Skip to main content

ছড়া ও ছবির অনবদ্য সমাহার ‘হিজিবিজি ছবি নড়বড়ে কবি’


বৈচিত্র্য, অবিনবত্ব ও নব নব উদ্ভাবনী চিন্তাধারা নিয়ে শিশু সাহিত্যের আঙিনায় এ অঞ্চলে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সাহিত্যিক প্রাণকৃষ্ণ কর শিশুমনে ছবির আকর্ষণ চিরন্তনখোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালোর যুগ এখন অতিক্রান্ত মাতৃভাষায় পঠনপাঠনই যেখানে স্তিমিত হওয়ার পথে সেখানে ছড়া শেখা, বলা কিংবা শেখানোর প্রচেষ্টা আজকের দিনে নিতান্তই কপোলকল্পিত আশার বাইরে আর কিছুই নয় খোকারা এখন পাড়ার কাউকেই চেনে না। খোকারা ঘুমোতে গেলেও পড়াশোনার একগাদা চাপ মাথায় নিয়েই ঘুমোয়।  
অগত্যা করার কী আছে ? খোকাদের জন্য কি রোবট জীবন সদৃশ গড্ডলিকা প্রবাহের বাইরে বড়োদের দেওয়ার মতো কিছুই নেই ? এ চিন্তা কিংবা চর্চা কাউকেই তেমন করতে দেখা যায় না প্রাণকৃষ্ণ কর করেন আর করেন বলেই তিনি ব্যতিক্রমী, তাঁর চিন্তাচর্চায় নিত্য নতুন কল্পনা এসে ধরা দেয় শিশুমনের উপযোগী সাহিত্য রচনায় তাই তিনি অহোপুরুষার্থ করছেন দীর্ঘ দিন ধরে তারই ফলস্বরূপ তাঁর মননে উঠে এসেছে যে ধারণা সেই ধারণা থেকেই তিনি মনোনিবেশ করেছেন শিশুমনের চিরন্তন আকর্ষণ ছবির মাধ্যমে শিশুপঠনোপযোগী সাহিত্য রচনায়
এই লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রকাশিত হল তাঁর সচিত্র ছড়াগ্রন্থহিজিবিজি ছবি নড়বড়ে কবি গ্রন্থের নামকরণেও বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। ছড়াকার সম্ভবত নিজের অঙ্কন প্রতিভা এবং সাহিত্য মানের উপর ভরসা রাখতে পারেননি। এবং সেই জন্যই গ্রন্থটি ভূমিকাবর্জিত। এও এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিচারকর্তা পাঠক, দর্শক।
কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী দেবতোষ কর গ্রন্থটি নিয়ে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন এভাবে - ‘কবি সাহিত্যিকরা সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন থাকাকালীন কখন যে অঙ্কনচর্চায় জড়িয়ে পড়েন তা তাঁরা নিজেরাও হয়তো জানেন না। তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন পাই নড়বড়ে কবির হিজিবিজি ছবিতে। তাঁর ছড়া ও ছবি - দু’টোই আমাকে আকর্ষণ করে। তাঁর ছবিতে ছড়ার মর্মকথা প্রকাশিত হয়। সেখানে একটা নান্দনিক বিষয় তো আছেই। কিছু কিছু ছবি তো আমার কাছে ব্যতিক্রমীই মনে হয়।
মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো তিনি যা আঁকেন তা সত্যিই অতুলনীয়। অতুলনীয় এইজন্য যে, আর কারো সাথেই এই ছবি-শৈলীর মিল নেই। তিনি একটা আলাদা ঘরানা তৈরি করেছেন। এই ছবি একান্তভাবেই প্রাণকৃষ্ণ করের। হাজার ছবির ভিড়ে একে আলাদাভাবে চিনে নেওয়া সম্ভব। এখানেই তিনি অনন্য।’
এ তো গেল ছবিপর্ব। ডুডল বা ম্যান্ডেলা আর্টের মাধ্যমে ছড়াকার এখানে প্রতিটি ছড়ার সঙ্গে মানানসই ছবি এঁকে কিংবা বলা যায় ছবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত ছড়া লিখে এক অনবদ্য ‘যোগসাজশ’ তৈরি করেছেন। আছে কিছু লাইন স্কেচও। কবি প্রাণকৃষ্ণ নিজেই আঁকেন ছবি। এ কথাটি টাইটেল ভার্সো পেজ-এ উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। চূড়ান্ত নৈপুণ্য তাঁর ছবি আঁকায়।  দুই থেকে চোদ্দ লাইনের ১৩২টি ছড়ার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রাণকৃষ্ণ অসীম ধৈর্য সহকারে এঁকেছেন এক একটি ছবি। শিশুসাহিত্য সম্পর্কে কতটা গরজ পোষণ করলে তৈরি হতে পারে এমন সমাহার তা গ্রন্থপাঠেই যথাযথ অনুধাবন সম্ভব। ছোটোদের নিয়ে ইতিমধ্যেই তিনি লিখেছেন ছ’টি গ্রন্থ। নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ছোটোদের নিয়ে তাঁর ছোটপত্রিকা ‘অবগাহন’। তাঁর এই গরজ, এই নিরলস চর্চা, অধ্যবসায় বাংলা সাহিত্যের এই নিভৃত নিরালায় হয়তো থেকেই যাবে অলক্ষ্যে। কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার নয় নিশ্চিত। কিছু ছড়ার উল্লেখ পাঠকের দরবারে তুলে দিতেই হয় - যদিও ছবি অবিহনে ছড়ার স্বাদ হয়তো পাঠকের রসনায় উপাদেয় হবে না পুরোপুরি। ভেতরের ছবির কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় প্রচ্ছদে। প্রচ্ছদশিল্পীও ছড়াকার নিজেই। এটা ভেবেই প্রচ্ছদের চারটি ছবির সংলগ্ন ছড়া এখানে তুলে দেওয়া হল উপর থেকে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী।
(১)
পান থেকে চুন খসলে
মুখটি করো চুন,
তোমাদের কাণ্ড দেখে
আমি হেসেই খুন।
(২)
পদ্মপাতা আপনভোলা
বাতাসে দোলে,
উঁচু গাছ বহু দূর
তারা মাথা তোলে।
(৩)
হিম্মত আছে কার ?
দিচ্ছি রণহুংকার।
আয়, করি লড়াই
ঘুচিয়ে দেবো বড়াই।
(৪)
বৃষ্টি পড়ে টুপটাপ
মিষ্টি মেয়ে চুপচাপ।
মালদার পালক পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের ছাপাই, বাঁধাই উন্নত মানের। স্টেটমেন্ট সাইজের গ্রন্থটি যথেষ্ট পকেট-ফ্রেন্ডলি। দু’একটির বাইরে নেই কোনও বানান ভুল। মোট ১৩৬ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘যিনি হিজিবিজি ছবি পছন্দ করেন, সেই শিশুসাহিত্যিক আনসার উল হক’-এর হাতে। সব মিলিয়ে শিশুদের পাশাপাশি বড়োদের দরবারেও গ্রন্থটি ব্যতিক্রমী এক নান্দনিক উপহার হিসেবেই জায়গা করে নেবে অনায়াসে - এ কথা বলা যায় হলফ করেই

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

 

হিজিবিজি ছবি নড়বড়ে কবি
প্রাণকৃষ্ণ কর
মূল্য - ১৫৫ টাকা
যোগাযোগ - ৬০০৩৫৪৬৫৫৩

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...