Skip to main content

সমকালীন সাহিত্যের সুচয়িত মুখপত্র ‘অনিবার্য’


উৎকর্ষে ভরপুর একটি সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকানামের ট্যাগলাইন হচ্ছে ‘সময় ও সাহিত্যের মুখ’। এবং এই মুখ বা পরিচয়ের যাথার্থ্য জ্ঞাপনে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেননি সম্পাদকদ্বয় তথা সম্পাদনামণ্ডলী। বার্ষিক এই পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ সংখ্যা হাতে এসেছিল বেশ কিছুদিন আগেই। তৃতীয় বর্ষ অর্থাৎ মে ২০২২, বৈশাখ ১৪২৯। প্রকাশিত হয়েছিল ‘কোভিড-উত্তর সংখ্যা’ হিসেবে। স্বভাবতই ভেতরে কোভিডকালীন অনুভবের ছোঁয়া ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত।
প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শেষ পৃষ্ঠা অবধি এক নান্দনিক পাঠযাত্রা। মননশীলতার পরিচায়ক এই সংখ্যাটির বিষয় তথা লেখা চয়নে যথেষ্ট সাবধানতা ও রুচিবোধের পরিচয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বিন্যস্ত সূচিপত্র ধরে এগোলে প্রথমেই সংক্ষিপ্ত ‘সম্পাদকের কথা’য় উঠে এসেছে কিছু স্পষ্টবাক নিবেদন - ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ এলেও। এক দীর্ঘ বদ্ধ সময়কালে মহামারি পেরিয়ে অতিমারির ইতিহাস রচনা করলেও, মানুষের জীবনের মর্যাদাকে বেআব্রু করে লজ্জায় ঢাকা এই শতাব্দীকে হাজারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও, শিল্প তার নিজের পথ নিজেই রচনা করে গেছে। ...... আমরা বিশ্বাস করি ভাষিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চেতনাই উনিশ। যে বোধ নিজের ভাষার প্রতি ঋণী করে আর শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায় সেই সব ভাষার প্রতি যা নিজের নয়। অনিবার্যের প্রকাশ আমাদের উৎসব। আমরা উনিশের উত্তরাধিকারের সহভাগী।’ এই সম্পাদকীয় একাধারে প্রত্যয় ও আত্মপরিচয়ের ধ্বজাবাহী।
‘স্মৃতিলেখন’ পর্যায়ে বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী সদ্যপ্রয়াত নীলোৎপল চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করেছেন তপোধীর ভট্টাচার্য ও রণবীর পুরকায়স্থ। ‘মনন কথা’ বিভাগে দুটি সারগর্ভ নিবন্ধ আছে। ‘গণ-অভ্যুত্থানের কবি বঙ্গবন্ধু’ লিখেছেন তপোধীর ভট্টাচার্য এবং ‘ঔপন্যাসিক শঙ্খ ঘোষ - আরেকরকম বীজের জীবন’ শিরোনামে লিখেছেন শুভময় রায়। ব্যতিক্রমী বিষয়কে চরম নৈপুণ্যে রচনা করেছেন উভয় নিবন্ধকার। তথ্যাদির উল্লেখে পরিসরের উপযোগী দুটি রচনা পাঠক মনে নিশ্চিত উদ্রেক করবে পঠনসুখ। ‘কাব্যকথা’ বিভাগে তিন ভাগে বিন্যস্ত হয়েছে ২২ জন কবির ৩০ টি কবিতা। সুচয়িত এবং সুলিখিত কবিতাগুলি লিখেছেন শংকর চক্রবর্তী, মনোতোষ চক্রবর্তী, মৃণালকান্তি দাশ, স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য, দেবাশিস চন্দ, উদয়ন ভট্টাচার্য, অমিতাভ দেব চৌধুরী, অমিতাভ সেনগুপ্ত, চন্দ্রিমা দত্ত, বিজয় ঘোষ, জিললুর রহমান, তমোজিৎ সাহা, সুকান্ত দে, মেঘমালা দে মোহন্ত, শান্তনু গঙ্গারিডি, সঞ্চয়িতা চৌধুরী, অলকা গোস্বামী, জিতেন্দ্র নাথ, সুশান্ত ভট্টাচার্য, রথীন কর ও এ সংখ্যার অনবদ্য ছিমছাম প্রচ্ছদশিল্পী রাজদীপ পুরী। প্রতিটি কবিতা ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে, ব্যতিক্রমী ভাবনাসঞ্জাত স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর তথা স্বতন্ত্র উল্লেখের যোগ্য। গল্পকথা বিভাগে রয়েছে শেখর দাশ, মৃদুলকান্তি দে, রূপরাজ ভট্টাচার্য, সুনন্দ অধিকারী, তৃণণময় সেন ও শর্মিলী দেব কানুনগোর গল্প। একই কথা এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্লট, বুনোট ও ভাষাশৈলীর শৈল্পিক প্রয়োগে প্রতিটি গল্পই হয়ে উঠেছে সুপাঠ্য ও সুখপাঠ্য। প্রতিটি গল্পই আলাদা করে আলোচনার যোগ্য যদিও পরিসর এ অনুমতি দেয় না।   
‘অন্তরঙ্গ কথা’য় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিশিষ্ট লেখক সুকুমার বাগচির সাক্ষাৎকারভিত্তিক স্মৃতিচারণা ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় - কিছু স্মৃতি’ পত্রিকার মানকে করেছে অধিক উন্নত। শেষপাতে পায়েসের মতো অসমিয়া গল্পকার উদয়াদিত্য ভরালির গল্পের অনুবাদ ‘বিশ্বাসঘাতকের ঠিকানা সন্ধান’ এক কথায় অনবদ্য। অনুবাদ করেছেন অমল মিত্র।
নির্বাচিত কবি-লেখকদের নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের সাহিত্যবিশ্বে বহুল পরিচিত এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বভাবতই লেখার ও পত্রিকার মান হয়েছে উন্নত। সৌজন্যে সম্পাদকমণ্ডলী। সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন সুজাতা চৌধুরী ও নীলাক্ষ চৌধুরী। সহযোগিতায় জন্মেজয় দেব, কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী চক্রবর্তী, রূপরাজ ভট্টাচার্য ও প্রলয় নাগ।
কাগজের মান মানানসই হলেও ছাপার ক্ষেত্রে কিছু অক্ষরের আ-কার দূরে সরে যাওয়ায় সাময়িক ব্যাহত হয়েছে সরল পঠন। তাছাড়া লাইন স্পেসিং-এর ক্রম একই থাকেনি পত্রিকা জুড়ে। আগাগোড়া আধুনিক বানান অনুসরণ করা হলেও অনিবার্য ভবিতব্যের মতো ফাঁক গলে রয়ে গেছে কিছু বিভ্রাট। তবে এসব কিছুই নগণ্য এবং স্বভাবতই পরিহার্য। সার্বিক মূল্যায়নে এক নান্দনিক ও জমজমাট সাহিত্য সম্ভার এ সংখ্যা ‘অনিবার্য’। পাঠশেষে এ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যার সন্ধানে ব্রতী হবেন পাঠকবৃন্দ তা বলা যায় নিশ্চিতভাবেই।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১২৫ টাকা

যোগাযোগ - ৯৮৩০৯১২১০০ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়