Skip to main content

‘সুদূরের ডাকে’ - অনুভবী পথ চলা


বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ?’ আপন চোখের বাইরে এই পৃথিবীর রং, রূপ, রস, গন্ধ পেতে আপামর মানবজাতি সততই পিয়াসি বাদ যাননি কবিগুরুও - ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি…’ এই রূপের টানে সাধ্য অনুযায়ী ঘুরে বেড়ানোর এবং পর্বশেষেফিরে দেখার মানসে গোটা ভ্রমণপর্বকে লিপিবদ্ধ করার আবহমানকাল ধরে চলে আসা যে প্রয়াস সেই প্রয়াসেই এ যাবৎ সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক কালজয়ী ভ্রমণ সাহিত্য বহু লেখক, পরিব্রাজক শুধু এই ভ্রমণ সাহিত্যের হাত ধরেই সগৌরবে জায়গা করে নিয়েছেন কালজয়ী সাহিত্যের পৃষ্ঠায়, পাঠকের মন মানসে
ভ্রমণ কাছে হোক কিংবা দূরে, স্ব্বল্পকালীন হোক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি, দেখার চোখ আর লিখার হাত পরিপাটি হলেফিরে দেখাটি যে হয়ে উঠে চমৎকারিত্বে ভরপুর তার অজস্র নিদর্শন আমাদের হাতের কাছে সতত মজুদ আমাদের নিজস্ব পারিপার্শ্বেও তার অভাব হবে কেন ? সম্প্রতি এমনই এক ভ্রমণ বিষয়ক রচনার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে যেটি লিখেছেন উজান অসমের বাসিন্দা তথা বিশিষ্ট চিত্রকর ও কবি, প্রাবন্ধিক পার্থসারথি দত্ত। গ্রন্থনাম ‘সুদূরের ডাকে’।
এই গ্রন্থে যেমন রয়েছে ভারতের দূরদূরান্তের কিছু জায়গার ভ্রমণ বৃত্তান্ত তেমনি লেখকের চোখে ধরা পড়েছে একান্ত আপন পরিমণ্ডলেরও কিছু দৃশ্যাবলি। ‘দেখি নাই শুধু চক্ষু মেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশিরবিন্দু...’র সূত্রে ধরা পড়েছে তাঁর ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ও। ৮০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে রয়েছে মোট ২৩টি অধ্যায়। এর মধ্যে বহু রচনাই ইতিপূর্বে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাই লেখকের অনুভবসম্পৃক্ত বয়ান এমনি পথে যেতে যেতে যেভাবে তাঁর প্রাণে উঠেছে সুন্দরকে অনুভব করার জোয়ার সেটাই লিপিবদ্ধ হয়েছে
প্রতিটি লেখাই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের কোথাও বর্ণনায় বর্ণিল তো কোথাও ভ্রমণ পিপাসুর ভূমিকায় তথ্যাদির উল্লেখে গদ্যময় তবে সব রচনায় তথ্যের উল্লেখ নেইদক্ষিণ ভারত ভ্রমণগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় যা ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত বলেই মনে হয় লেখক এখানে অনেকটাই খোলামেলা বিস্তৃত এই রচনায় বিভিন্ন জায়গার পথনির্দেশের পাশাপাশি এসেছে ঐতিহাসিক মূল্যায়নও একইভাবে অন্য লেখাগুলোও এমন বিস্তৃতি পেলে সুবিধে হতো পাঠকের
দক্ষিণ ভারতের এই সামগ্রীক ভ্রমণ কাহিনির বাইরেও আলাদা আলাদা ভাবে রয়েছে মুম্বই তথা চেন্নাই, মহাবলিপুরম, কাঞ্চিপুরমের পথে ভ্রমণের বর্ণনা রয়েছেঅপরূপ অজন্তা, স্বপ্নময় ইলোরা’, ‘পুণ্যভূমি পন্ডিচেরিতে একদিনশিরোনামে একাধিক  অধ্যায় মুম্বই-এর রচনায় শিরোনাম হিসেবে রয়েছেমর্ত্যের স্বর্গ মুম্বইয়ে একদিন এখানে মুম্বইকে কেন মর্ত্যের স্বর্গ বলা হল বোঝা গেল না, যেখানে আমাদের রয়েছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর
এছাড়াও যে অধ্যায়গুলো রয়েছে সেগুলো হল - ‘ঐতিহ্যের মধ্যপ্রদেশ’, ‘পুণ্যভূমি পুরী থেকে ধবলগিরি-খণ্ডগিরির পথে’, ‘সংস্কৃতিনগরী কলকাতার ডাকে’, ‘’দারুণ মজা দার্জিলিঙে’, ‘দেওঘর’, ‘কামদেবতা কামদেব মন্দির’, ‘শান্তিনিকেতন থেকে তারাপীঠ পীঠস্থানে’, ‘দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশে’, ‘রাজকীয় শহর রাজস্থানে’, ‘স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম মন্দির এবং সিড়দি সাইবাবার মন্দিরে’, ‘শৈলশহর শিলঙে’, ‘ঐতিহ্যের শিবসাগর’, ‘গুয়াহাটি’, ‘কোলকাতার কলাবীথিকা, ঐতিহ্যময় ভীমবেটকা’, ‘তিলোত্তমা কলকাতা থকে কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু, মহীশূর ও মায়াময় কেরালাতে
শেষ তিনটি অধ্যায় - ‘কোভিড ১৯ অতিমারিতে কোলকাতার পুজোএকেবারেই একটি ব্যক্তিগত গদ্য হিসেবে লিখা তেমনি বাকি দুটি রচনা - ‘সত্যি ভ্রমণ করলে মন অত্যন্ত প্রফুল্ল হয়ে ওঠেএবংবরাক উপত্যকাও সে অর্থে ভ্রমণ কাহিনি নয়, লেখকের অনুভবসমৃদ্ধ গদ্য হিসেবে লিখা হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে বরাকের পথে হারাঙ্গাজাও, ডিটকছড়া নিয়ে যেখানে চমৎকার কাব্যিক উপস্থাপনা রয়েছে সেখানে অনবধানতায় এসে গেছে পুরীর সমুদ্র নিয়েও তদ্রুপ কবিতা বস্তুতবরাক উপত্যকাশীর্ষক রচনায়শিলচরনিয়ে তিন লাইনের একটি কবিতার বাইরে বরাকের আর কিছুই নেই এই রচনাটি সম্ভবত লেখক ঠিক ভ্রমণ কাহিনি হিসেবে রচনা করেননি আদতেই এই গ্রন্থটি সেভাবে হয়তো উপস্থাপিত হয়নি এখানে লেখক নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সুদূরের ডাকে তাঁর ছুটে চলার পথের অনাবিল অনুভূতিকে সেই অর্থে এও এক ব্যরিক্রমী প্রয়াস পথ চলার সাথে সাথে পাঠকের কাছে নিজেকে মেলে ধরা এবং একই আঙ্গিকে পাঠকও এই গ্রন্থ থেকে তুলে নিতে পারেন পথ চলার আনন্দ
কিছু বানান ভুল হয়ে থেকে গেছে সাতকাহন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মুদ্রণ মাঝারি মানের হলেও বাঁধাই যথাযথ প্রচ্ছদ এঁকেছেন অর্ধেন্দু মণ্ডল লেখক গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁরপ্রয়াত পিতা শিক্ষক, সমাজকর্মী দিলীপ দত্ত এবং জন্মদাত্রী মা গায়ত্রী দত্তের প্রতি সব মিলিয়ে একটি সাধু প্রয়াস বলে গ্রন্থটিকে আখ্যায়িত করে ভবিষ্যতে একে আকর হিসেবে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ কাহিনি লেখকের কাছ থেকে আশা করতেই পারেন পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

সুদূরের ডাকে
পার্থসারথি দত্ত
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২০৯৫৭৯১

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...