে থাকা বিশিষ্ট সমাজকর্মী অপর্ণা দেব। উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি ‘সেবা’রই এক
পৃষ্ঠায় মুদ্রিত এবং বিস্তৃত সাহিত্যকর্মের পাঠের ফাঁকেই নজর কাড়ল এই উদ্ধৃতিটি।
উদ্ধৃতির সঙ্গে সাম্য বজায় রেখে পত্রিকার কবিতা বিভাগে রয়েছে ‘মা’কে নিয়ে লিখিত
একাধিক কবিতা। ভূমিকন্যাদের সাথে সাথে ভূমিপুত্রদেরও বিচিত্র জীবনধারা নিয়ে রয়েছে
একাধিক গল্প কবিতা।
A4 সাইজের কাগজের ১২৬
পৃষ্ঠার ঢাউস পত্রিকাটি ‘যুগ্ম সংখ্যা’কে
ন্যায্যতা প্রদান করেছে নিঃসন্দেহে। পৃষ্ঠাজোড়া বিশাল সূচিপত্রের পরেই রয়েছে দুই পৃষ্ঠা জোড়া
তিন পর্বের সম্পাদকীয় - ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ নাগরিক দিবস’, ‘বৃদ্ধাবাস বেলাভূমির
তেরো বছরে পদার্পণ’ এবং ‘এবারের সেবা ২৭/২৮ যুগ্ম সংখ্যা’। যথেষ্ট তাৎপর্যময়
সম্পাদকীয়।
এ অঞ্চলের তথা বাংলা সাহিত্য
ভুবনের বহু বিশিষ্ট কবি গল্পকার প্রাবন্ধিকদের লেখা সন্নিবিষ্ট হয়েছে এবারের
সংখ্যায়। বিষয় বৈচিত্র্য তথা বিষয়ের প্রাচুর্য হেতু প্রতিটি রচনার উপর আলাদা করে
টীকা টিপ্পনির সুযোগ এই সীমিত পরিসরে নেই বললেই চলে। প্রথমেই প্রবন্ধ নিবন্ধ
বিভাগ। ‘মহাপ্রাণ মহীতোষ - চির উন্নত মম শির’ শিরোনামে প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন
কুমার অজিত দত্ত। শিরোনামেই বিষয়বস্তুর পরিচয়। আত্মকথামূলক নিবন্ধ ‘আমার
প্রভাত-বেলা’ লিখেছেন তপোধীর ভট্টাচার্য। সুশান্ত কর লিখেছেন নয় পৃষ্ঠা জোড়া
শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবন্ধ - ‘হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর এবং তাঁর শিশুনাটক’। সংক্ষিপ্ত অথচ
মুগ্ধতায় ভরপুর স্মৃতিকথামূলক নিবন্ধ ‘জল’ লিখেছেন মৃন্ময় রায়। জাহিদ রুদ্রের
নিবন্ধ ‘লাতু মালেগড় - ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষী’। চিঠির ধাঁচে মনের কথা
লিখেছেন তীর্থঙ্কর চক্রবর্তী - ‘দুটো মনের কথা কই’। উনিশে মে’র উপর ‘বেলাভূমি’র
তিনজন আবাসিক সুবল চক্রবর্তী, জয়শ্রী ভট্টাচার্য এবং সুদীপা দাস-এর সঙ্গে
স্মৃতিকথামূলক আলাপ আলোচনার বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘আলাপচারিতা’ শিরোনামে। অনুলিখন
- সজল পাল। বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি মূল্যবোধ নিয়ে সান্ত্বনা দেব-এর নিবন্ধ ‘নতুন
আরো এক অধ্যায়’। কৃষ্ণধন নাথের নিবন্ধ ‘পাটকাঠির দেশলাই, গর্জন তেলের বাতি ও হুঁকো
সংবাদ’ নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। এক বরিষ্ঠ নাগরিকের আন্তরিকতায় ভরপুর আত্মকথামূলক
নিবন্ধ ‘আমার - আমাদের কথা’। লিখেছেন সঞ্জীব গোঁহাই বরুয়া। অনুবাদ - অপর্ণা দেব।
রূপকধর্মী দু’টি অনবদ্য ছোটগল্প ‘দু-মুখো সাপ ও কোজাগরী’ এবং ‘রাজা ও পূর্ণতা’
লিখেছেন সুকান্ত দে। কবিতার ধাঁচে এক সৈনিকের নিরেট আত্মকথন - ‘আমি কর্ণেল বলছি’ -
লিখেছেন অমল ভট্টাচার্য। ‘বাঁক’ - সুদীপ্তা দে চৌধুরীর একটি ব্যতিক্রমী এবং
প্রয়োজনীয় প্রয়াস। বৃদ্ধাবাসের অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসা একটি চমৎকার আত্মকথামূলক
নিবন্ধ। এ বিভাগের শেষ রচনা কবি চন্দ্রিমা দত্তের ‘বেলাভূমি’ ঘুরে আসার কাব্যিক
উপস্থাপনা - ‘বেলাভূমিতে কিছুটা সময় কোনও একদিন’।
কবিতা বিভাগ সেজে উঠেছে যাঁদের
কবিতায় তাঁরা হলেন - কালীকৃষ্ণ গুহ, বিজয় ঘোষ, সুদীপ ভট্টাচার্য, নিরুপম শর্মা
চৌধুরী, তন্দ্রিকা চক্রবর্তী, অশোককুমার ঠাকুর, স্নিগ্ধা নাথ, অজিত কুমার সিনহা,
স্মৃতি দত্ত, শুভ্রা গাঙ্গুলী ভট্টাচার্য, সুপ্রদীপ দত্তরায় এবং করুণা কান্তি দাস।
ব্যতিক্রমী সূচি। অধিকাংশ কবিতাই ‘মা’কে নিয়ে - স্বাভাবিক ছন্দেই কখনও ‘বাবা’রাও
এসে দাঁড়িয়েছেন কিছু কবিতায়।
চার চারটি ভ্রমণ কাহিনিতে সমৃদ্ধ
এবারের সংখ্যা ‘সেবা’। শিবানী ভট্টাচার্য দে’র ‘প্যাংগং দর্শন’, আশু পাল-এর ‘ডং’,
অলক দত্তের ‘হারিয়ে গেল - গোয়ালন্দ ফেরীঘাট, গঙ্গা নদী আর তার ইলিশ মাছের গল্প’
এবং স্বপ্না ভট্টাচার্যের ‘জীবনানন্দের দেশে’। প্রতিটি রচনাই লিখনশৈলীতে, বর্ণনায়,
নস্টালজিয়ায় আকর্ষণীয়। সুখপাঠ্য। তবে আশু পাল-এর লিখন ভঙ্গি ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে
পাঠকের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতার ধাঁচে লিখা বলে।
আছে দশটি ছোটগল্প। লিখেছেন সজল
পাল, মিথিলেশ ভট্টাচার্য, জয়তী রায় মুনিয়া, বসন্ত দাস (অনুবাদ করেছেন তপন মহন্ত),
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, বিমলেন্দু চক্রবর্তী, আদিমা মজুমদার, সৌম্যদীপ দেব, শিবানী
শর্মা ও তুষারকান্তি সাহা। মুনিয়া, সৌম্যদীপ এবং তুষারকান্তির গল্প পাঠক মনে দাগ
রাখতে বাধ্য। আলোচনার শুরুতে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটির সঙ্গে অসাধারণ এক যাযুজ্য লক্ষ
করা যায় তুষার কান্তি সাহার গল্প ‘মালতীবালা’র।
পরিশেষে রয়েছে মোট চারটি
গ্রন্থ/পত্রিকার আলোচনা/পাঠ প্রতিক্রিয়া - অপর্ণা দেব-এর গল্প সংকলন ‘বয়সের
ফরওয়ার্ড মার্চ’ এর উপর সদ্য প্রয়াত প্রশান্ত কুমার পাল এবং ‘সেবা’র পূর্ববর্তী
সংখ্যার উপর বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য ও সঞ্জয় গুপ্তের লিখা।
সম্পাদক মণ্ডলীতে রয়েছেন
প্রবালকান্তি সেন, অনুপ কুমার বণিক ও বনানী চৌধুরী। ভেতরের পৃষ্ঠাসমূহে ‘বেলাভূমি’
সম্পর্কিত ছবি পত্রিকাটিকে করে তুলেছে অধিক অর্থবহ যার রেশ রয়ে গেছে রঙিন শেষ
প্রচ্ছদে। আন্তর্জাল থেকে নেওয়া প্রচ্ছদটিও খুবই প্রাসঙ্গিক। বলতেই হয় সব মিলিয়ে
এক বিশাল এবং রুচিশীল আয়োজন। বানানের শুদ্ধতার ব্যাপারটিও উল্লেখ করতেই হয়। তবে
পত্রিকার আকার নিয়ে কিছু চিন্তা চর্চার প্রয়োজন রয়েছে বইকী - পাঠকের স্বচ্ছন্দ
পাঠের কথা মাথায় রেখে।
-- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
সম্পাদক - অপর্ণা দেব
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫৫৯৬৭২০
Comments
Post a Comment