Skip to main content

বিষয়ে, কাব্যিকতায় অপ্রতিম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্ত ঝরছে দস্তাবেজ থেকে’



এ কথা অনস্বীকার্য যে অস্তিত্বের নথিপত্র আর দলিল দস্তাবেজ নিয়ে যতটা মহাভারত, যতটা কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটেছে, ঘটছে ঈশান কোণের এই রাজ্যটিতে তার নিদর্শন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এই ভূভারতে। শুধু রক্ত নয় - প্রাণও ঝরেছে, বন্ধ কুঠুরিতে সত্তাও ভুলুণ্ঠিত হয়েছে, লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার। নাগরিকত্বের মহাকাব্য এখানে অনিঃশেষ লিখিত হয়ে চলেছে। আর এমন আবহে এমন গ্রন্থনাম স্বভাবতই তীব্র এক পঠনক্ষুধা জাগিয়ে তোলে আপামর পাঠকের হৃদয়ে।
অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতা তপোধীর ভট্টাচার্যের কবি বা সাহিত্যিক পরিচিতির পুনরুল্লেখ ঈশান বাংলার এই মঞ্চে নিতান্তই বাহুল্য। শিলচরের নতুন দিগন্ত প্রকাশনী কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রক্ত ঝরছে দস্তাবেজ থেকে’। ভূমিকা বা আত্মকথনহীন এই গ্রন্থের একেকটি পৃষ্ঠায় রয়েছে রচনার স্থান, তারিখ ও সময়যুক্ত ৬ থেকে ১৫ লাইনের ৫৬টি শিরোনামবিহীন কবিতা। কবিতাগুলি লেখা হয়েছে ইংরেজি ২০২১ বছরটিতে। উল্লেখ করা যেতে পারে কোভিডোত্তর এই সদ্যপীড়িত সময়কাল ছিল দেশ তথা বিশ্বের কাছে এক বিভীষিকাময় সময় থেকে উত্থানপর্বের মহা-কাল। 
গদ্য ও কবিতা লেখার ধরন যে সম্পূর্ণ আলাদা সে তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু একজন প্রথিতযশা গবেষক, প্রাবন্ধিক, আলোচক ও সুচারু গদ্যকার যে কবিতার ক্ষেত্রেও কতটা পরিপাটি, সাবলীল ও কাব্যশিল্প বিশেষজ্ঞ তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি কবিতায় - যদিও কবি তপোধীরের এই কাবুগ্রন্থ প্রথম কিংবা একমাত্র নয়। আলোচনার শ্রীগণেশে উল্লিখিত এমন একটি জ্বলন্ত সমস্যা, নির্মোহ বাস্তব ও কঠিন নিরস বিষয়কে কবিতায় উপস্থাপন করা - এ বড়ো সহজ কথা নয়। অথচ আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহের গায়ে স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলতায় কবি যেমন একাধারে ফুটিয়ে তুলেছেন বিষয়ের গভীরতা তেমনই কবিতার শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছেন যথাযোগ্য কাব্য-সুষমা। 
গ্রন্থনামে মূলত দস্তাবেজ জনিত বিড়ম্বনার আভাস থাকলেও সার্বিক ভাবে কবি এখানে তুলে ধরেছেন বর্তমান সময়ের যাবতীয় অ-সুখকে। শুধু ঈশান কোণ নিয়েই থেমে থাকেননি তিনি। তুলে ধরেছেন দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উপর তাঁর প্রখর অনুভবে থাকা যাবতীয় আত্মসমীক্ষাজনিত অনাচার, অন্যায় ইত্যাদি। তীব্র শ্লেষ ও প্রতিবাদে ছিন্নভিন্ন করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম ও মূল্যবোধের পতনকে - কবিতার নিয়ম মেনে। সময়কে ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন কবি -
প্রতিটি মুহূর্তে অন্তর্ঘাত, পোড়া গন্ধ
সেইসঙ্গে হঠাৎ স্তব্ধতা
দিনলিপি জুড়ে এই একই ইস্তেহার
লিখে যাচ্ছে বিবশ সময়। (কবিতা সংখ্যা - ২৪)
এক প্রতিবাদী স্বর, পতনের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার। এই ধারাটিকেই গ্রন্থ জুড়ে লালন করেছেন কবি একের পর এক কবিতায়। নিজেকে যেন আবিষ্কার করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। যন্ত্রণা আর অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথে নিজেকে গড়ে তুলছেন কবি - নিজেকেই যেন কাটাছেঁড়া করে -
ভূকম্পপ্রবণ নিসর্গের কাছে যদি
নতজানু হই
মুছে যাবে সব আত্ম-প্ররোচনা ?
যদি নিজে দাহ্য হই
নিজেই দাহক, কী দিয়ে নেভাব তাপ
কেউ জানে ?
প্রতিদিন মনে মনে নিসর্গকে বলি
যদি উগরে দাও গলিত আগুন
সূর্যাস্তের সঙ্গে স্তব্ধতাও দিয়ো। (কবিতা সংখ্যা - ২৩)
শব্দের চমৎকার প্রয়োগে কবি ফুটিতে তুলছেন তাঁর বিঘ্নিত বোধকথা -
প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে 
ব্যক্তিগত নীরবতা আর অন্ত্র-ছেঁড়া রক্তপাতে
কীসের মাশুল দিচ্ছে অনিদ্রাতাড়িত
জাতিস্মর বোধ ? বোধ নাকি ছদ্মবেশী ভ্রম ?
যত পথ তত বেশি প্রতারক বাঁক
আমার অফুরান দিবাস্বপ্ন, ক্ষয়, সূর্যাস্তপ্রবণ পরিসর
ধুলোর ঘূর্ণিতে বারবার ঢেকে যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি
জেনো, অনিবার্য মৃত্যু-ভরা এই কথকতা। (কবিতা সংখ্যা - ১৯)
বিষয়কে অক্ষুণ্ণ রেখে বহু কবিতায় কবি সংযোজন করেছেন কিছু অমোঘ, অভাবিত অথচ অনাবিল কাব্যময় পঙ্‌ক্তি। তারই কিছু উল্লেখ -
যাকে ভাবছি তৃষ্ণাহর জল তা-ই আগুনের শিখা
পুড়ে যাই দ্বিধায়, সংশয়ে (কবিতা সংখ্যা - ৪)
যে হাতে লিখেছি আত্মবিক্রয়ের পরোয়ানা
কীভাবে লিখব সে হাতে স্বপ্নের সনদ ? (কবিতা সংখ্যা - ৫)
জেগে আছে অন্নদাতা, এর চেয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই
দেশ জুড়ে শবাগার হোক
বীণা ও বেহালার ঐকতানে শূন্যের মূর্ছনা জেগে থাক (কবিতা সংখ্যা - ১১)
চারদিক থেকে উড়ে আসছে শুকনো পাতা, ধুলোর রিক্ততা
শুষে নিচ্ছে ছন্নছাড়া ভাষা থেকে অন্তিম সংকেত (কবিতা সংখ্যা - ৪২) 
বেশ ক’টি কবিতায় রয়েছে কবির নিজস্ব পর্যবেক্ষণজনিত রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও বোধজনিত শ্লেষাত্মক উচ্চারণের কাব্যিক প্রকাশ। কোথাও নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন কবি -
যারা আলো মুছে নিয়ে অন্ধকার লেখে
তাদের কাছেই হাঁটু মুড়ে বসছে
অবোধ জনতা, মেরুদণ্ড জিম্মা দিচ্ছে রোজ...
...কারা বলে, ছেয়ে গেছে তিক্ত অন্ধকার অন্তর-বাহিরে
আলো কি কখনো ছিল ? সত্য ছিল ? ছিল কি জীবন ? (কবিতা সংখ্যা - ৪৬)।
এত যে অসহনীয়তা, অনিয়ম, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শ্লেষ - তবু শেষ অবধি কোথাও কাব্যময়তার সঙ্গে আপস করেননি কবি। এটাই আলোচ্য গ্রন্থের অন্যতম এক প্রাপ্তি। 
গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন - বরুণকুমার সিন্‌হা, সঞ্জীব গোস্বামী ও সঞ্জয় রায়কে। প্রাসঙ্গিক, ছিমছাম প্রচ্ছদের সৌজন্যে কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। পাকা বাঁধাইয়ে জ্যাকেট কভার থাকা সত্ত্বেও প্রথম ব্লার্বটি শূন্য থেকে গেল। ছাপা স্পষ্ট। শব্দ, পঙ্‌ক্তিবিন্যাস যথাযথ। 
শেষ কবিতায় প্রকৃতিস্ত্রোত্রে, বন্দনায়, কাব্যিকতায় বিষাদের মাতৃভাষা বুঝতে চেয়েছেন কবি। উচ্চারিত হয়েছে অন্তরের শান্তি ও কল্যাণ মন্ত্র -
সূর্যাস্তপ্রবণ এই পাণ্ডুলিপি থেকে
খুঁটে খুঁটে তুলে নাও শান্তি ও কল্যাণ
ভুবনডাঙার শস্যঋতু, শোনো, তণ্ডুলের কণা থেকে
আমাকে শেখাও শিল্পবোধ, প্রত্যাশার গান
সারাদিন মেঘস্ত্রোত্র পড়ি, বৃষ্টির বন্দনা লিখি
অন্তিম রশ্মির স্পর্শকাতরতা দিয়ে
বিষাদের মাতৃভাষা বুঝে নিই। 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫৫৬৬৪৯৪

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি