Skip to main content

শব্দবোধের কাব্যময় সংকলন ‘মৃত পাণ্ডুলিপির রাত’


আধুনিক কবিতার কোনও নির্ধারিত ধাঁচ হয় না এখানে থাকে না কোনও ধারাবাহিকতা কিংবা ছকের নিয়ম নীতি প্রতিটি শব্দ এবং পঙ্ক্তির স্বাধীনতা অবাধ আধুনিক কবিতার রসাস্বাদনই শেষ কথা, কোনও অর্থ কিংবা ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া বৃথা শ্রম মাত্র কবি যেমন এই পর্বে স্বাধীনচেতা এবং স্বাধীন চিন্তারও অধিকারী পাঠকও তেমনি ভাবনার গভীরে মিশে গিয়ে বোধের ঘরে প্রবেশ করার অধিকারী এতে কবির সঙ্গে পাঠকের একাত্ম হয়ে যাওয়ার যেমন কোনও বাধ্যবাধকতা কিংবা শর্ত নেই, তেমনি নেই কোনো দায়ও
তবু, এতকিছুর পরেও আধুনিক কবিতা নিজস্ব বৈভবে ব্যতিক্রমী তবে আধুনিক কবিতারও রকমফের আছে প্রতিটি কবিতাই বহন করে তার স্রষ্টার কাব্যিক জিন। অবোধ্য, দুর্বোধ্য এবং সহজবোধ্যের মতো কোথাও তার সহজ তন্বী চলন তো কোথাওবুঝতে নারি, চরণ বাঁকা কোথাও আবার ক্যালকুলাসের মতো বিচিত্র এবং জটিল অঙ্কের সমীকরণ যার কোনও সমাধান নেই কারো কাছেই। না পাঠকের কাছে এবং হয়তো না কবির কাছেও। এমনও আছে এরা একবারই প্রসব হয় এবং তার পর থেকে মালিকানাবিহীন হয়ে অবোধ্য হরফের পাহাড়ে পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ হয়ে আজীবন।
কবি গোপাল চক্রবর্তী উত্তরপূর্বের কবিতাবিশ্বে ক্রমশ অনিবার্য হয়ে ওঠা একটি নাম। তাঁর কবিতার ধাঁচ বোঝাতে সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে তাঁরই কবিতার কিয়দংশের উল্লেখ। এখানে এভাবেই হোক আলোচনার সূত্রপাত আলোচ্য গ্রন্থ, যা কিনা কবির সদ্য প্রকাশিত ৪৮ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকে এক বহনবান্ধব কাব্যগ্রন্থ, তারই অন্দর থেকে চয়িত কিছু পঙ্‌ক্তির মাধ্যমে -
 
ঠিক কটা অসুখের নাম জান তুমি ?
কত টুকরোতে ভেঙে যেতে দেখেছ বিকেলের আয়না,
কত পথিক দেখেছ অচেনা, গেছে সম্মুখের পথে অন্যমনস্ক
তারা ফিরে আসেনি আর ?
হারিয়ে গেছে দিন মিথ বন্দরে। ...... (কবিতা - আমাকে বলো তুমি)।
কিংবা -
...... কিছুই হলো না।
অনেকগুলো না হওয়ার গল্পে ডুবে আছি অনাদিকাল ধরে
ঢেউ আসে, ঢেউ হাসে
আলোর বাঁকে বাঁকে কাদের পরিণয় সেজে ওঠে,
আঁধারের ফাঁকে ফাঁকে সমাপ্তি ঘোষণা করে পাণ্ডুলিপির রাত -
আরো কিছুক্ষণ। (কবিতা - সন্ধ্যাকালীন কবিতা)।
গোপালের কবিতা ভাবনা ও অনুষঙ্গমূলক। অথচ নির্ভেজাল আধুনিক কবিতা সব। কবিতায় অবোধ্যতা কিংবা দুর্বোধ্যতা নেই যদিও সেই কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি যতি চিহ্নের পথ বেয়ে ভাবনা ও অনুষঙ্গে চলেন পাঠক।  শব্দের এক মায়াবী বাঁধন পাঠককেও বেঁধে রাখে পঠনসুখের মায়াজালে। শব্দচয়নে সাবধানী কবি তাই গড়ে তোলেন অতুলনীয় রূপকের কাব্যগাথা। ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত কবিতাগুলি ছুঁয়ে যায় পাঠকহৃদয়।
আলোচ্য সংকলের সবক’টি কবিতার অধ্যয়ন শেষে জেগে ওঠে কিছু অনুভব। কবিতাগুলি মূলত দু’টি মূল থীমের উপর প্রতিষ্ঠিত। এক কবিতা এবং দুই মৃত্যু। মোট চল্লিশটি কবিতার শিরোনামেই তার আভাস পরিস্ফুট হয়ে আছে। যেমন - সন্ধ্যাকালীন কবিতা, আমাদের যত কবিতা, একটি কবিতার জন্য, জন্মান্তর, সুইসাইড নোট, অন্তিম ইচ্ছা ইত্যাদি। বাকি কবিতাগুলোর শিরোনামে না হলেও সেই বিষয়গুলিই ফিরে এসেছে বারবার, কবিতার শরীরেঅথচ তরুণ এই কবির থেকে মৃত্যুর অনুষঙ্গের চাইতে জীবনের অনুষঙ্গই বেশি প্রত্যাশিত ছিল।
সার্বিক মূল্যায়নেও কবির পূর্বপ্রকাশিত সংকলন উৎকর্ষে সম্ভবত খানিকটা এগিয়েই ছিল এমন অনুমান হয়তো পাঠকমননে উদয় হতেও পারে। উড়িয়ে দেওয়াও যায় না এমন সম্ভাবনা। তবু এও ঠিক - বিষয়ে নয়, শাব্দিক চাতুর্য ও শব্দবন্ধনেই গোপালের কবিতার সার্থকতা লুক্কায়িত আছে বলে আলোচ্য সংকলনের যাবতীয় কবিতাই সুখপাঠ্য এবং একাধারে সুগ্রথিত। স্বর, অক্ষর বা মাত্রার কোনও বৃত্ত না খুঁজেও অনায়াসে উপলব্ধি করা যায় কবিতার তন্বী চলন। দু’একটির বাইরে সব কবিতাই এক পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। উপরি পাওনা গ্রন্থের সার্বিক উপস্থাপনা। ছাপার মান, অক্ষর, শব্দ ও পঙ্‌ক্তিবিন্যাসের যাথার্থ্য, কবিতার সঙ্গে গভীর প্রাসঙ্গিক ও মামানসই প্রচ্ছদ সংকলনটিকে করে তুলেছে পাঠকবান্ধব তথা প্রণিধানযোগ্য।
ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে রচিত কাব্যধারায় গোপাল ইতিমধ্যেই পাঠক সমাজে নিজের এক স্বতন্ত্র স্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ‘মৃত পাণ্ডুলিপির রাত’ এই ধারায় এক নবতম সংযোজন। গ্রন্থনামেও স্বভাবতই কবি ধরে রেখেছেন তাঁর ব্যতিক্রমী ভাবনা ও আঙ্গিককে। গ্রন্থটি কবি একই সুচয়িত আঙ্গিকে উৎসর্গ করেছেন - ‘যিনি নিঃস্বার্থে রোপণ করলেন চিত্রের মায়াবী গাছ পার্থিব হৃদয়ে...’ কবির সেই ছবি আঁকার গুরু শ্যামল ধরকে। এর থেকে ভিন্ন এক পরিচয়ও পাওয়া গেল কবি গোপাল চক্রবর্তীর। গ্রন্থটির প্রকাশক - ‘এবং অধ্যায়, কলকাতা’। প্রচ্ছদ - দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়। কবির ভিন্নতর পরিচিতি আছে গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদেও। স্বল্প সংখ্যক কয়েকটি বানান বিভ্রাটের বাইরে সব মিলিয়ে এক নিরলস পাঠের উপযোগী কাব্যময় কবিতার সংকলন - ‘মৃত পাণ্ডুলিপির রাত’।

 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১২৫ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৩৬০৬৮৫৩৫

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়