Skip to main content

নয়ন ও মনন-সুন্দর পূজা সংখ্যা ‘মৈত্রী’


সুন্দরী বড়াইলসংলগ্ন বরাক ও ডিমা হাসাও বা এক সময়ের ডিমাসা কাছাড়ি রাজ্যের মধ্যে যে এক ঐতিহাসিক বা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে তা সর্বজনবিদিত স্বভাবতই বাংলা এবং কাছাড়ি ভাষা-সাহিত্যের নৈকট্যও এক অবিসম্বাদিত সত্য ইতিহাস থেকে আধুনিক কাল অবধি নিরন্তর ঘটে যাওয়া সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সত্ত্বেও এই বন্ধন অবিচ্ছেদ্য বহু গভীরে প্রোথিত এই ইতিহাস। আজ তাই স্বায়ত্ত শাসিত ডিমা হাসাও-এর দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হচ্ছে বাংলা - যার রেশ শোনা যায় রেল স্টেশনসমূহের ঘোষণা শুনলে সেই ডিমা হাসাও-এর প্রতিটি অঞ্চলের পাশাপাশি প্রধান শহর তথা প্রাণকেন্দ্র হাফলং-এ বাঙালি ও বাংলার রয়েছে এক যুগব্যাপী ইতিহাস, এক ঐতিহ্যপূর্ণ অবস্থান তা সে স্বাধীনতা আন্দোলনই হোক, পুরাণমিশ্রিত, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক সম্পর্ক যাই হোক না কেন আজও হাফলঙে বাঙালিদের অস্তিত্ব ও অবদান একই ধারায় প্রবাহিত আর এই ধারারই অঙ্গ হিসেবে শরৎ এলেই সেজে ওঠে পাহাড়, শরন্ময়ীর আবাহনে, উদ্দীপনায়, উৎসাহে এই শারদ আয়োজনে স্বভাবতই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে প্রধান কেন্দ্রস্থল হাফলং আর এই আবহেই প্রতি বছর এই শারদোৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রকাশিত হয় পূজা সংখ্যামৈত্রী সর্বশেষ সংখ্যাটি বেশ দেরি করেই এল হাতে সম্পাদকীয় থেকে জানা যায় আলোচ্য সংখ্যাটি হচ্ছে ষষ্ঠ শারদ সংখ্যা, ১৪৩০ কিছু কথা এখানে সম্পাদকীয় থেকে তুলে ধরাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না মোটেও -
‘…দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সৃষ্টির নজির অনেক পুরোনো ইতিহাস সাক্ষী, বাঙালি যেখানে গেছে সেখানে তাদের বারো মাসে তেরো পার্বণকে সঙ্গী করার পাশাপাশি বাড়তি হিসেবে সাহিত্য সৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে নিয়ে গেছে। ...ব্যতিক্রম নয় চির বৈচিত্রের ডিমা হাসাও-ও। পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক পুজোর আয়োজন করা হয়। ...শৈলশহর হাফলং-এও শারদোৎসবের আয়োজনে কোনো ত্রুটি নেই। তালিকায় এবার নতুন পূজার সংযোজন। জাটিঙ্গাতে এবার প্রথম বারের মতো পূজার আয়োজন হচ্ছে। যদিও জাটিঙ্গা মিটারগজ রেলস্টেশনে সেই অর্ধ শতক ধরে পূজা হচ্ছে। রেল চলে গেলেও পূজা থেমে থাকেনিকিন্তু সড়কপথে জাটিঙ্গাতে এবার প্রথম পুজো...’ তথ্যভিত্তিক এই সম্পাদকীয় অবশ্যই পড়তে হবে পাঠকের কারণ এর পরেই থাকছে ‘মৈত্রী’ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। দিন-কাল তথা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এর থেকে ভালো পত্রিকা-নাম আর হতেই পারে না।
এবার একটু চোখ বুলানো যাক পত্রিকার অভ্যন্তরে। লেখা সংগ্রহ এবং চয়নে বৈচিত্র ও মুনশিয়ানা দুটোরই পরিচয় পাওয়া যায়। সম্পাদক পঙ্কজ কুমার দেব তথা সম্পাদকীয় দপ্তর যে এ বিষয়ে জাগ্রত গরজের পরিচয় দিতে সফল হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। ডাবল সাইজের ৬৮ পৃষ্ঠার এই সংখ্যায় প্রত্যক্ষ করা যায় গদ্য ও পদ্যের এক পরিমিত আয়োজন। ২০টি গদ্য ও ২৫টি কবিতা স্থান পেয়েছে এবারের সংখ্যায়। কিছু গদ্য সংক্ষিপ্ত মনে হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয় মোটেও। শুভারম্ভ হয়েছে পান্না চক্রবর্তীর ‘দেবী দুর্গার আগমনি ও বিজয়া’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের মধ্য দিয়ে। এরপর এসেছে একের পর এক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গল্প। নির্মলেন্দু রায়ের পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ ‘ভারতের শিক্ষানীতি ২০২০ এবং ধ্রুপদী ভাষা প্রসঙ্গ’ এক বিস্তৃত প্রতিবেদন যা সংখ্যাটির অন্যতম সম্পদ নিঃসন্দেহে। পান্নালাল দেবরায় লিখেছেন ‘ইতিহাস প্রসিদ্ধ মাইবাং ও প্রাচীন গ্রাম সেমখর’ শীর্ষক অণুনিবন্ধ। রীতা চক্রবর্তী (লিপি)র ভ্রমণনির্ভর ছোটোগল্প ‘সূর্যাস্তের রং’ সুখপাঠ্য ও সুলিখিত। আ.ফ.ম. ইকবালের গল্প ‘সংস্কার’ বিষয় বৈচিত্রে আকর্ষণীয়। লেখকের লেখার হাত বরাবরই ভালো। মীনাক্ষী চক্রবর্তীর নস্টালজিক প্রতিবেদন ‘হাফলং ডায়েরি’ ব্যক্তিগদ্য গদ্য হলেও হাফলঙের নস্টালজিয়া ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পাঠকহৃদয়েও। একই ভাবে শৈলশহর হাফলং ভ্রমণ ও হাফলং-এর সার্বিক বর্ণনার মধ্য দিয়ে গদ্য বিভাগকে সমৃদ্ধ করেছেন সুমন দাস ও কৃষ্ণা রায় দাস। সুচারু বিন্যাস রয়েছে তাঁদের লেখায়। অসমিয়া ভাষায় লেখা নিভা দত্ত বভীর অণু নিবন্ধ ‘প্রেম বনাম স্বর্গীয় সুখানুভূতি’ সংখ্যাটিকে দ্বিভাষিকের মর্যাদা প্রদান করেছে। উমা দেব-এর গল্প ‘আত্মসম্মান’ বিষয়ে বুনোটে অসাধারণ। কিন্তু এই গল্পে বানান বিভ্রাট অধিক প্রকট হয়ে উঠেছে। ‘হুইলচেয়ার’ শিরোনামে মুক্তগদ্য লিখেছেন পুলক রায়। রয়েছে শাম্মি তুলতুলের ‘নীতিগল্প’ - ‘মিনির বেড়াল ছানাটি’। ব্রজগোপাল রায়ের গল্প ‘বিবাহ বার্ষিকী’ হৃদয় ছুঁয়ে যায়। গল্প নয়, সুলিখিত ব্যক্তিগত অনুভূতি - স্বাগতা লোধ ধরের ‘জবা’। রম্য নিবন্ধ তপন তরফদারের ‘গাঁট বন্ধন’। সুচিত চক্রবর্তীর অণুগল্প ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ সুখপাঠ্য। সুমিতা দেব-এর নিবন্ধ ‘পালি সাহিত্যে বারবণিতাদের অবস্থান’ এক ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে। যথেষ্ট জমাট হলেও সম্ভবত অধিক বিস্তৃতির সুযোগ ও প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী তিনটি লেখাই একাধারে উৎকৃষ্ট ও প্রাসঙ্গিক। প্রাঞ্জল পালের অণুগল্প ‘বুভুক্ষা’ চেনা প্লটে দরদের ছাপদেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠীর নিবন্ধ ‘বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ এক কথায় চমৎকার। দেবযানী ভট্টাচার্যের গল্প ‘ভানুমতী ও নারীদিবস - ২’ সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। উভয়েও সংখ্যাটির মান বাড়িয়েছে নিশ্চিত।
কবিতা বিভাগটিও যথেষ্ট প্রসারিত এবং বৈচিত্রপূর্ণ। বিশেষোল্লেখে রাখা যায় ছন্দা দাম, মহুয়া দাস মজুমদার, শতদল আচার্য, রফি আহমেদ মজুমদার, সীমা চক্রবর্তী, মোহম্মদ সফিকুল ইসলাম, সুপ্রদীপ দত্তরায় ও নারায়ণ চক্রবর্তীর কবিতা। এছাড়াও ভালো লিখেছেন বিচিত্রা চৌহান, অভিজিৎ পাল, শিবানী গুপ্ত, সোনালী গোস্বামী, মনোজকান্তি ধর, কানন দাশগুপ্তা সোম, সুমন দাস, দেবলীনা রায়, জয়ন্তী দত্ত, সুদীপ মুখার্জি, পীযূষ রায়, বিদিতা সেন, বনবিহারী দত্ত বনিক, সুপ্রতিম ভৌমিক, তনুশ্রী নাথ, সুস্মিতা নাথ ও পঙ্কজ কান্তি মালাকার।
স্পষ্ট ছাপা, শব্দ-অক্ষরবিন্যাস এবং নয়নজ্যোতি শর্মার প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ তথা অলংকরণ সংখ্যাটিকে করে তুলেছে নয়ন ও মননসুন্দরপ্রকাশক আশীষ দত্ত। কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে যা নিয়ে পরবর্তীতে অধিক সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর বাইরে এক পূর্ণাঙ্গ সুচিন্তিত পূজা সংখ্যা ডিমাহাসাও সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, হাফলং কর্তৃক পরিবেশিত ‘মৈত্রী’ - সমন্বয়ের দিশারি।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫০৭৭৮২০ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি