Skip to main content

প্রভাতি সূর্য

ভোরের স্বপ্ন অনেকেই বলেন এ স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় অনেকটাই ছোট থাকতে শিশিরবাবুও কথাটি শুনেছিলেন মায়ের মুখ থেকে তখনকার দিনকাল এবং বয়েসের হিসেবে মা-বাবার কথার সত্য-মিথ্যার যাচাই হতো না তাঁদের কথা সদাই ছিল চন্দ্র সূর্যের মতো সত্য এখন দিনকাল পাল্টেছে ওই বয়সের বাচ্চারা আজকাল নিজে যাচাই না করে কারো কথা বিশ্বাস করে না বন্ধু এবং গুগলের রায় পাওয়ার পরেই কথাগুলো এখন ধোপে টেকে…. কিংবা টেকে না এই অধঃপতন নিজের চোখে দেখাটা বড়ই বিরক্তিকর সে অর্থে শিশিরবাবুর নিঃসন্তান থাকাটা এই বিড়ম্বনার হাত থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে অবধারিত বছর দশেক হল অবসর নিয়েছেন শিশিরবাবু অসুস্থ স্ত্রীর বাইরে সংসারে তাই একমাত্র নীরবতাই শিশিরবাবুর নিত্যসঙ্গী
শিশিরবাবু অবসর নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই স্ত্রী মলিনাদেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে সেই যে বিছানা নিলেন - আজ এতগুলো বছরেও আর স্বাভাবিক হতে পারলেন না শিশিরবাবুর সংসারধর্ম তাই মোটামুটি একই ধারায় চলমান হয়ে রইল আগে যেখানে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকতে হতো দিনের বেশির ভাগ সময়, এখন সংসার সামলাতেও সেই আগেরই মতো তাঁর ব্যস্ততা অর্ধেকটা দিন চলে যায় স্ত্রীর সেবা শুশ্রূষায় বাকি সময়টুকু বাজার হাট সেরে রান্নাবান্নার দায়িত্ব সামলে কোন দিকে চলে যায় বোঝাই যায় না সন্ধের পর সামনের রাস্তার পাশে অখিলের চায়ের দোকানে স্বল্পকালীন আড্ডা আর বইপত্র পড়েই দিন কাবার বই পড়ার নেশা শিশিরবাবুর বহু পুরোনো বলতে গেলে এই নেশাতেই তাঁর দিনযাপন সব কাজকর্ম সেরে কখন একটা বই হাতে নেবেন সেই আশাতেই তরতরিয়ে চলে যায় দিন
আজকাল খুব কষ্টে কিছু সময় উঠে চলাফেরা করতে পারেন মলিনা শিশিরবাবুর কাছে এ এক চ্যালেঞ্জ বটে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট অনেকদিন থেকে নিয়মিত এক্সারসাইজ করিয়ে যাচ্ছেন মলিনাদেবীকে এখন কিছুটা ফল পাওয়া যাচ্ছে তার ঘরের কাজের মেয়ে পার্ট টাইম কাজ করে চলে যায় সকাল এগারোটার মধ্যেই কাল রাতেই কথাটি বলেছিলেন মলিনাদেবী -
- কাল আমি রান্না করব
চমকে উঠেছিলেন শিশিরবাবু মলিনা যে এতদিনে এমন সাহসটি করতে পেরেছেন, মনের দিক থেকে যে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন এটাই শিশিরবাবুর কাছে ছিল এক প্রত্যাহ্বান একাধারে তাই খুশি আর কষ্ট এসে শিশিরবাবুর চোখদুটোকে ঝাপসা করে দিতে উদ্যত হল জিজ্ঞেস করলেন -
- পারবে ?
- হ্যাঁ, পারব বলেই তো বলছি তবে তোমাকে কিছু সাহায্য করতে হবে শাক সবজিগুলো কেটেকুটে দিও আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্নাটাই করব আজ কতদিন হল নিজের রান্না খাচ্ছ
মলিনাদেবীকে আর কথা বলতে না দিয়ে শিশিরবাবু বলে উঠলেন -
- ঠিক আছে, ঠিক আছে সেটাই হবে
সেই থেকে মনে মনে উত্তেজিত শিশিরবাবু অনেক অনেক দিন পর আবার মলিনার হাতের রান্না খেতে পারবেন এই আনন্দে প্রহর গুনতে শুরু করে দিয়েছেন কী চমৎকার রান্না করত মলিনা সেইসব দিনগুলির কথা ভাবলেও এক অন্যরকম সুখ এসে ধরা দেয় অন্তরে মলিনার রান্নায় শিশিরবাবু যেন ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মুখ ফুটে হয়ত বলা হয়নি কোনোদিন তবে তারিফ করতে কসুর করেননি 
আনন্দে, উত্তেজনায় রাতে শিশিরবাবুর ঘুমও হয়নি ঠিক মতো শেষ রাতে ঘুমে জড়িয়ে ধরেছিল দুচোখ ভোরের দিকে এল সেই স্বপ্ন
যে কোম্পানিতে কাজ করতেন শিশিরবাবু তার কাজ ছিল দূরসঞ্চারের যোগাযোগ টাওয়ার বসানো ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং পরিসেবা প্রদান টাওয়ার বসানোর কাজটি বেশ কিছুদিন ধরে চলত এবং এ অঞ্চলে এই পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্বে ছিলেন শিশিরবাবু একাধারে সাইট ও অফিস দুটোই সামলাতে হতো তাকে প্রথমেই কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট জায়গাটি নির্বাচন করে অ্যাপ্রোভাল এসে গেলে শুরু হতো মাটি কাটার কাজ যেহেতু টাওয়ারগুলোর ভিত অনেকটাই শক্তপোক্ত হওয়া প্রয়োজন তাই বিশাল একটি গর্ত করে বসাতে হতো টাওয়ারের ভিত এই মাটি কাটতেই লেগে যেত বেশ কিছু দিন তখন আজকের মতো মাটি কাটার যন্ত্রপাতি উদভাবন হয়নি বা হলেও আসেনি এদিকটায় তাই শ্রমিকরা নিজেদের হাতেই কাটত মাটি একেকটি গর্ত প্রায় দশ ফুট গভীর হতো এবং বিশাল তার আয়তন মই বা সিঁড়ি জাতীয় কিছু একটা না হলে ওঠানামা করা যেত না মই বেয়ে নীচে নেমে গেলে উপরের খোলা আকাশের বাইরে আর কিছুই দেখা যেত না যদি না সেই গভীর খাদের কিনারে এসে কেউ দাঁড়াত কাজের তদারকিতে প্রায়শই সেই গর্তে ওঠানামা করতে হতো শিশিরবাবুকে আজ ভোরে শিশিরবাবু নিজেকে আবিষ্কার করলেন আবার সেই গর্তের মধ্যে উপরে হালকা কালো মেঘের ছোপের বাইরে শুধু এক টুকরো নীলাকাশ তিনি একাই দাঁড়িয়ে আছেন সেই গর্তে এবং অবাক করার মতো ব্যাপার হল যে গর্তের মধ্যে কোনও সিঁড়ি নেই কাঠ কিংবা বাঁশের হাতে-বানানো সিঁড়ি তো দূর এমনকি মাটির ধারে খাঁজ কেটে বানানো কোনো সিঁড়িও নেই চারদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন শিশিরবাবু এখন কী হবে তাঁর ? কেউ কোথাও নেই কারো কথাবার্তার কোনও শব্দও ভেসে আসছে না কানে বুঝতে পারলেন তিনি এই মুহূর্তে নিতান্তই একা এবং অসহায় সময় যত গড়াতে থাকল তাঁর অসহায়তার বহর বাড়তে থাকল এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কে আর এগিয়ে আসবে তাঁকে বাঁচাতে ? মৃত্যুর নিশ্চিত হাতছানি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই তাঁর সামনে ভয়ে ত্রাসে জর্জরিত শিশিরবাবু উপায়ান্তর না পেয়ে চিৎকার করে তাঁকে বাঁচানোর আর্তি জানাতে থাকলেন অথচ তাঁর মনে হল যেন গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না ঠিকমতো প্রাণপণে তাই চিৎকার করতে থাকলেন শিশিরবাবু হঠাৎ শরীরে কারো হাতের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল শিশিরবাবুর চোখ খুলে দেখলেন মলিনা তাঁকে হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে ঘুম ভাঙিয়েছে গলাটা শুকিয়ে এল শিশিরবাবুর উঠে গিয়ে ঢকঢক করে গ্লাস থেকে জল খেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলেন ভয়ংকর স্বপ্নের হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন তিনি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে মলিনাদেবী জিজ্ঞেস করলেন -
- স্বপ্ন দেখেছ ?
- হ্যাঁ - সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন বিধ্বস্ত শিশিরবাবু 
ততক্ষণে ভোরের আবহ কেটে সকালের আলো ফুটে উঠেছে অনেকটাই মলিনাদেবী পাশ ফিরে ঘুমোলেন আবার আর বিছানায় এলেন না শিশিরবাবু তাঁর প্রাণায়াম করার সময়ও সমাগত তাই কিছুক্ষণ সোফায় বসে আত্মমগ্ন হয়ে রইলেন এই ভোরের স্বপ্ন নিয়ে এখন বয়েস হয়েছে শিশিরবাবুর ভোরের স্বপ্ন এর আগেও অনেক দেখেছেন বটে কিন্তু সব স্বপ্ন যে সাকার হয়েছে তা নয় এই ভোরের স্বপ্নও আর পাঁচটা স্বপ্নেরই মতো এত দিনে এটা বুঝে গেছেন শিশিরবাবু তাই এ নিয়ে এত ভাবার দরকার আছে বলে মনে হল না তাঁর এবং ধীরে ধীরে এই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে নতুন করে ফিরে পাওয়া জীবনটাকে উপভোগ করার দিকেই মনোনিবেশ করলেন
আজ যেন তিনি এক নতুন শিশিরবাবু চনমনে, প্রাণোচ্ছল সব কাজেই অন্যান্য দিনের থেকেও বেশি তৎপর দেহে, মনে নতুনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে মশগুল এক তরতাজা যুবক মনে হতে লাগল নিজেকে সকালবেলার নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম সেরে চানটান সেরে এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মলিনাদেবীর দিকে মলিনাদেবী তখনও ঘুমোচ্ছেন সন্তর্পণে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বসলেন শিশিরবাবু তাকালেন মলিনার মুখের দিকে এতটা বয়সেও মলিনার মুখমণ্ডল যেন কোন এক অমলিন প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে আছে শিশিরবাবুর মনে হল প্রতিটি ঘুমন্ত মুখই শিশুর ঘুমন্ত মুখের মতো নিষ্পাপ, নিরেট আস্তে করে মলিনার ঊর্ধ্ববাহুতে নিজের হাতটি রেখে ডাকলেন - মলিনা……
দ্বিতীয়বার ডাকার পরই সাড়া দিলেন মলিনা শিশিরবাবু বললেন -
- উঠবে না ? চা বানাবো ?
- টা বাজে ?
- সাড়ে ছটা দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন শিশিরবাবু
- আজ এতটা সকালে ? - চোখ কচলে উঠে বসতে চাইলেন মলিনাদেবী
শিশিরবাবু দুহাতে ধরে সাহায্য করলেন মলিনাদেবীকে উঠতে বললেন -
- আজ রান্না করবে বলেছিলে না ? আসল ঘটনা চেপে গেলেন শিশিরবাবু
- ওহ্এই আনন্দে ? তা বলে এত তাড়াতাড়ি উঠতে হবে নাকি - মুচকি হাসিটি চেপে রাখতে পারলেন না মলিনাদেবী তাঁর রান্না করার ঘোষণায় যে শিশিরবাবু মনে মনে উত্তেজিত হয়ে আছেন তা ভালোই বুঝতে পারছেন মলিনাদেবী সত্যিই তো, কত দিন হয়ে গেল এভাবে বিছানায় পড়ে পড়ে সময় যাচ্ছে এ কি আর ভালো লাগে ? চোখের সামনে স্বামীকে এত কিছু কাজকর্ম সামলে আবার রোগীর সেবাযত্নেও মনোনিবেশ করতে হচ্ছে কত জন্মের পুণ্যফলে যে শিশিরবাবুর মতো স্বামীরত্নটি তিনি পেয়েছিলেন তা শুধু তিনিই জানেন অথচ এত কিছুর পরেও শিশিরবাবু মুখে সামান্যতম অস্বস্তির ছায়া কোনোদিনই দেখতে পাননি মলিনাদেবী তা বলে নিজেরও তো একটা চিন্তার জগৎ আছে একটি পুরুষ মানুষকে চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে ঘরের পরিসীমায় এক প্রকার বন্দি করে রাখার মতোই তো হচ্ছে এখন স্বামীর প্রতি এ নিশ্চিত এক অন্যায় হচ্ছে এই বোধটি সততই অনুভব করেন মলিনাদেবী কিন্তু তিনি নিরুপায় কিছুই তাঁর হাতে নেই তবু যেন আজকাল একটু হলেও শক্তি ফিরে পেয়েছেন হাতে পায়ে তাই আজ এ কঠিন সিদ্ধান্ত তাঁর মলিনাদেবী এখনও নিশ্চিত নন কতটুকু তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হবে রান্নাটা আদৌ সম্পূর্ণ করতে পারবেন কিনা জানা নেই তাঁর তবু চেষ্টা তো করতেই হবে নিজের জন্য না হলেও শিশিরবাবুর জন্য তো এতটা করা নিতান্তই প্রয়োজন এভাবে আর কত দিন, কত বছর স্বামীর যাবতীয় সুখ আহ্লাদকে পাশ কাটিয়ে শুধুই ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা ? এ তো ঘোর অন্যায় হচ্ছে তাঁর
ধীরে ধীরে বাথরুমের কাজটাজ শেষে স্নান করে সময়ের কিছুটা আগেই রান্নাঘরে এলেন মলিনাদেবী আগে থেকেই সবকিছু হাতের কাছে সাজিয়ে রেখেছেন শিশিরবাবু কাজের মেয়েটিও নিজের কাজ সেরে চলে গেছে খানিকটা আগে কুকিং প্ল্যাটফর্মের কাছেই একটা হাতলওয়ালা চেয়ার পেতে রেখেছেন শিশিরবাবু যাতে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না মলিনাদেবীকে রান্নাঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখে মনে মনে শিশিরবাবুর তারিফ না করে পারলেন না মলিনাদেবী এতটা গোছগাছ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, পারিপাট্য কোনো পুরুষমানুষের থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল আসলে শিশিরবাবু আদতেই এমন একজন মানুষ যিনি নিত্যদিনের চলার পথে কোনও ধরনের অসংলগ্নতাকে সহ্য করতে পারেন না এতটুকু সবকিছু তাঁর হিসেব মতো হওয়া চাই এ নিয়ে প্রথম প্রথম অনেক কথাও হয়েছে মলিনাদেবীর সঙ্গে শিশিরবাবুর এই স্বভাবটির জন্য বলতে গেলে সংসার ধর্মে মলিনাদেবীর অনেকটাই সুবিধে হয়েছে যখন যা চেয়েছেন হাতের কাছে তা পেতে বিলম্ব ঘটেনি কখনও সেই পরিপাটি স্বভাবটি এখনও ষোলোআনা বজায় রেখে চলেছেন শিশিরবাবু
রান্নাঘরে মলিনাদেবী ঢুকে দেখলেন শিশিরবাবু আগেই এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর অপেক্ষায় স্বামীর দিকে তাকিয়ে তিনি এবার নির্দেশ জারি করলেন -
- এখানে তোমার থাকা চলবে না
- কেন ?
- না, তুমি পাশের রুমে বসে আরামে টিভি দেখো কিছু দরকার হলে আমি ডাকব
শিশিরবাবু বুঝতে পারলেন মলিনাদেবী নিরপেক্ষভাবে নিজের কাজ করতে চাইছেন পরমুখাপেক্ষী হয়ে নয় অন্তত দীর্ঘ বিরতির পর আজকের এই রান্নাপর্বে তাঁর অন্তরে ব্যথা দিতে চাইলেন না শিশিরবাবু এমনটাই তো হওয়া উচিত এমনটাই তো হয়েছিল অথচ আজ এতগুলো বছর ধরে এভাবে শয্যাশায়ী থাকার তো কোনও কথাই ছিল না তবু কী যে হয়ে গেল জীবন যে কখন কোন খাতে বয় কে আর তার আগাম খবর পায় ? শিশিরবাবুর আপ্রাণ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সবকিছু কি আর আগের মতো নিখুঁত হয়ে চলছে ? মোটেও তা নয় শিশিরবাবু তা জানেন কিন্তু মলিনাদেবী এতটুকুতেই তৃপ্ত
মলিনাদেবীকে সাহস জোগাতে, তাঁকে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে আত্মনিয়োগ করে দেবার সুযোগ করে দিতে শিশিরবাবু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পাশের কোঠায় দরজার সামনের সোফাতে বসে খুব কম ভল্যুমে টিভিটা চালিয়ে দিলেন চোখ টিভির দিকে থাকলেও একটা কান পেতে রইলেন যেন রান্নাঘরের দিকে সামান্য কিছু শব্দ পেয়েই বেশ কবার উঠে চোখ রেখেছেন মলিনার অজানিতে একটা সময় শেষ হল রান্না মলিনার ডাকে শিশিরবাবু ভেতরে এসে মলিনাদেবীকে ছুটি দিলেন রান্নাঘর থেকে ধীরে ধীরে নিজের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন মলিনাদেবী তখনও খাওয়ার সময় হয়নি তবু মলিনাদেবী বললেন -
- তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাব
শিশিরবাবুর ইচ্ছে ছিল একসাথে খাবার কিন্তু এতে কিছুটা অসুবিধেও আছে এক্ষেত্রে মলিনাদেবীর খাওয়ার তদারকি করা সম্ভব হবে না তঁর পক্ষে অথচ রোজ বলতে গেলে নিজের হাতে করেই স্ত্রীকে খাবার খাইয়ে দেন শিশিরবাবু তাছাড়া এত দিন পর এতটা ধকল সেরে মলিনার কিছু সময় অন্তত বিশ্রামেরও প্রয়োজন তাই মলিনাদেবীর কথায় আর দ্বিরুক্তি না করে খানিক বাদেই খেতে বসে গেলেন শিশিরবাবু
শিশিরবাবুর খাওয়া শেষ হতে হতে মলিনাদেবীরও বিশ্রাম হয়ে গেল শিশিরবাবু খাবার খেয়ে হাত ধুতে না ধুতেই মলিনাদেবী নিজে থেকেই ধীরে ধীরে চলতে চলতে এসে গেলেন রান্নাঘরের লাগোয়া খাবারের জায়গায় তাঁকে দেখে একটু যেন হকচকিয়ে গেলেন শিশিরবাবু জিজ্ঞেস করলেন এখনই খাবে ?
- হ্যাঁ তুমি একটু বেড়ে দাও না
- হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো দেবই কিন্তু
- কিন্তু কী ? - জিজ্ঞেস করলেন মলিনাদেবী
- না কিছু নয় এমনি মানেঠিক আছে তুমি বসো আমি দিচ্ছি আমিই নাহয় খাইয়ে দিতাম এতটা ধকল গেছে আজ হঠাৎ করে
- তাই তো চলে এলাম খেতে খানিকটা বিশ্রাম তো হল এবার খাওয়াপর্ব শেষ করে বেশি সময় ধরে বিশ্রাম করতে পারব - বলে বসে পড়লেন মলিনাদেবী
শিশিরবাবু ভাত তরকারি এনে রাখলেন তাঁর সামনে এতক্ষণ শিশিরবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছিলেন মলিনাদেবী এবার খেতে শুরু করলেন দ্বিতীয় গ্রাসটি মুখে নিয়েই চোখ তুলে শিশিরবাবুর দিকে তাকালেন দেখতে পেলেন শিশিরবাবু নুনের ভাণ্ডটি হাতে করে দাঁড়িয়ে আছেন
- বলোনি কেন তরকারিতে যে নুন দিইনি ? - অভিযোগের সুরে জানতে চাইলেন মলিনা
- দাওনি ? - পালটা প্রশ্ন শিশিরবাবুর
- ঢং করো না এই যে দিব্যি নুনের পাত্র হাতে করে দাঁড়িয়ে আছ জগন্নাথ স্বামীর মতো ?
এবার মুখ খুললেন জগন্নাথ -
- তরকারিতে নুন দাওনি এটা তো আজ বড় কথা নয় মলিনা আজ যে আমার নবজীবন আমি আজ খাদের নিচ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি মলিনা ভোরের ভয়ংকর স্বপ্নকে মিথ্যে করে দিয়ে তোমার এই উত্তরণ - এ তো আমার নতুন করে বাঁচার মতোই ঘটনা
- ভোরের স্বপ্ন ? - কিছুই বুঝতে পারছেন না মলিনাদেবী
এবার শিশিরবাবু সব খুলে বললেন মলিনাদেবী যে নিজেরই অজান্তে আজ এতটা সক্রিয় থেকে তাঁকে ভয়ানক স্বপ্নের হাত থেকে উত্তরণের পথে নিয়ে এলেন এই সুখে এই মুহূর্তে শিশিরবাবুর মনে হচ্ছে যেন আজকের প্রভাতি সূর্য তাঁর জন্য নিয়ে এসেছে এক অনাবিল নবজীবন

Comments

  1. গল্পের শেষটায় নামকরণের সার্থকতা দারণ ফুটে এসেছে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়