Skip to main content

অকপট উৎকর্ষের গল্প সংকলন - ‘মন জানালার প্রান্তে’


সাহিত্যের এই ঈশান বাংলা ভুবনে ঋতা চন্দ এক পরিচিত নাম লেখালেখি করছেন বহু দিন ধরে সাহিত্যের অঙ্গনে বহু যুদ্ধের ঘোড়া এই কবি, লেখকের ৯ম প্রকাশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মনমাতানো গল্প সংকলন - ‘মন জানালার প্রান্তে আসলেই একজন কবি কিংবা লেখকের মনোজ চিন্তাচর্চার ফসলই তাঁর সাহিত্যকৃতি সেই সূত্রেই মন-জানালার আনাচেকানাচে লব্ধ অভিজ্ঞতার নিরিখে ভরে উঠেছে বিক্ষিপ্ত, বিস্তৃত এবং বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ঝুলি গ্রন্থের দ্বিতীয় ব্লার্বে তারই বর্ণন - ‘নাটক, গল্প, ছড়া, কবিতা লিখলেও ঋতা চন্দের পরিচিতি গল্পকার হিসেবেই অধিক মান্যতা পেয়েছে পাঠকের দরবারে। বর্তমান গ্রন্থটি তাঁর চতুর্থ গল্প সংকলন। নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আজকের দিনে অনেকটাই বদলে গেছে বাংলা ছোটগল্পের রং, রূপ এবং গল্পের উপস্থাপনা-ভাষা-বুনোট-শৈলী। ঋতা চন্দের গল্পের মধ্যে তার প্রভাব পড়লেও খুঁজে পাওয়া যায় নিখাদ কাহিনির স্বাদ, যেখানে শৈলী বা ভাষার প্রায়োগিক কারুকার্যের পাশাপাশি নিরন্তর বজায় থাকে কাহিনির অক্ষত চলনমন জানালার প্রান্তে গল্প সংকলনের পাঠে পাওয়া যায় সেই আমেজ যা চিরন্তন ও সর্বৈব গ্রহণযোগ্য। গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে বিচিত্র সব মর্মকথা, নির্মোহ বাস্তব, সামাজিক দায়বদ্ধতা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে বেরিয়েছে বিষয়বৈচিত্রে, বয়ানে ও বুনোটে। এক একটি চরিত্র যেন পাঠকের বহু দেখা চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায় পাঠের আমেজে। পাঠকের সঙ্গে লেখকের এই একাত্মতাই একজন সফল গল্পকারের মূলধন।’
আসলেই আলোচ্য গ্রন্থের ২৭ টি গল্পে গল্পকার তাঁর চোখে দেখা, মননে অনুভূত বৈচিত্রের যে পটভূমি নির্মাণ করেছেন তা যেন সবাকার চোখে নৈমিত্তিক রোজনামচার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কাহিনিকে ভাস্বর করেছে অনবদ্য মুনশিয়ানায়। নৈমিত্তিক রোজনামচায় উঠে আসে মানুষের বিচিত্র জগতের ততোধিক বিচিত্র সব যাপনকথা। জন্ম, মৃত্যু যাপনকথার চেনা অচেনা জগৎ নিয়েই ঋতার গল্পবিশ্ব। ভূমিকায় তাই তিনি লিখছেন - ‘মনের খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে আমি মানুষ দেখি। মানুষের অন্তর্নিহিত মানবিকতাবোধ, বিবেক, মহানতার প্রকাশ দেখে মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই। আবার কখনও শিউরে উঠি মানুষের বীভৎস চেহারা দেখে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, মানুষের স্বভাব, আচরণ যখনই মনে দাগ কাটে, আমি আবেগিক হয়ে পড়ি। সেই আবেগকে গল্পাকারে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করি কল্পনার রং মিশিয়ে......।’
বস্তুত ১৪৪ পৃষ্ঠার আলোচ্য এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি গল্পই একাধারে যেমন কাহিনির বর্ণনায়, বুনোটে ও শৈলীতে মহিমান্বিত তেমনি লেখকের অসামান্য চিন্তাভাবনার এক একটি দলিলও। প্রতিটি গল্পই সুচিন্তিত বিষয়বৈচিত্রে ভরপুর, প্রতিটি গল্পই দাগ কাটে মনে। দৈনন্দিন ধারাবাহিক সংসার যাপনের মধ্যেও যে লুকিয়ে রয়েছে কত বিচিত্রতা, কত সংগ্রামের কথা তা মানুষের সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা দেয় না। সেইসব বৈচিত্রকেই গল্পকার তুলে এনেছেন স্বকৃত ভাবনার মোড়কে। স্বভাবতই প্রতিটি গল্প হয়ে উঠেছে সুপাঠ্য, সুখপাঠ্য। তবু যদি সন্নিবিষ্ট ২৭টি গল্পের মধ্যে বিশেষ হিসেবে চিহ্নিত করতেই হয় তাহলে উল্লেখ করতে হয় ‘অতিমারির দিনগুলো’, ‘’আঁটকুড়া’, ‘আই সি ইউ’, ‘প্রথম ঢেউ’, ‘’দেখা হোক তবে আর জনমে’, ‘নব বসন্ত’, ‘বানভাসি’, ‘বিপন্ন এক কৃষ্ণকলি কথা’, ‘মৌপিয়ার স্বাধীনতা দিবস’, ‘প্রতীক্ষা’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’, ‘মায়ার বাঁধন’, ‘প্রতীকের প্রেরণা’, ‘মন জানালার প্রান্তে’ ইত্যাদি। ‘বাষট্টি দিনের বউ’ কিংবা ‘বউয়ের বয়ফ্রেন্ড’ জাতীয় গল্প শিরোনামে হালকা মনে হলেও ভেতরে রয়েছে নির্মোহ বাস্তবতা। 
গল্পে উঠে এসেছে অতিমারির বিষণ্ণ যাপন কথা, প্রেম ভালোবাসার বিচিত্র অনুষঙ্গ, দারিদ্র্যের বিভীষিকা, দেশভাগ, এনআরসির টানাপোড়েনে মানসিক শোকদুঃখের কথা, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা, ঘৃণা, অনিয়মের পাশাপাশি দায়বদ্ধতা, সহমর্মিতার কথা। একদিকে নির্মেদ, বাহুল্যবর্জিত অথচ বিষয়জনিত ধারাবাহিকতার অচ্ছেদ্য চলন এবং অন্যদিকে এক নির্দিষ্ট নান্দনিক শৈলী গল্পগুলিকে করে তুলেছে অনিঃশেষ পঠনসুখের আকর।
এক ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ, বাঁধাই, ছাপা, অক্ষরবিন্যাস তথা সার্বিক গ্রন্থনা অনবদ্য এবং দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। গল্পকার গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘বিশিষ্ট কবি, অধ্যক্ষ প্রয়াত ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ এবং প্রয়াতা সুখদা সিংহের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে’। বড়জোর এক বা দু’টি গল্প হয়তো পরিসরে, ভাবনায় বাকিদের সঙ্গে মানানসই মনে নাও হতে পারে তবু সেসবেও জীবন্ত লিখনশৈলীতে, চরিত্র চিত্রণে বাজিমাত করেছেন গল্পকার। বানানের শুদ্ধতা গ্রন্থটির অন্যতম সম্পদ যা এ অঞ্চলে সচরাচর বিরল এক অনুভব। সব মিলিয়ে উচ্চ মানের একটি ব্যতিক্রমী গল্প সংকলন - ‘মন জানালার প্রান্তে’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - তুষারকান্তি সাহা, মজলিশ বইঘর।
মূল্য - ২৯৫ টাকা, যোগাযোগ - ৯৪৩৫৫৭৮৯৭১ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...