Skip to main content

মৌন বিষাদে ছিটিয়ে দিই এক আঁজলা রোদ্দুর…


পার্থিব জীবনধারণে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কই সম্ভবত একমাত্র সম্পদ যা মানুষকে বেঁধে রাখে এমন এক অদৃশ্য বন্ধনে যেখান থেকে সৃষ্টি হয় বেঁচে থাকার তাগিদ, খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের অর্থ অন্যথা জীবন হয়ে উঠত নিতান্তই এক অনর্থ সম্পর্ক কি আবশ্যিকভাবেই বেঁধে রাখে কোনও দৃশ্য বা অদৃশ্য সুতো ? হয়তো রাখে, তবু হয়তো রাখে না এই দোলাচলের নির্মোহ বিশ্লেষণ একজন কবির চেয়ে ভালো আর কে-ই বা করতে পারেন ?
কবি বিশ্বজিত নাগ তাঁরবিনি সুতোর সম্পর্ককাব্যগ্রন্থে প্রথম থেকে শেষ অবধি ব্রতী হয়েছেন এমনই এক তত্ত্বতলাশে জীবনচর্চায় সম্পর্কের আগাপাশতলা লিপিবদ্ধ করেছেন শব্দের মোহময়তায় চলার পথে আহৃত অভিজ্ঞতার সূত্রে কবি তাঁর হৃদয় দিয়ে যা কিছু অনুধাবন করেছেন, ঋদ্ধ জীবনপথের শেষার্ধে এসে পাখির চোখ করেছেন বিচিত্র সব সম্পর্ক আর সম্পর্কের অমোঘ, অনর্নিহিত গরজকে তাই তিনি লিখেন -
বিনিসুতোর সম্পর্কগুলো দীর্ঘ হতে হতে / একসময় মহিরুহ হয় অজান্তেই ……
সম্পর্কের সূত্রকে তাই স্তবক জুড়ে ধরে রাখতে উৎসাহী কবি -
এসো বৃক্ষ হই, সাজাই বসুন্ধরা / এলোমেলো আবাসিক জীবন ছুঁয়ে উড়ুক বাতাস / বিবর্ণ ইচ্ছের ঝরা পাতাগুলো আলটপকা চুমে চলে মৃত্তিকা / গূঢ় অভিমান পড়ে থাকে এক কোণে / প্রলম্বিত ছায়া মায়ার চাদরে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে……
(প্রথম কবিতা - ‘বিনিসুতোর সম্পর্কথেকে)
কবিতা যত এগিয়েছে ততই দৃঢ় হয়েছে বিশ্লেষণ পড়তে পড়তে একটা সময় মনে হয় সত্যি কী বিচিত্র এই জীবন, এই জীবনধারণ, এই জুড়ে থাকার বন্ধন মনে হয় যেন একটাই কবিতা সারা গ্রন্থ জুড়ে পরবর্তী কবিতাটি যেন পূর্ববর্তী কবিতারই তাত্ত্বিক সম্প্রসারণ অসাধারণ সব পঙ্ক্তি এসে যেন নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণ করছে উপপাদ্য বিষয়ের স্মৃতির সরণি বেয়ে কবি নিজেকে মেলে ধরেছেন নিরাসক্ত নির্মোহে জীবনজোড়া অনুভূতির ভারে আবদ্ধ কবির কবিতার চরণে কোথাও অজান্তেই ভেসে আসছে সায়হ্নের গান কবিতার পর কবিতা জুড়ে এক বেলাশেষের বৃত্তান্ত ফেলে আসা দিনের স্মৃতির পরশে আচ্ছন্ন কবিমন কবি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছেন সব সম্পর্ককে - সূত্র ধরে কিংবা বিনি সুতোর - কবির বয়ানে -
সম্পর্কের টানাপোড়েনে কিছু বাঁধন আলগা হয় আচম্বিতে / ছটফট করে নাড়ি কাটা অনন্ত যন্ত্রণায় / কিছু বন্ধনের পিছুটান রয়ে যায় জীবনের রঙ্গমঞ্চে (কবিতা - পিছুটান)
শব্দসোপানশিরোনামে একটি চমৎকার কবিতায় কবি তাঁর ইচ্ছেটাকে মূর্ত করে তুলেছেন শব্দের সোপান বেয়ে -
যোগাযোগে রয়েছি আমিও / এই অস্থির বেলায়, / সময় ও সম্পর্কের অনিকেত গাণিতিক সূত্র জালে… // … তবে এবার নাহয় তৈরি হোক শব্দ সোপান, / ফল্গুধারা বয়ে চলুক অবিরাম / অন্তর থেকে অন্তরের কোষে / দৃপ্ত হোক সম্পর্কের মুক্তোদানা / ধূসর মনোদ্যানে……
৬৪ পৃষ্ঠার এই ভূমিকাহীন গ্রন্থের মধ্যে ৬০ পৃষ্ঠা জুড়ে লিখা হয়েছে মোট ৬০টি কবিতা প্রতিটি কবিতার শেষ স্তবকটি যেন কেমন এক আভিজাত্যে মোড়া নান্দনিক বোধের কারুকার্য নিজেকে মেলে ধরেছেন যেন এক মায়ার শব্দকুহকে -
কাজলটানা রাতের চোখে ঘুম নেই বহুদিন / চাঁদের এই মায়াবী আলোয় নিজেকে ভাসাই অলীক মোহে / আজীবন ভিড়ের সরণিতে মিশিয়ে দিতে চাই নির্বাক ব্রতকথা / আড়মোড়া ভেঙে নতজানু হই পড়ন্ত বিকেলে (কবিতা - নির্বাসন) কিংবা -
নির্ঘুম রাতে, ধুয়ে যায় স্বপ্ন / ভালোবাসায় মরে, বাঁচে বিরহে / তিলে তিলে দগ্ধে দগ্ধে সয় পোয়াতি সুখ / মোহনায় জন্ম নেয় কালির আঁচড় কেটে / কবিতার একফালি কোজাগরি (কবিতা - কোজাগরি)
আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না একটি কবিতাকেও সব কবিতা একই ঘোর লাগা ছন্দহীন ছন্দে এগিয়ে চলে আপন ধারায় অনুভবের মোড়কে নিরেট অনুভূতিরা শব্দে শব্দে জায়গা করে নেয় কবিতার অবয়বে কবি মূলত গারোপাহাড়ের তাই সম্পর্কের সূত্র ধরে এসেছে কবিতা - ‘গারোপাহাড় এক নস্টালজিয়া
কোলকাতার পৌষালী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির ছাপা, বাঁধাই তথা মুদ্রণ উপযুক্ত মানের যদিও রয়ে গেছে বেশ কিছু বানান ভুল এমনকি কবিতার শিরোনামেও চলে এসেছে ভুল বানান শব্দ ও অক্ষরবিন্যাস যথাযথ কবিতার স্তবকবিন্যাসও সঠিক যদিও কবিতার পঙ্ক্তিশেষে  যতিচিহ্নের ব্যবহার অধিক পরিলক্ষিত হয়েছে কবি তাঁর এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁরমা ও বাবাকে প্রচ্ছদ সাংকেতিক যদিও শিল্পীর নামোল্লেখ নেই সব মিলিয়েবিনি সুতোর সম্পর্কএক নিমগ্ন পাঠের চমকপ্রদ কাব্যগ্রন্থ

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

বিনি সুতোর সম্পর্ক
বিশ্বজিত নাগ
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৯৩২৩৮৭৭৬৩

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়