প্রথম
ব্লার্বে বিশিষ্ট গল্পকার মিথিলেশ ভট্টাচার্য লিখছেন - ‘...কবিতার বহিরঙ্গ রূপের
পরিবর্তে অমিতাভ’র সবিশেষ ঝোঁক অন্তরঙ্গ রূপের দিকে। তাঁর রচিত কবিতায় মানব জীবনের
অতলান্ত ব্যাপ্ততার ছবি ফুটে ওঠে...। চেতনার গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসে তাঁর
জীবন-অভিজ্ঞতার উপলব্ধির কথা...’। ভূমিকায় তিনিই আবার লিখছেন - ‘...শ্রমবিমুখ হলে
যেমন লেখক হওয়া যায় না, কবি হওয়া তো ততোধিক কঠিন। অমিতাভ সেনগুপ্তের নিবিড় ও নিভৃত
কবিতা চর্চা এক অসাধারণ শ্রম ও মননলব্ধ প্রয়াস...’।
হুবহু এই আবহে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছিল কবি অমিতাভ সেনগুপ্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বীজঘুম’। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কবিতা গল্প ও অন্যান্য লেখালেখির সঙ্গে তিনি নিরন্তর যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে। সুতরাং বলাই যায় বহু দেরি হয়েছে তাঁর ববিতার বই বেরোতে বেরোতে। এর বহু আগে থেকেই এদিকে ওদিকে তাঁর অজস্র কবিতার স্বাদ গ্রহণে ঋদ্ধ হয়েছেন পাঠকমহল। অত্যন্ত সার্থকনামা এই গ্রন্থে আছে ৪৯টি ভিন্ন স্বাদের কবিতা। প্রতিটি কবিতাই আপন মাহাত্ম্যে ভাস্বর। অসংখ্য কবিতা দাগ রেখে যায় পাঠকের অন্তরে। বোধের উঠোন মাড়িয়ে আসা পঙ্ক্তিসমূহ জাত চিনিয়ে দেয় কবির। অমিতাভের বহু কবিতায় আমরা দেখতে পাই পরমপিতার কাছে এক নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। বেদের শ্লোক, ত্রিপিটকের উল্লেখ রয়েছে বহু কবিতায়। তাঁর কবিতায় সবচাইতে বেশি যে বিষয়, যে অনুষঙ্গ ফিরে আসে বেশি করে তা হল জীবনবোধ এবং মৃত্যুচিন্তা। বলা যায় জীবন্মৃত্যুর এক নির্মোহ বিশ্লেষণ। কবি জীবনানন্দ দাশের ছায়া অবিরাম উন্মোচিত হয় তাঁর কবিতায়। বারবার উচ্চারিত হয় নক্ষত্রের অনুষঙ্গ। এমনকি জীবনানন্দীয় ভাষার উল্লেখও অবিকল খুঁজে পাওয়া যায় কবিতায়। কবিতায় এক উদ্ভ্রান্ত ‘আমি’কে কবি উন্মোচিত করেছেন অন্তরকে নিংড়ে নিংড়ে। করেছেন বিনির্মাণ। ‘আমি’কে কবি দেখেছেন অভূতপূর্ব স্বকীয়তায় -
কেন চলে এসেছি এখানে,
আমারই কি আসার কথা ?
কোথাও কি ছিল এমন অঙ্গীকার ?
...যোগসূত্র খুঁজে খুঁজে দেখি আমি,
খুঁজি বাতাসের প্রবাহ,
খুঁজি আমার এই আমি হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত।
...কী ভয়ানক, কী ভয়ানক সেই যোগসূত্র,
ললাট লিখন।
তবু আমি নির্দিষ্ট হয়ে গেছি এই আমিতে।
সবই আমি, এই প্রশ্নময় আমি
আমি দেখেছি কত দ্বিজজীবন আমার;
কুৎসিত শুঁয়োপোকার গুটি ছেড়ে প্রজাপতি হবার।
...আমি এক বিস্ময়,
আমি এক দুর্ঘটনা,
আমি এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন। ...
‘আমি’ শীর্ষক এই কবিতার শরীরে অসংখ্য এমন প্রশ্ন রেখে দিয়ে শেষের দিকে কবি লিখছেন -
আমাকে আর কত পাঠাবে এই তমোগৃহে
...দিনের শেষে আমি কি ফিরে যাব না ঘরে ?
এই যে তারামণ্ডল, লক্ষ যোজন ছাপিয়ে
সেখানে তোমার যে বিস্তৃত মাঠ,
সেখানে কোথায় রেখেছ আমার ঘর ?
...কোনও বিলাস চাই না
শুধু একটি ঘর চাই আমার
আর একটা টানা ঘুম... আহ্
আমাকে আর ডেকো না।
বস্তুত এই ‘আমি’ কবিতাতেই কবি নিজের যাবতীয় স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রেখেছেন সযতনে, সজ্ঞানে। অমোঘ পঙ্ক্তি জুড়ে নিজেকে করেছেন প্রতিভাত। মায়াবী শব্দের কুহকে শেষের আবহে নিজেকে করে রেখেছেন জাগ্রত -
...এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি/ মহাশ্মশানের স্তব্ধতার মাঠে,/ শিউলির মতো কিছু সাদা খই/ আকাশের নির্দিষ্ট তারাদের ব্যঙ্গ করে/ হয়তো একদিন পড়ে থাকবে ধুলায়।/ ...অগোছালোই কি রয়ে যাবে/ এই ক্ষুদ্র জীবন ? ...... (কবিতা - মহাজীবন)।
নির্জনতাকে ভালোবাসেন কবি নিজের মতো করে। কবি লিখেন -
নির্জন আমাকে কত কথা শোনায়.../ নির্জন জেগে উঠলে সব কোলাহল ছাপিয়ে ওঠে/ আরো মগ্নতার শব্দ.../ নির্জন জেগে উঠলে একান্তে/ বড়ো প্রগলভ হয়ে উঠি আমি... (কবিতা - নির্জন)।
এই নির্জনতা-প্রবণতাই হয়তো কবির মননে সতত সঞ্চারিত করে কবিতার নির্মোহ ফল্গুধারা -
...আমি জন্ম নিয়েছি আরো বহুজন্ম আগে
বাতাসের স্তরে স্তরে রেণু প্রতিরেণু জুড়ে
কত মর্মকথা লেখা হয়েছিল জানো ?
আরো আরো বীজঘুম জুড়ে আমাকে খোঁজো।
প্রতিটি মৃতদেহই একটি বীজঘুম
কত বীজঘুম সে পেরিয়ে এসেছে জানো। (কবিতা - বীজঘুম)।
এমনই সব মননলব্ধ কবিতার সমাহার এই কাব্যগ্রন্থ পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেয় এক ঘোর লাগা পঠনসুখ। যথাযথ মানের ছাপা, বাঁধাই, অক্ষরবিন্যাস, ‘প্রায়’ নির্ভুল বানান এবং রাজীব চক্রবর্তীর প্রচ্ছদ আকর্ষণীয় করে তুলেছে গ্রন্থটিকে। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্বর্গত মা ও বাবাকে। বলা যায় অসংখ্য মায়াবী শব্দের তন্নিষ্ঠ পঙ্ক্তি সম্বলিত একের পর এক কবিতার এক অনবদ্য সংকলন - ‘বীজঘুম’।
হুবহু এই আবহে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছিল কবি অমিতাভ সেনগুপ্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বীজঘুম’। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কবিতা গল্প ও অন্যান্য লেখালেখির সঙ্গে তিনি নিরন্তর যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে। সুতরাং বলাই যায় বহু দেরি হয়েছে তাঁর ববিতার বই বেরোতে বেরোতে। এর বহু আগে থেকেই এদিকে ওদিকে তাঁর অজস্র কবিতার স্বাদ গ্রহণে ঋদ্ধ হয়েছেন পাঠকমহল। অত্যন্ত সার্থকনামা এই গ্রন্থে আছে ৪৯টি ভিন্ন স্বাদের কবিতা। প্রতিটি কবিতাই আপন মাহাত্ম্যে ভাস্বর। অসংখ্য কবিতা দাগ রেখে যায় পাঠকের অন্তরে। বোধের উঠোন মাড়িয়ে আসা পঙ্ক্তিসমূহ জাত চিনিয়ে দেয় কবির। অমিতাভের বহু কবিতায় আমরা দেখতে পাই পরমপিতার কাছে এক নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। বেদের শ্লোক, ত্রিপিটকের উল্লেখ রয়েছে বহু কবিতায়। তাঁর কবিতায় সবচাইতে বেশি যে বিষয়, যে অনুষঙ্গ ফিরে আসে বেশি করে তা হল জীবনবোধ এবং মৃত্যুচিন্তা। বলা যায় জীবন্মৃত্যুর এক নির্মোহ বিশ্লেষণ। কবি জীবনানন্দ দাশের ছায়া অবিরাম উন্মোচিত হয় তাঁর কবিতায়। বারবার উচ্চারিত হয় নক্ষত্রের অনুষঙ্গ। এমনকি জীবনানন্দীয় ভাষার উল্লেখও অবিকল খুঁজে পাওয়া যায় কবিতায়। কবিতায় এক উদ্ভ্রান্ত ‘আমি’কে কবি উন্মোচিত করেছেন অন্তরকে নিংড়ে নিংড়ে। করেছেন বিনির্মাণ। ‘আমি’কে কবি দেখেছেন অভূতপূর্ব স্বকীয়তায় -
কেন চলে এসেছি এখানে,
আমারই কি আসার কথা ?
কোথাও কি ছিল এমন অঙ্গীকার ?
...যোগসূত্র খুঁজে খুঁজে দেখি আমি,
খুঁজি বাতাসের প্রবাহ,
খুঁজি আমার এই আমি হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত।
...কী ভয়ানক, কী ভয়ানক সেই যোগসূত্র,
ললাট লিখন।
তবু আমি নির্দিষ্ট হয়ে গেছি এই আমিতে।
সবই আমি, এই প্রশ্নময় আমি
আমি দেখেছি কত দ্বিজজীবন আমার;
কুৎসিত শুঁয়োপোকার গুটি ছেড়ে প্রজাপতি হবার।
...আমি এক বিস্ময়,
আমি এক দুর্ঘটনা,
আমি এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন। ...
‘আমি’ শীর্ষক এই কবিতার শরীরে অসংখ্য এমন প্রশ্ন রেখে দিয়ে শেষের দিকে কবি লিখছেন -
আমাকে আর কত পাঠাবে এই তমোগৃহে
...দিনের শেষে আমি কি ফিরে যাব না ঘরে ?
এই যে তারামণ্ডল, লক্ষ যোজন ছাপিয়ে
সেখানে তোমার যে বিস্তৃত মাঠ,
সেখানে কোথায় রেখেছ আমার ঘর ?
...কোনও বিলাস চাই না
শুধু একটি ঘর চাই আমার
আর একটা টানা ঘুম... আহ্
আমাকে আর ডেকো না।
বস্তুত এই ‘আমি’ কবিতাতেই কবি নিজের যাবতীয় স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রেখেছেন সযতনে, সজ্ঞানে। অমোঘ পঙ্ক্তি জুড়ে নিজেকে করেছেন প্রতিভাত। মায়াবী শব্দের কুহকে শেষের আবহে নিজেকে করে রেখেছেন জাগ্রত -
...এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি/ মহাশ্মশানের স্তব্ধতার মাঠে,/ শিউলির মতো কিছু সাদা খই/ আকাশের নির্দিষ্ট তারাদের ব্যঙ্গ করে/ হয়তো একদিন পড়ে থাকবে ধুলায়।/ ...অগোছালোই কি রয়ে যাবে/ এই ক্ষুদ্র জীবন ? ...... (কবিতা - মহাজীবন)।
নির্জনতাকে ভালোবাসেন কবি নিজের মতো করে। কবি লিখেন -
নির্জন আমাকে কত কথা শোনায়.../ নির্জন জেগে উঠলে সব কোলাহল ছাপিয়ে ওঠে/ আরো মগ্নতার শব্দ.../ নির্জন জেগে উঠলে একান্তে/ বড়ো প্রগলভ হয়ে উঠি আমি... (কবিতা - নির্জন)।
এই নির্জনতা-প্রবণতাই হয়তো কবির মননে সতত সঞ্চারিত করে কবিতার নির্মোহ ফল্গুধারা -
...আমি জন্ম নিয়েছি আরো বহুজন্ম আগে
বাতাসের স্তরে স্তরে রেণু প্রতিরেণু জুড়ে
কত মর্মকথা লেখা হয়েছিল জানো ?
আরো আরো বীজঘুম জুড়ে আমাকে খোঁজো।
প্রতিটি মৃতদেহই একটি বীজঘুম
কত বীজঘুম সে পেরিয়ে এসেছে জানো। (কবিতা - বীজঘুম)।
এমনই সব মননলব্ধ কবিতার সমাহার এই কাব্যগ্রন্থ পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেয় এক ঘোর লাগা পঠনসুখ। যথাযথ মানের ছাপা, বাঁধাই, অক্ষরবিন্যাস, ‘প্রায়’ নির্ভুল বানান এবং রাজীব চক্রবর্তীর প্রচ্ছদ আকর্ষণীয় করে তুলেছে গ্রন্থটিকে। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্বর্গত মা ও বাবাকে। বলা যায় অসংখ্য মায়াবী শব্দের তন্নিষ্ঠ পঙ্ক্তি সম্বলিত একের পর এক কবিতার এক অনবদ্য সংকলন - ‘বীজঘুম’।
বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী
প্রকাশক -
চিন্তা, কলকাতা
মূল্য - ২৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৬৭৪১৮৯১০৬ (প্রকাশক)
মূল্য - ২৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৬৭৪১৮৯১০৬ (প্রকাশক)
Comments
Post a Comment