Skip to main content

...ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি যদি ভেসে ওঠে আমার নামের আখর - ‘ধানের দেশে রৌদ্রছায়া’


আপাতদৃষ্টিতে তন্বী মনে হলেও দুই মলাটের ভেতর রয়েছে নেই নেই করেও ৫১টি কবিতা ৬৪ পৃষ্ঠার হার্ডবোর্ড বাঁধাই গ্রন্থের ব্লার্বগুলো খালি থাকলেও রয়েছে দুই অনুচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা, রয়েছে সচিত্র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি - শেষের পাতায় এ হল গিয়ে আকৃতি প্রকৃতি কেমন…? কবি লিখছেন - ‘…লিখতে ভালোবাসি দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে আবোলতাবোল যা মনে আসে লিখে রাখি সেগুলো হয়ে যায় কবিতা
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো - গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁরজীবনসঙ্গীকে স্বভাবতই থাকছে একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা। এর বাইরে উপর্যুক্ত ‘আবোলতাবোল’ শব্দটি আসলে রূপক হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে, যেখানে আবোলতাবোল মানে হচ্ছে ভাবনা ও বিষয়ের বৈচিত্র। ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটি যদিও এক বিশেষ সঙ্গীকেই বোঝায় তবু মানুষ তার জীবনে কি সঙ্গী হিসেবে একজন মানুষকেই শুধু পায়? জীবনের চলার পথে মুখোমুখি হওয়া অঢেল ছবি, অসংখ্য মুখ, অগুনতি স্মৃতি আর অনুভব তো তার সারাটি জীবন ধরে লব্ধ সম্পদ হিসেবে সাথে সাথে চলে জীবনভর। কবি আসলে এ সবকিছুকে নিয়েই গড়েছেন তাঁর খেলাঘর। শব্দের খেলাঘর, কবিতার খেলাঘর। প্রেম-ভালোবাসা, শৈশবের যাপিত বেলার স্মৃতিকথা, জন্মস্থান, প্রকৃতি, দৈনন্দিন জীবনের অনুভব অনুভূতি সব কিছু নিয়েই রৌদ্রছায়াময় আখরের সংস্থাপন করতে চেয়েছেন কবিতায়। সংস্থাপন এতটাই নিগূঢ়, এতটাই ভাববৈচিত্রে ভাস্বর যে কবিতা আপন ছন্দে হয়ে ওঠে খেয়ালি মনের স্বাধীনচেতা পথিক। জীবনের নিয়ত বদলাতে থাকা রং রূপের আবহেই কবিতার মতো কখন যে সঙ্গছুট হয়ে যায় কবির যাপিত জীবনের এক একটি মুহূর্ত, হারিয়ে যায় শৈশব, হারিয়ে যায় মানুষ, প্রকৃতি, বেড়ে ওঠার সময়সোপান - তা এক বিস্ময়, এক দুঃখবোধ হয়ে জেগে ওঠে্ অন্তরে...
...রঙিন প্রজাপতি আজও ওড়ে
ব্যালকনিতে, উঠোনে, সব ছাড়িয়ে দিগন্তপানে
কিন্তু সেই মেয়েটি আর দৌড়োয় না।
বিরাট বিশ্বভুবনে প্রজাপতি ধরতে গিয়ে
শৈশব নিজেই উড়ে চলে গেছে কোন সুদূরে
শৈশব...... শৈশব...... কত বৈভব ছড়ানো।
প্রজাপতি হয়ে ভেসে গেছে কোন অসীমে। ... (কবিতা - প্রজাপতি মন)।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা বড়াইলের মাইবাং জনপদে কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা। শেকড়চ্যুত কবির লেখনীতে তাই বারবার উঠে আসে সেই বিগত শৈশবযাপনের আকুল ব্যথা -
জননী জন্মভূমি মাইবাং চিরন্তনী
বারে বারে এসে তোমার চরণ চুমি...
বারবার আমি পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে ফিরি চারপাশে,
এখানে আমার সোনালি শৈশব প্রকৃতি ছুঁয়ে থাকে।
বলিরেখা ভরা মুখগুলো খুঁজি, খুঁজি আশীর্বাদি হাত
তোমার আঁচলে হৃদয় বাঁধানো ভালোবাসার ছয়লাপ।
(কবিতা - পরিব্রাজক)।
বড়াইলের সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সমতল ভূমিতে ধানের খেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি এক নৈসর্গিক দৃশ্য। ‘প্রকৃতি’ কন্যা কবিতায় এমনই আবেশ মূর্ত হয়ে ওঠে শব্দে, পঙ্‌ক্তিতে -
যদি দেখো/ বড়াইল পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে/ নেমে আসে কোন এক পাহাড়ি কন্যা,/ পিঠে ‘খাং’ নিয়ে/ ভেতরে তার রুপোলি কলস/ যেন হাজার তারার ঝিলমিল শোভা...।/ তবে জেনো,/ এখানে কুমারী প্রকৃতি/ নির্ভয়ে জীবনের জলছবি আঁকে,/ রূপকথার অশরীরী রূপক/ এখানে মূর্ত হয়ে/ মানুষের বেশে ঘুরে বেড়ায় অহরহ। এভাবেই একাধিক কবিতায় ভেসে আসে বড়াইলের প্রকৃতির মোহমায়া।
রয়েছে এমনই আবেগিক উচ্চারণযুক্ত বহু কথা, কবির কবিতার ছত্রে ছত্রে। কিছু কবিতার বিশেষোল্লেখ এখানে অবান্তর হবে না মোটেওযেমন - ‘অপ্রকাশিত’, ‘ঘুমের অভাব’, ‘জাটিঙ্গার বাঁকে’, ‘বৃষ্টিস্নাত একদিন’, ‘যদি বন্ধুতা চাও’, ‘প্রেমের ক্যানভাস’, ‘পরিব্রাজক’, ‘ওঠ জাগো নারী, পর রুদ্রবেশ’, ‘হৃদয়ের ছবি’, ‘অধরা প্রেম’, ‘চিঠি’, ‘পাঠকের দরবারে’ ইত্যাদি। কবিতাকে ভালোবেসে একদিকে যেমন রয়েছে প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুতার আকুল আবেগে গ্রথিত একাধিক আন্তরিক কবিতা, রয়েছে ‘কবিতা’ বিষয়ক কবিতা তেমনি বাস্তবতার নিরিখে কিছু প্রতিবাদী উচ্চারণ, কিছু শ্লেষাত্মক বয়ানযুক্ত কবিতা রয়েছে যেখানে বিষয়ভাবনা ছাড়িয়ে গেছে কবিতার কাব্যিক উপস্থাপনাকে।
গ্রন্থের কাগজের মান, ছাপা, অক্ষরবিন্যাস আদি যথাযথ হলেও বানানবিভ্রাট রয়েছে বেশ কিছু। অলংকরণ নান্দনিক হয়নি। মনোজুল ইসলামের প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক হলেও আধুনিকতার নিরিখে জ্যাকেটের সার্বিক গুণমান মানানসই হয়ে ওঠেনি।  এ সবকিছুকে সরিয়ে রেখে খেয়ালি মনের বিচিত্র প্রকাশ আলোচ্য গ্রন্থটি, যা ভবিষ্যতে কবির তরফে একসাথে চলার অঙ্গীকারে অধিকতর কাব্যময় কবিতার প্রত্যয় জাগিয়ে রাখে তাঁরই কবিতায় -
...প্রকাশিত হোক উজ্জ্বল আখরে ভরা
বাক্স উপচে পড়া সেই পণ্ডুলিপি,
থরে থরে যেখানে সাজানো আছে
হাজার কথার ঝাড়বাতি...।।   

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - নীরব আলো প্রকাশন, কলকাতা।
মূল্য - ১৭০ টাকা, যোগাযোগ - ৯৭০৬৭৮৮৮৬৭

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...