Skip to main content

রহস্যের মায়াজালে প্রেম ‘ক-লৌম-এ ছায়ামানবী’


১২৪ পৃষ্ঠাজোড়া উপন্যাসের কোনও ভূমিকা নেই তবে সেই ঘাটতিটুকু পুষিয়ে দিয়েছে দুটি ব্লার্ব এবং শেষমলাটের বাখান সেই সূত্রেই এগোনো যায় আলোচনার পথে কেমন এই উপন্যাসটি ? প্রশ্নে প্রশ্নেই এর উত্তর আছে প্রথম ব্লার্বে - ‘কে এই ছায়ামানবী ? শেষ পর্যন্ত ঋষির জীবন কোন খাতে বইল ? - আদ্যন্ত প্রেমের উপন্যাস হলেও অন্তঃসলিলা এক রহস্যের মায়াজাল এ কাহিনির প্রাণস্বরূপ ছায়াঘেরা রহস্য, কখনও নির্মল শাশ্বত প্রেম, কখনও দুর্বার শরীরী ফাঁদ, কখনও কোমল ভালোবাসায় ভরে থাকা মুহূর্তকথা, প্রত্যাখ্যান, সমস্যা, মন খারাপের প্রহর, আনন্দঘন বেলা ইত্যাদি সব ছাপিয়ে এক চিরন্তন প্রেমের উপাখ্যান এই উপন্যাস’ - আলোচকের দায় এখানেই সারা হয়ে যায় তবু এগোতে হয় অন্দরে, খননে যদি বেরিয়ে আসে আরোও আরোও মনিমুক্তা এবং আসেও।
দ্বিতীয় ব্লার্বে লেখক পরিচিতি তাঁর লেখালেখির বিস্তৃত ব্যাখ্যা আছে এখানে যদিও যে কথাটির উল্লেখ নেই অথচ থাকা প্রয়োজন - অন্তত উত্তরপূর্বের এই সাহিত্যবিশ্বের প্রত্যেক পাঠকের - তা হল লেখক, ঔপন্যাসিক সুস্মিতা নাথ এই সাহিত্যবিশ্বেরই একজন তাঁর প্রকাশিত লেখালেখির বিষয়ে দ্বিতীয় ব্লার্বে বহু তথ্য থাকলেও প্রকাশিত গ্রন্থাবলির একটি তালিকা থাকলে আরোও ভালো হতো আলোচ্য উপন্যাস - ‘-লৌম-এ ছায়ামানবীকেমন উপন্যাস তা আমাদের জানা হয়ে গেছে এবার দেখা যাক কী আছে উপন্যাসে এখানেও আলোচকের কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদ - ‘বসের মেয়েকে প্রেম নিবেদন করার শাস্তিস্বরূপ কলকাতার ছেলে ঋষির বদলি হয়ে গেল ভিনরাজ্যে। বেপরোয়া প্রেমে পড়ার শুরুর মুহূর্তেই এমন অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়। বাক্স গুছিয়ে চিরপরিচিত শহর ছেড়ে, ঘরের খেয়ে চাকরি-সুখ বিসর্জন দিয়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, কাঙ্ক্ষিত নারীটির সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে যেতে হল প্রান্তিক শহর আইজলে। সেখানে অদ্ভূত ভাবে ওর জীবনে আবির্ভাব ঘটল এক ছায়ামানবীর। হ্যাঁ, ছায়ামানবীই বটে, কারণ সে মানবীর কায়াহীন উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে গেল ঋষির আগামী দু’বছরের প্রবাস জীবন। না চাইতেও সেই অদৃশ্য অস্তিত্বের সঙ্গে ওরপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল ঋষি। স্বজন-বান্ধবহীন শহরটায় নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল সে-ই। কিন্তু সে ছায়ামানবী পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। এমনকী কথা দিয়েও আইজলবাসের শেষ দিনটিতেও দেখা দিল না সেফেরার বিমানে বসে হতাশা ও অভিমানে নিজেকে চরম প্রতারিত মনে হতে লাগল ঋষির। ... কাহিনির শুরু ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই।’
‘শেষ কিংবা শুরু’র এই সন্ধিক্ষণে কাহিনির নটেগাছটি এখানেই মুড়িয়ে দেওয়া যায় যদিও আলোচনার ধারা অবশ্যম্ভাবী হয়ে থাকে চলমান। উপন্যাসের মূল সৌকর্য যদি কিছু থেকে থাকে তা হল ভাষার চমৎকারিত্ব, কাহিনির বুনোট, চরিত্র এবং বিষয়বৈচিত্র্যের অনবদ্য উপস্থাপন। কাহিনি এগিয়েছে পাঠকবান্ধব হয়ে, চাহিদা অনুযায়ী। লেখক একজন নারী হয়েও নায়কপ্রধান এই উপন্যাসে এতটাই সাবলীল, নিরলস এবং স্বচ্ছন্দ যে তারিফযোগ্য তো বটেই বিস্মিতও হতে হয় এটা দেখে যে কোথাও কোনো স্খলন নেই - সে সংলাপই হোক কিংবা চরিত্র চিত্রণ। এখানেই লেখকের মুনশিয়ানা।
আইজল শহরটি উত্তরপূর্বের অপেক্ষাকৃত কম চেনা শহর। সেই পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক নিসর্গের শহরটিকে লেখক যেন ছবির মতো তুলে ধরেছেন পাঠকসমক্ষে। এ দায়মোচন বিশেষ করে উত্তরপূর্বের পাঠকসমাজে সমাদৃত হবে নিঃসন্দেহে। মিজো ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থার এক নিটোল বর্ণনা সমৃদ্ধ করেছে উপন্যাসটিকে। ছায়ামানবী প্রধান উপজীব্য হলেও একাধিক এবং মূলত তিনটি নারীচরিত্র এখানে প্রাধান্য পেয়েছে আপন স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্যে। স্ত্রীয়াশ্চর্যম - কিমাশ্চর্যম !
একাধারে প্রেম ভালোবাসা, রহস্য এবং প্রকৃতি বন্দনার ককটেলে এগোতে থাকা স্বচ্ছন্দ, সরল গতির উপন্যাসটিতে রহস্যের ঘেরাটোপে নায়ক খোদ এবং পাঠক বন্দি হয়ে পড়লেও মনে হয় বিচক্ষণ পাঠক মোট পঁচিশটি অধ্যায়ের মধ্যে পনেরোতম অধ্যায়ের পর রহস্যভেদের সন্ধান পেয়ে থাকতেও পারেন যার জট লেখক খুলেছেন শেষতম অধ্যায়ে। এখানেও কারিকুরি উৎকর্ষের ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছেন লেখক।
শব্দ চয়নে লেখক সততই সতর্ক ও নিপুণ। তবে এক-আধবার হলেও, দক্ষিণ ভারতীয় বসকে বারংবার ‘ইডলিখেকো’ বলে উল্লেখ খানিকটা বিসদৃশ মনে হতে পারে। শুদ্ধ, আধুনিক বানানের ব্যবহার রচনার মান বৃদ্ধি করলেও একাধিক বানান ও ছাপার ভুল কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ করেছে গরিমা। সংলাপে অতিরিক্ত যতিচিহ্নের ব্যবহার এড়ানো যেত। শপিজেন বাংলা, গুজরাট নিবেদিত এই গ্রন্থের ছাপার মান উপন্যাসের মানোপযোগী হয়নি। এবং মুদ্রণ প্রমাদগুলো সম্ভবত সেজন্যই থেকে গেছে লেখকের অগোচরে। তবে এ নিতান্তই ধারণাসাপেক্ষ। সুপর্ণা মজুমদার কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন - ‘যারা ভালোবাসতে জানে’ তাদের।  
সব ছাপিয়ে যে বোধটি উঠে আসে তা হল উপন্যাসের চলন, কাহিনির বিস্তার, চরিত্রসমূহের যথাযথ প্রক্ষেপণএবং এখানেই উপন্যাসের সার্থকতা ও লেখকের নৈপুণ্য। যে নৈপুণ্য প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে রবীন্দ্রকবিতা ও গানের লাইনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে নান্দনিক আঙ্গিকে। অর্থাৎ নিছক কাহিনি নয়, উপন্যাসকে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপনের যে প্রয়াস এখানেই উপন্যাসকারের সুস্থ সুন্দর ভাবনা ও উৎকর্ষবোধ প্রকট হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি প্রশস্ত করেছে সুখপঠনের পথ।
পুনশ্চ - মিজো ভাষার শব্দাবলি ‘ক-লৌম-এ’ কথাটির অর্থ জানতে পাঠককে চলে যেতে হবে উপন্যাসের শেষতম লাইনটি পেরিয়ে, যেখানে তা দেওয়া হয়েছে বন্ধনীবদ্ধ আকারে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২৩০ টাকা
প্রচ্ছদ - প্রদীপ্ত মুখার্জী।

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...