কবি সঞ্জয় চক্রবর্তীর ১১তম কবিতার
বই। সাকুল্যে ৩২ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ২৮টি পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে আলোচনায় উঠে আসার মতো চারটি
দীর্ঘ কবিতা। স্বভাবতই সূচিপত্রের জন্য আলাদা একটি পৃষ্ঠা খরচ করার প্রয়োজন হয়নি। পৃষ্ঠার
পর পৃষ্ঠা জুড়ে সব সঞ্জয়সুলভ পঙ্ক্তি। প্রথম কবিতা ‘নীলবধূ’র শ্রীগণেশেই প্রথমে চোখ
রাখা যাক -
সুদূর পল্লীগ্রাম, কুপির আলোয় লিখছেন
নিজের জীবন, বধূ, রাসসুন্দরী। ঝিঁঝিঁর ডাক
ঘিরে রয়েছে তাঁকে, জোনাকিরা জোছনাসুন্দর
চুলে, খেলার মত্ততাকে, করেছে চোখের অঞ্জন।
পুকুরের শান্ত জল, খেতের কোমল ধানচারা, বুকে
নিয়ে শুয়ে আছে জীবনানন্দের গ্রাম। বাঁশরিতে
কার নাম, নীল নবঘন শ্যাম ?
চোখ রাখা যাক এই স্তবকে ব্যবহৃত যতি চিহ্নগুলোর দিকে। এই শব্দের ব্যবহার, এই সমাসবদ্ধ যুগল শব্দের স্থাপনা, এই রূপকল্প, এই যতি চিহ্নের ব্যতিক্রমী সংযোজন - আমাদের কবিতাবিশ্বে এ সবই নিখাদ সঞ্জয়সুলভ। এর কোনও বিকল্প নেই।
সংকলনে সন্নিবিষ্ট চারটি কবিতাই বিষয়ে ভিন্ন যদিও একই মোহাচ্ছন্নতায় গ্রথিত আছে কবিতামালিকা হয়ে। বিষয় ভিন্ন হলেও কিছু অনুভব, কিছু বোধ একত্র হয়ে ছড়িয়ে আছে প্রতিটি কবিতায়। আর সবচাইতে বেশি করে যে অনুভবটি জড়িত হয়ে আছে তা হল মৃত্যু। মৃত্যুর এবং মৃত্যুহীনতার নানা অনুষঙ্গ যেন মায়ার বন্ধনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বইয়ের উৎসর্গেও এমনই আবহ। প্রথম কবিতায় বন্ধু চয়নের মৃত্যু এসেছে অনুষঙ্গ হয়ে। ‘বাড়ি ফিরে দেখি কবিতার বইগুলো কে ওজনদরে বিক্রি করে দিয়েছে...... আমার সমগ্র পৃথিবী ঝাঁকায় নিয়ে ফেরিওয়ালা হারিয়ে গেল অনন্ত কুয়াশায়...’। মৃত্যু মানেই চলে যাওয়া - সব কিছু হারিয়ে। অপরূপ রূপকে এক অনন্ত দুঃখবোধই এই বইয়ের মূল বিষয়।
দ্বিতীয় কবিতা ‘পাথর গড়ায়, গড়াতে
থাকে’। ভিন্ন শিরোনামে বারোটি স্বল্পদৈর্ঘের কবিতার একত্রিত রূপ। ভিন্ন ভিন্ন
অনুভবের একত্রীকরণ। আলাদা করে উৎসর্গ করা হয়েছে মিক জ্যাগার, কিথ রিচার্ডস্,
চার্লি ওয়াটস্ ও রনি উডকে। হারানোর কথাই এসেছে বেশি করে। কত কিছুই তো হারিয়ে যায়
-
রোদের হীরককুচি, কবে আর কোথায়;
স্বপ্নে তোমার শ্বেতবসন, আবছায়া মুখ,
হাত বাড়ালেই পা আমার থমকে দাঁড়ায়
দেশ হারানোর ব্যথায়। (কবিতা - ডাকছি, শুনছ)
তৃতীয় কবিতা ‘অর্ক যখন আই সি ইউতে, আমি তখন মৃত্যু চিনি না’। কবিতাটি ‘অর্ক যখন হাসপাতালে, আমি মৃত্যু চিনি না’ শিরোনামে ‘উজান’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। এখানেও হাসপাতালের অনুষঙ্গে জীবন-মৃত্যুর এক বিচিত্র দোলাচল খুঁজে পাওয়া যায় কবিতার শব্দে শব্দে, স্তবকে স্তবকে। কিছু পঙ্ক্তি হৃদয়ে গেঁথে রয় -
... উঠোন ছাপান অলৌকিক রোদ্দুরে/ ঝরে পড়ছে বিষধারা।/ তুমি মৃত্যু দেখেছ শামসেরদা,/ আমি মৃত্যু দেখব না।/ ...বুকের ভিতর বৃষ্টি নিয়ে রাত জাগি/ ব্লটিং পেপারের সাধ্য কী/ যে শুষে নেবে আস্ত একটি শ্রাবণ......। প্রতিটি স্তবকে শব্দের প্রক্ষেপণে আকুল হয়ে উঠেছে ভাবনা।
চতুর্থ তথা শেষ কবিতা ‘ঘুমোও, দুপুর’। শুরুতেই সেই আকুলতা -
কেমন তন্ময় আলোর দ্যুতি
স্তনবিভাজিকা থেকে উড়ে গেল
নীলকণ্ঠরেখা বরাবর।
শক্ত অসুখের পর
পুড়ছি আমি ঘননীলজলে।
ক্রন্দন তোমার অবুঝ ক্রন্দন
রেখে গেছ পাথরে পাথরে। ......
অসুখ আর চলে যাওয়ার সেই একই ঘোর লাগা অনুভূতি - ‘আমার অসুখ হলে,/ তোমাকে জড়িয়ে ধরে মরে যেতে চাই’ ......। গ্রন্থনামের প্রসঙ্গও এসেছে কবিতায় - ‘যা যার পথে চলে গেছে সেই কবে।/ আমি মানবের চোখের জলে/ নির্মিত এই শুনসান হ্রদের তীরে/ বসে রয়েছি তিনকাল। ...... দুপুর রৌদ্রকে আমি এসব কথা বলি মনে মনে।/ সে বলে, ঘুমোও/...... আমি ক্রমে একটি মৃতদেহের ভিতর ঢুকে পড়ি।/ বৃক্ষরোপণ করি।
আদ্যোপান্ত এক ভাবনাবিধুর অনুভবের ফসল এই কাব্যগ্রন্থ। এর বাইরে রয়েছে গভীর অধ্যয়নসঞ্জাত শব্দাবলির অমোঘ প্রয়োগ। যেন আস্ত এক কবিতাবিশ্বের কবি পথে পথে চলেছেন তাঁর সহযাত্রী কবিদের সাথে সাথে।
গুয়াহাটির উঁই প্রকাশনী থেকে সদ্য প্রকাশিত এই বইয়ের প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন সৃজন চক্রবর্তী। কাগজের মান যথাযথ হলেও ছাপার ছাপ কেন উলটো পৃষ্ঠায় চলে এল তা বোঝা গেল না। আগাপাশতলা আধুনিক বানান, অক্ষর ও শব্দ বিন্যাস যথাযথ যদিও নগণ্য সংখ্যক ভুল বানানও রয়েছে যার থেকে পরিত্রাণ বড় সহজ কথা নয়। সব মিলিয়ে সজ্জায়, ভাবনায় শব্দসম্ভারের নিটোল প্রয়োগে নিভৃতবাসে একপঠনের উপযুক্ত একটি আত্মপরিতৃপ্তির কাব্য সম্ভার এই সংকলন।
সুদূর পল্লীগ্রাম, কুপির আলোয় লিখছেন
নিজের জীবন, বধূ, রাসসুন্দরী। ঝিঁঝিঁর ডাক
ঘিরে রয়েছে তাঁকে, জোনাকিরা জোছনাসুন্দর
চুলে, খেলার মত্ততাকে, করেছে চোখের অঞ্জন।
পুকুরের শান্ত জল, খেতের কোমল ধানচারা, বুকে
নিয়ে শুয়ে আছে জীবনানন্দের গ্রাম। বাঁশরিতে
কার নাম, নীল নবঘন শ্যাম ?
চোখ রাখা যাক এই স্তবকে ব্যবহৃত যতি চিহ্নগুলোর দিকে। এই শব্দের ব্যবহার, এই সমাসবদ্ধ যুগল শব্দের স্থাপনা, এই রূপকল্প, এই যতি চিহ্নের ব্যতিক্রমী সংযোজন - আমাদের কবিতাবিশ্বে এ সবই নিখাদ সঞ্জয়সুলভ। এর কোনও বিকল্প নেই।
সংকলনে সন্নিবিষ্ট চারটি কবিতাই বিষয়ে ভিন্ন যদিও একই মোহাচ্ছন্নতায় গ্রথিত আছে কবিতামালিকা হয়ে। বিষয় ভিন্ন হলেও কিছু অনুভব, কিছু বোধ একত্র হয়ে ছড়িয়ে আছে প্রতিটি কবিতায়। আর সবচাইতে বেশি করে যে অনুভবটি জড়িত হয়ে আছে তা হল মৃত্যু। মৃত্যুর এবং মৃত্যুহীনতার নানা অনুষঙ্গ যেন মায়ার বন্ধনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বইয়ের উৎসর্গেও এমনই আবহ। প্রথম কবিতায় বন্ধু চয়নের মৃত্যু এসেছে অনুষঙ্গ হয়ে। ‘বাড়ি ফিরে দেখি কবিতার বইগুলো কে ওজনদরে বিক্রি করে দিয়েছে...... আমার সমগ্র পৃথিবী ঝাঁকায় নিয়ে ফেরিওয়ালা হারিয়ে গেল অনন্ত কুয়াশায়...’। মৃত্যু মানেই চলে যাওয়া - সব কিছু হারিয়ে। অপরূপ রূপকে এক অনন্ত দুঃখবোধই এই বইয়ের মূল বিষয়।
রোদের হীরককুচি, কবে আর কোথায়;
স্বপ্নে তোমার শ্বেতবসন, আবছায়া মুখ,
হাত বাড়ালেই পা আমার থমকে দাঁড়ায়
দেশ হারানোর ব্যথায়। (কবিতা - ডাকছি, শুনছ)
তৃতীয় কবিতা ‘অর্ক যখন আই সি ইউতে, আমি তখন মৃত্যু চিনি না’। কবিতাটি ‘অর্ক যখন হাসপাতালে, আমি মৃত্যু চিনি না’ শিরোনামে ‘উজান’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। এখানেও হাসপাতালের অনুষঙ্গে জীবন-মৃত্যুর এক বিচিত্র দোলাচল খুঁজে পাওয়া যায় কবিতার শব্দে শব্দে, স্তবকে স্তবকে। কিছু পঙ্ক্তি হৃদয়ে গেঁথে রয় -
... উঠোন ছাপান অলৌকিক রোদ্দুরে/ ঝরে পড়ছে বিষধারা।/ তুমি মৃত্যু দেখেছ শামসেরদা,/ আমি মৃত্যু দেখব না।/ ...বুকের ভিতর বৃষ্টি নিয়ে রাত জাগি/ ব্লটিং পেপারের সাধ্য কী/ যে শুষে নেবে আস্ত একটি শ্রাবণ......। প্রতিটি স্তবকে শব্দের প্রক্ষেপণে আকুল হয়ে উঠেছে ভাবনা।
চতুর্থ তথা শেষ কবিতা ‘ঘুমোও, দুপুর’। শুরুতেই সেই আকুলতা -
কেমন তন্ময় আলোর দ্যুতি
স্তনবিভাজিকা থেকে উড়ে গেল
নীলকণ্ঠরেখা বরাবর।
শক্ত অসুখের পর
পুড়ছি আমি ঘননীলজলে।
ক্রন্দন তোমার অবুঝ ক্রন্দন
রেখে গেছ পাথরে পাথরে। ......
অসুখ আর চলে যাওয়ার সেই একই ঘোর লাগা অনুভূতি - ‘আমার অসুখ হলে,/ তোমাকে জড়িয়ে ধরে মরে যেতে চাই’ ......। গ্রন্থনামের প্রসঙ্গও এসেছে কবিতায় - ‘যা যার পথে চলে গেছে সেই কবে।/ আমি মানবের চোখের জলে/ নির্মিত এই শুনসান হ্রদের তীরে/ বসে রয়েছি তিনকাল। ...... দুপুর রৌদ্রকে আমি এসব কথা বলি মনে মনে।/ সে বলে, ঘুমোও/...... আমি ক্রমে একটি মৃতদেহের ভিতর ঢুকে পড়ি।/ বৃক্ষরোপণ করি।
আদ্যোপান্ত এক ভাবনাবিধুর অনুভবের ফসল এই কাব্যগ্রন্থ। এর বাইরে রয়েছে গভীর অধ্যয়নসঞ্জাত শব্দাবলির অমোঘ প্রয়োগ। যেন আস্ত এক কবিতাবিশ্বের কবি পথে পথে চলেছেন তাঁর সহযাত্রী কবিদের সাথে সাথে।
গুয়াহাটির উঁই প্রকাশনী থেকে সদ্য প্রকাশিত এই বইয়ের প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন সৃজন চক্রবর্তী। কাগজের মান যথাযথ হলেও ছাপার ছাপ কেন উলটো পৃষ্ঠায় চলে এল তা বোঝা গেল না। আগাপাশতলা আধুনিক বানান, অক্ষর ও শব্দ বিন্যাস যথাযথ যদিও নগণ্য সংখ্যক ভুল বানানও রয়েছে যার থেকে পরিত্রাণ বড় সহজ কথা নয়। সব মিলিয়ে সজ্জায়, ভাবনায় শব্দসম্ভারের নিটোল প্রয়োগে নিভৃতবাসে একপঠনের উপযুক্ত একটি আত্মপরিতৃপ্তির কাব্য সম্ভার এই সংকলন।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৬০০১২০৫২২৩
যোগাযোগ - ৬০০১২০৫২২৩
Comments
Post a Comment