Skip to main content

শৈশবের অনন্ত আলোয় কাটানো আশ্চর্য খনন..... 'বোধের উঠোন'



অনন্ত অনুষঙ্গ, ঘাত প্রতিঘাত, দুঃখ ব্যথা, সমাজ সংসার, কল্প-বাস্তব, মুখ ও মুখোশ আর স্বভূমি স্বজনের আজন্ম অনুভব, অনুভূতির সংমিশ্রণে যাবতীয় বোধের কর্ষণক্ষেত্র এই পৃথিবী নামক উঠোনে কবিতার বীজ রোপন করতে পারেন শুধুই একজন কবি। আর এই কবিতাময় উঠোনে সেই প্রতিচ্ছবিই আঁকতে সচেষ্ট হয়েছেন দীর্ঘ দিন ধরে কবিতার অঙ্গনে পদচারণায় স্বচ্ছন্দ কবি মৃদুলা ভট্টাচার্য। 
৯৫ পৃষ্ঠার ‘বোধের উঠোন’ কাব্যগ্রন্থে নয় নয় করে ৮৭ টি কবিতা গ্রন্থিত আছে আপন স্বাতন্ত্র্যে। দু’চার লাইনে আটকে রাখেননি নিজেকে। কবিতা নিয়ে কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা নয়, অবোধ্য বাক্যবন্ধে পাঠককে বিভ্রান্ত করার কোনও অভিপ্রায় নেই। যতটুকু বলার সবটাই বলেছেন প্রাণ খোলে। নানা রূপে, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। কবি বোধের উঠোনে এঁকেছেন যাপিত সময়। শতাব্দীর মোক্ষম ঘটনা করোনা মহামারিকে দেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে, কাব্যিক অনুষঙ্গে। নিয়মের মাঝে অনিয়ম, সভ্যতার মোড়কে কালো ছোপ এসে ধরা দিয়েছে কবি মননে -
দুঃখ-সুখে ডুবে ডুবে শূন্য গোলোক ধাঁধায় দেখি আহত পৃথিবীর বুক
এই বুকে কারা যেন রেখে গেছে সভ্যতার মোড়কে
কিছু কালো কালো ছোপ...। (কবিতা - ডায়েরির পাতা)
কবির বোধের উঠোনে ‘রাতের অন্ধকারে হিসেব কষে দিনের মুখ থুবড়ে পড়া পাতাগুলি...... বিষাদ ঝরে বিস্তৃত চরাচরে শূন্য মাটিতে আড়ালে নাড়ানো হাত অজান্তে আঘাত হানে - অস্থির জীবন বোধ’। তবু কবি লিখেন -
তবুও স্বপ্ন আশায় অনর্গল বাঁকা পথ চলে বোধের উঠোন
পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা নিবিষ্ট মানব মন আশঙ্কায়
খুঁজে নেয় সময়ের বিপাকে থাকা বোধ অবোধ কথালিপি...। (কবিতা - বোধের উঠোন)
স্বভূমি বরাক ভূমি, বরাকের সুখ দুঃখ, বরাক নদীর আত্মলিপি নিয়ে স্বাভিমানী কবির বোধ ফুটে উঠেছে বহু কবিতায়। রয়েছে শহর শিলচর নিয়ে কিছু অমোঘ পঙক্তি -
আমার শহর শিলচর,
তুমি কেমন আছো জানি না
শুধু জেনেছি ফাটলে ফাটলে
ভগ্নাবশেষ প্রলাপ জমে আছে।
... জল জীবন আর জীবনকে 
একই সমীকরণে এনে দিয়েছে যে জল
তা পুনর্জন্ম ঘটিয়ে স্পর্ধার সাগরে মিশেছে ......
আমার শহর শিলচর কী কথা বলে গেল
কানে কানে বেনোজলের তোড়।
জানি না এ জীবনকথা,
অথচ এ জীবন নিয়ে বাঁচি...। (কবিতা - শহর শিলচর)
মৃদুলার কবিতায় বৈচিত্র্য এসে ধরা দেয় আপন বৈভবে। আঙ্গিক হয়ে ওঠে ভিন্নতর। গুচ্ছ অনুভবের স্বতন্ত্র পঙক্তিরা এসে নির্মাণ করে কবিতার অবয়ব। আছে কিছু প্যারাগ্রাফ কবিতা, আছে নিখাদ গদ্য কবিতাও। সব মিলিয়ে কথা ও কাব্যময়তার অনুভবী সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায় গ্রন্থ জুড়ে। ভিন্নতর পাঠক মনে হাজির হয় ভিন্ন অনুভবের সরল সহজ ইঙ্গিত।
একাধিক কবিতায় উঠে আসে কিছু অমোঘ শব্দ, শব্দবন্ধ - সময়, বোধ, উঠোন, করোনা, নির্ঘুম রাতের কড়চা, জীবনবোধ, মিথ্যা-মুখোশ-ছলনার নির্মেদ বয়ান।
এত সব নিয়েই গুয়াহাটির ভিকি পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের কবিতায় কবিতায় কোথাও যেন মিশে গেছে একরাশ অসমাপ্তি, আকুতি। কাব্যসুধা কখনও হার মেনেছে বিষয়ের গভীরতায় আবার কখনও স্বমহিমায় ধরা দিয়েছে নিটোল হয়ে, ‘খোলা ডায়েরির পাতা আর নীরবে পড়ে থাকা খোলা কলমে’। স্বচ্ছ ছাপা, অক্ষর বিন্যাসে বিন্যস্ত পৃষ্ঠাগুলোতে উলটো পৃষ্ঠার ছাপ এসেছে অস্পষ্ট হয়ে। বানানের ক্ষেত্রে অধিক সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে বোধ হয়েছে। ছিমছাম নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অক্ষর বিন্যাসের সৌজন্যে কবি স্বয়ং। কপিরাইটের নামে বিসঙ্গতি আছে বলেও মনে হয়েছে। এর বাইরে আদ্যন্ত এক ‘উঠোন জোড়া বোধ’-এর বৈচিত্র্যময় সংকলন - ‘বোধের উঠোন’। 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮১১৯৩৫৬৯৮

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...