Skip to main content

ইতিহাসের পুনরাবলোকন ‘মহাত্মা ও শিলচরে নারী জাগৃতির ঊষাপর্ব’


মূলত একটি নিবন্ধ। গ্রন্থকার নিজেও উল্লেখ করেছেন এমন। কিন্তু একটি নিবন্ধ এতটাই বিস্তৃত, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর প্রতিষ্ঠিত তথ্যাদি সম্বলিত যে তা একটি গ্রন্থের সমপর্যায়ভুক্ত হতে পেরেছে। ৫৪ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকে মূলত দুটি বিষয়ভিত্তিক এই রচনা। শিলচরে মহাত্মা গান্ধীর আগমন ও তৎকালীন সময়ে সেই অঞ্চলে নারী জাগরণের বর্ণনা।
‘...শহরে পা রাখলেন বাপুসেই প্রথমবার। তারিখ ২৭ আগস্ট ১৯২১। বাপুর এই আগমন আক্ষরিক অর্থেই ছিল আবির্ভাব। বরাকবাসী আহ্লাদিত...।’ এই আহ্লাদ, আগ্রহ ধরা রয়েছে একটি ধামাইল গানে। গ্রন্থের শ্রীগণেশেই উল্লেখ আছে গানটির। দুটি লাইন তুলে ধরা হল এখানে -
গান্ধি বড় লুক্‌ গ সকি গান্ধি বড় লুক্‌
এ গ গান্ধি রাজে দিছে সড়ক্‌ জল ভরিতে সুক্‌। ...
একটা সময় ছিল যখন ‘গান্ধি’ - এই শব্দে সারা ভারত জুড়ে এক ম্যাজিক মুহূর্ত তৈরি হতোআর সে বরাক উপত্যকায়ও। এমনই এক মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিল শিলচর শহর। সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শহর শিলচর সেদিন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছিল। আর তাদের এই মুগ্ধ-অপলক দৃষ্টির সামনেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাস...।’
১৯৬১র ভাষা আন্দোলন থেকেই শিলচরের ইতিহাস আজকের প্রজন্মের মানুষের মননে প্রোথিত। আলোচ্য গ্রন্থে এক ভিন্ন প্রসঙ্গে দেখানো হয়েছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট যার কালসীমা ১৮৭১ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। গান্ধিজির এতদঞ্চলে আগমনের বিস্তারিত প্রতিবেদন ও তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের পাশাপাশি নারী জাগৃতির অধ্যায়টি বস্তুত এক দলিলস্বরূপ হয়ে উঠেছে আলোচ্য প্রসঙ্গে। তদানীন্তন শহর শিলচর ও সমগ্র উপত্যকার নারী আন্দোলন ও নারী জাগরণ এবং পর্দাপ্রথার ক্রম-বিমোচন বিষয়ক এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আলোচ্য নিবন্ধ তথা গ্রন্থটি। প্রেক্ষাপট, ঘটনারাজি তথা বরেণ্য পথিকৃৎদের জীবনচর্চা ও সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিস্তৃত বর্ণনা গ্রন্থটিকে দান করেছে অনন্য মর্যাদা।
শিলচরে গান্ধির আগমন এবং নারী জাগরণ বিষটিকে গ্রন্থকার ‘নিয়ম ভাঙার ইতিহাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। লিখছেন - ‘...সেদিনই প্রথম নিজেদের উদ্যোগে শিলচরের প্রতিটি পরিবারের কিশোরী, তরুণী-বৃদ্ধারা বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। প্রতিবাদ তাঁদের বাপুর গ্রেফতারির বিরুদ্ধে। ‘বাপু’ নামের এমনই কারনামা। ...স্বাধীনতার লড়াইয়ে মেয়েদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার শুরু তখনই। এর মানে এই নয় যে পর্দা পুরোপুরি উঠে গেল। স্বদেশী আন্দোলনের শুরুর দিকে রাজনৈতিক সভাগুলোতে মেয়েরা মিছিলে পথ হাঁটছেন, এই ঘটনা ছিল চমকে দেওয়ার মতোই, বিশেষ করে শিলচরের মতো প্রান্তিক শহরে। বরাক উপত্যকায় পর্দা ভাঙার শুরু এই মিছিল থেকেই...।’
এভাবেই একের পর ঘটনাবলির প্রাঞ্জল বর্ণনা ও বিশ্লেষণে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে এক নিরবচ্ছিন্ন পাঠের গ্রন্থ। ইতিহাস কথা বলেছে লেখকের কলমে। উঠে এসেছে অশ্রুত, স্বল্পশ্রুত বহু কাহিনি যা গভীর দাগ রেখে গেছে আন্দোলন ও সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রটিতে। উঠে এসেছে বহু সাহসী পুরুষ সিংহ, বহু বীরাঙ্গনাদের নাম ও কীর্তি যার মধ্যে রয়েছেন কামিনীকুমার চন্দ, জ্যোৎস্না চন্দ, অমিতা চন্দ, হিরণকুমারী দত্ত, শ্যামাচরণ দেব, সৌদামিনী দেব, সুপ্রভা দত্ত, মালতী শ্যাম এবং বহু সংগঠন আদির নামও যেমন - শিবসুন্দরী নারী শিক্ষাশ্রম, নারী কল্যাণ সমিতি, শিলচর মহিলা সমিতি ইত্যাদি।
বস্তুত বিস্তৃত প্রেক্ষাপট সহ বিষয়ভিত্তিক এক সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিক বিবরণ আলোচ্য গ্রন্থটি। নিবন্ধেরই মতো কোথাও না থেমে শেষ হয়েছে এই বিবরণ। সেক্ষেত্রে কয়েকটি সুস্পষ্ট অধ্যায়ে বিন্যস্ত হলে হয়তো আরো খানিকটা সরল হত পঠন। গুটিকয় বানান বিভ্রাটের বাইরে অক্ষর, শব্দ, বাক্য থেকে শুরু করে এমনকি প্যারাগ্রাফেরও স্পষ্ট বিন্যাস অবশ্য যথাযথ হয়েছে। বিমান নাথের ছিমছাম প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদও যথাযথ তবে নামলিপি জুতসই হয়নি বলেই মনে হয়েছে। বড় হরফে যতটুকু আছে তা অসমাপ্ত। গ্রন্থনাম এমন হলে মানানসই হতো -
মহাত্মা (বড় হরফ)

শিলচরে নারী জাগৃতির ঊষাপর্ব
কিছু দুস্প্রাপ্য ছবির সংযোজনে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে অধিকতর প্রাসঙ্গিক। প্রকৃতার্থেই ইতিহাসের এক অনন্য পুনরাবলোকন ‘শতক্রতু সুবর্ণচিন্তন কথামালা ২’ এর অনর্গত এই গ্রন্থ যার শেষ পৃষ্ঠায় রয়েছে সচিত্র লেখক-পরিচিতি এবং যা উৎসর্গ করা হয়েছে গ্রন্থকারের ‘পরোক্ষ শিক্ষক তপোধীর ভট্টাচার্যকে’

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - অক্ষরযাত্রা প্রকাশন, হুগলি
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৭৪৯০৭৩০৭ 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...