Skip to main content

যাপনের প্রহসনে গদ্যে পদ্যে অনবদ্য আলপনা


সব্যসাচী লেখক তপন মহন্ত মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত হলেও গদ্যের হাতটিও যে তাঁর পাকাপোক্ত সে হদিস পাওয়া গেল সম্প্রতি চলতি বছরের গোড়ায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দু-দুটি অণুগ্রন্থ দুটিই এক ফর্মার প্রকাশক দৌড় প্রকাশনা, কলকাতা
উভয় গ্রন্থের ক্ষেত্রেই যে কথাটি প্রযোজ্য তা হল কবি এবং গল্পকার - দুই ভিন্ন সত্তার অধিকারী তপন উভয় ক্ষেত্রেই একশো ভাগ নিবেদিতপ্রাণ সে বিষয়েই হোক বা শৈলীতে ছন্দে হোক বা বুনোটে। ভাষার নান্দনিক ও মোক্ষম প্রয়োগ তাঁর লেখার অন্যতম সম্পদ। স্বল্পকালীন পঠনের উপযুক্ত গ্রন্থদুটির নিবিড় পাঠশেষে পাঠকের জন্য থেকে যাবে এক অনাবিল পঠনসুখ - এ অনিবার্য।
 
কুয়াশার জলছবি 
১৬ পৃষ্ঠার আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটিতে রয়েছে ১১টি কবিতা। চার লাইন থেকে শুরু করে প্রায় পৃষ্ঠাজোড়া। প্রথম কবিতা ‘ছায়া’। চার লাইনে কবি এঁকেছেন জীবনের জলছবি। রূপকাশ্রিত কবিতাটির সারমর্ম শুধু নিবিড় পাঠেই সম্ভব। কিছু কবিতা পূর্বপুরুষের স্বদেশ, এদেশ আর নাগরিকত্বের বিড়ম্বনা নিয়ে লেখা। এক একটি পঙ্‌ক্তি, এক একটি পদ্যাংশ যেন গভীর ব্যঞ্জনাপ্রসূত প্রহসন, শ্লেষ আর প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। এর বাইরেও আছে লকডাউন আর যাপিত জীবনের একাধিক অনুষঙ্গ। আছে মোক্ষম একগাদা প্রশ্ন -
নীরবে আঙুল তুলে
শালপ্রাংশু বুড়ো দেখালেন, ...
শতাব্দীপ্রাচীন সেই জরাগ্রস্ত গাছ যেন
আমাদের রক্তমাংসের পিতামহ
আমি সেই মহিরুহের দ্বিপ্রাহরিক ছায়া। (কবিতা - গাছপাথর)
 
যে শ্রমিক নির্মাণ করে স্বপ্নপুরী...
সে কি কোনোদিন স্বপ্নেও ভেবেছিল
রচনা করেছে সে নিজেরই নিবাস ?... (কবিতা - ডিটেনশন ক্যাম্প)
 
...ডোরাকাটা ঢুকেছে ডেরায়
ফোঁস করে ফণা তোলে বাবা
মায়ের দু-চোখ জুড়ে শ্রাবণের ধারা
মনসা ভাসান গান ভয়াতুর বুকে...
ঢুলুঢুলু নেশাতুর শ্রাবণের রাতের প্রহরে
রিমঝিম বর্ষায় মনসামঙ্গল ঘরে ঘরে। (কবিতা - মনসামঙ্গল)
 
অনুযোগ আর প্রহসনের আবহে গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন ‘মহাকালকে, ভালোবেসে যে খেয়ে ফেলে সব লেখাজোখা’। প্রচ্ছদ সৌজন্যে শুভদীপ দত্ত প্রামাণিক। সব মিলিয়ে কিছু নিবিড় অনুভবসঞ্জাত যথোচিত পঙ্‌ক্তির সমাহার ‘কুয়াশার জলছবি’ যে জলছবি মুছে যেতে পারে না এক জীবনে।
 
অণুগল্পের ইকেবানা
৮টি অণুগল্পের সমাহার ১৬ পৃষ্ঠার এই অণুগ্রন্থ। অণুগল্পে বিষয় ভাবনা ফুটিয়ে তোলা এক দক্ষ কারুশিল্পীর বাইরে সম্ভব নয়। ভাষা ও সাহিত্যের কারুকার্যে সেই কাজটি অনায়াসে সাধন করেছেন গল্পকার তপন। প্রতিটি গল্পই বিষয়ে, ভাবনায়, সংলাপে, বুনোটে অনবদ্য হয়ে উঠেছে।
প্রথম গল্প ‘প্রণাম’। একটি জমজমাট গল্প। ‘থিসিসের মা’ শব্দজোড়া চমৎকার। সমাপনে প্রচ্ছন্ন রম্যভাব এলেও গল্পে জুড়ে আছে একাধিক অনুষঙ্গ। জীবন ও জীবিকা, সংস্কারবোধ আদি অনুষঙ্গের চমৎকার উপস্থাপনা। দ্বিতীয় গল্প ‘সিঁদুরে আমগাছ’ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এনআরসির দৌলতে ছিন্ন সম্পর্কের জোড়া লাগার একটি ঘটনার উপর আধারিত। পরবর্তী গল্প ‘সাগরিকা’। ভাষায়, বর্ণনায়, উপমায় সম্পৃক্ত অনবদ্য এক ভালোবাসার গল্প। বস্তুত এমন একটি আবহ অণুগল্পে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে রয়েছে গল্পকারের অসাধারণ মুনশিয়ানা। ‘বীণাপাণির স্বদেশ-বিদেশ’ গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে এক সাহসী উচ্চারণ। শেষটায় সামান্য ট্যুইস্ট থাকলেও আখেরে এক যথার্থ প্রহসন। পরবর্তী গল্প ‘ভাতছড়া’। ব্যতিক্রমী প্লট। সংস্কার পালনের আবহে ঘোর বাস্তবের নির্মম চিত্র।
‘অস্তরাগ’ গল্পেও চিত্রিত হয়েছে অসহায় বাস্তব - জটিল মানসিক অসুস্থতার আবহে। পরবর্তী গল্প ‘হাঁসের অথবা হাসির গল্প’। এনআরসিকে লক্ষ্য করে বোবা-কালা-অন্ধের অস্ত্রে সজ্জিত একটি উপহাসের গল্প। বিষয় ও প্রেক্ষিত ভাবনায় পরিলক্ষিত হয় লেখকের উন্নত চিন্তার ছাপ। শেষ গল্প ‘গ্রাফটিং’। মূলত একটি রম্য গল্প হলেও অন্তর্নিহিতে রয়েছে ‘ডি-ভোটার’ বিষয়ক বিড়ম্বনার আবহ। সুচিন্তিত বিষয়, সুলিখিত গল্প।
গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে তাবৎ অণুগল্পপ্রেমী রসিকদের উদ্দেশে। নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে বিভাবসু। সব মিলিয়ে এক পঠনসুখের সুচয়িত বিষয়ভাবনার সংকলন  এই অণূগল্পের ইকেবানা।
 
বানানের শুদ্ধতা গ্রন্থদুটির অন্যতম সম্পদ। ছাপার মান, অক্ষরবন্যাস যথাযথ হলেও দু-এক জায়গায় ছাপা বিভ্রাট পরিলক্ষিত হয়েছে যা অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়াই যায়। একত্রে এক স্বল্পকালীন সুখপঠনের উপস্থাপনা আলোচ্য গ্রন্থদুটি।

 বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রতিটি গ্রন্থের মূল্য - ৭০ টাকা।
যোগাযোগ - ৯৪৭৭২৫১৪৪৯

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...