নয়নাভিরাম নকলাক
‘দেখা
হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপর - একটি শিশির বিন্দু।’ কিশোর বেলার সাড়া জাগানো এই
আপ্ত পংক্তিটি জীবন ভর গেঁথে রয়েছে মস্তিষ্ক জুড়ে। তাই হিল্লি দিল্লি ছোটাছুটির চাইতে আমি কাছাকাছি ঘুরঘুর করতেই ভালোবাসি
বরাবর। কত যে মুক্তোদানা ছড়িয়ে
আছে আমাদেরই চারপাশে কেই বা তার খবর রাখে আর ক’জনার হৃদয়ই বা আন্দোলিত হয় সেই
মুক্তো পরখ করে ? কিন্তু আমার হয়। তাই তো আন্দামান কিংবা
কাশ্মীর এর চাইতে আমি শনবিলের শান বাঁধানো তীরে কিংবা দোহালিয়ার খাঁজে খাঁজেই বেশি
স্বচ্ছন্দ। কৃত্রিম তাজমহল কিংবা
কুতুব মিনারের চাইতে আমি বেশি আকৃষ্ট হই শিলং-এর পাইন বনের নিরালা পথে কিংবা
তাওয়াং-এর উঁচু উঁচু পাহাড় পথের অন্তরে। কুয়াশা ভেদ করে ছিটকে
আসা কাজিরঙার গাছগাছালির ফাঁকে উদীয়মান সূর্য কিংবা লুইতের বুকে অস্তমিত রবির রক্তিমাভা
আমায় আচ্ছন্ন করে দেয় আপাদমস্তক। অন্তরটাকে খাপ খাইয়ে নেওয়াই বড় কথা। চোখ থাকলে ধরা পড়বেই
সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনাবিল প্রকৃতির অপরূপ শোভা, মন
থাকলেই অনুভবে বেজে উঠবে সুরেলা প্রকৃতির মরসুমি সুরবাহার।
প্রকৃতি আমাদের এই উত্তর
পূর্ব ভারতকে আপন হাতে ঢেলে সাজিয়েছেন সবটুকু উজাড় করে দিয়ে। তাই এখানেই আমার নিত্য সফরের তোড়জোড়। মনপ্রাণ ভরে নিয়ে সংগ্রহ করে নেই নিত্যদিনের সুখের আকর। গত শীতের তীব্র
ঠাণ্ডার মধ্যেই হঠাৎ করে এক সুযোগ এসে যায় পার্শ্ববর্তী রাজ্য নাগাল্যাণ্ডের এক
অপরিচিত, অখ্যাত জায়গায় যাওয়ার। রাজ্য তথা এই দেশের একেবারে পূর্বসীমান্তে
মায়ান্মার সংলগ্ন নতুন জেলা নকলাক-এর সদর নকলাক শহর। জানতাম না কিছুই। তাই খবরটা শুনেই শরণাপন্ন হলাম
সবজান্তা গুগলের। ভেসে এলো কিছু টুকরো টুকরো তথ্য। তা থেকেই বুঝে নিতে অসুবিধে হলো
না যে এবার নিশ্চিত কিছু এডভেঞ্চার এর সুযোগ হবে কপালে।
কর্মসূত্রে বেশ
কিছুদিন কাটিয়েছি নাগাল্যাণ্ডের একমাত্র সমতলীয় তথা রাজ্যের দ্বারস্বরূপ একমাত্র
রেলশহর ডিমাপুরে। এখনও ব্যক্তিগত কর্মসূত্রে ডিমাপুরেই আছি। তাই সফরসূচী তৈরি হলো
ডিমাপুর থেকেই। কর্মক্ষেত্রের ভাড়াগাড়ি বোলেরো করে এক শীতের সকালে রওয়ানা হলাম
ড্রাইভার আছু সহ আমরা মোট পাঁচজন। নকলাক ডিমাপুর থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো কিঃমিঃ।
যেতে অন্তত পনেরো ঘণ্টা। পাহাড়ি পথে এক দিনে এতটা পথ অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাই
ভেঙে ভেঙেই পাড়ি দিতে হবে পথ। প্রথম গন্তব্য মাঝামাঝি দূরত্বের আরেক সমৃদ্ধ জেলা
সদর মোককচঙ। আমার সঙ্গে আছেন আরোও তিনজন সহকর্মী। সমবয়সী মিঃ রায়চৌধুরীর মূল ঘর
কলকাতা। সহায়িকা হিসেবে সোশিয়াল সার্ভে এসিস্ট্যান্ট মিস রংমেই এবং আলো। আমি ও
রায়চৌধুরীর বাইরে সবাই স্থানীয় নাগা উপজাতির। সবাই খুব ভালো হিন্দি জানে। নাগামীজ
আমরাও অনেকটাই জানি। তাই ভাষা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা আদপে কিছুতেই নেই।
বরঞ্চ আন্তরিকতার পয়োভারে শুরু থেকেই খুব উপভোগ্য সফরের সূচনা হলো। ‘আলো’ নামটা
নিয়ে খানিক আলোচনা হলো। কী করে একটি নাগা মেয়ের নাম আলো হতে পারে, আলো শব্দের অর্থ
কী এসব নিয়ে খোশগল্পে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। আছু মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। নিজের গাড়ি,
তাই মায়া খুব বেশি। কথা বলে কম, তবে হাসতে জানে এই যা রক্ষে। গম্ভীর, মুখ ফোলানো
মানুষ দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
বোকাজান-এ এসে
প্রাতঃরাশ। গোটা বিশেক মিনারেল জলের বোতল গাড়িতে উঠিয়ে নেওয়া হলো এখান থেকেই।
বোকাজান সিমেণ্ট ফ্যাক্টরির জন্য বিখ্যাত। আসামের কার্বিআংলং জেলার একটি শহর।
জেলার একেবারে পূর্ব সীমান্তে। পশ্চিমে হামরেন শহরেও আমি গিয়েছি আগে। বিস্তর
দূরত্ব এই দুই শহরের মধ্যে। অথচ একই জেলায় অবস্থিত। আসামের সবচাইতে বড় জেলা ছিল এই কার্বিআংলং। সম্প্রতি অবশ্য একে
পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই জেলায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। যাইহোক বোকাজানে প্রাতঃরাশ সেরে
ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই আসাম-নাগাল্যাণ্ড সীমান্ত মেরাপানি পৌঁছে গেলাম। একেবারেই ছোট
শহর। গেটওয়ে হিসেবেই যা কিছু খ্যাতি। আবার কুখ্যাতিও আছে ঘন ঘন সীমা বিবাদ নিয়ে।
এখান থেকেই আমাদের গাড়ি যেন উড়োজাহাজের মতো উপরে উঠতে থাকলো। সাথে দু’পাশে ঘন
বনানীর একটানা রাজত্ব। সর্পিল বাঁকে বাঁকে আমাদের এ ওর গায়ে কাত হয়ে পড়তে পড়তে
শুরু হলো পাহাড়ি পথের দীর্ঘ যাত্রা। আছু ভাইয়াকে বলে কয়ে গতি একটু কমিয়ে আনা হলো।
নাগাল্যাণ্ড এলাকায় প্রথম জনপদ ভাণ্ডারি। আবার শুরু হলো নামাকরণের বৈচিত্র নিয়ে
আলোচনা। নাগা রাজ্যের জনপদের নাম কী করে ভাণ্ডারি হতে পারে সে কথার মীমাংসা আর হলো
না, তার আগেই গাড়ি পৌঁছে গেল ওখা সংলগ্ন পথপার্শ্বে গড়ে ওঠা শহরতলি চকিটং-এ।
দুপুরের আহার হলো এখানেই। শুরু হলো আমার খাওয়ার সমস্যা। আপাতত শুধু ডাল আর পাপড়
দিয়েই সেরে নিলাম লাঞ্চ। এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না আমার খাদ্যতালিকার মধ্যে।
রায়চৌধুরী সর্বভুক। সুতরাং অন্যরা সবাই তৃপ্তি করেই পেট পুরে খেয়ে আবার উঠে বসলো
গাড়িতে। ডিমাপুরে ঠাণ্ডা প্রায় ছিলই না - বিশেষ করে সকালের রোদে। এবার হিমেল
অনুভূতি টের পেলাম ভালোই। জ্যাকেট সঙ্গেই ছিল। পরে নিলাম। গাড়ি এগিয়ে চললো
মোককচঙের উদ্দেশে। রাস্তা চওড়া হচ্ছে। সব রাস্তা ফোর লেন হবে। উন্নতির ছোঁয়া থেকে
বাদ যায়নি নাগাল্যাণ্ডও। সুতরাং মাঝে বেশ ক’বার থামতে হলো। পাহাড় কেটে রাস্তা করছে
মেশিন - গড়িয়ে পড়ছে মস্ত বড় বড় পাথরের চাঁই। সব কিছু অতিক্রম করে বিকেল প্রায়
চারটেয় এসে পৌঁছলাম মোককচঙ। আগে থেকেই হোটেল বুক করে রাখা ছিল এক রাতের জন্য।
শহরের একেবারে সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো হোটেল হুইস্পার উইণ্ডস।
রংমেই আর আলোর চোখ ছানাবড়া। নাগাল্যাণ্ডে এত বড়, এত সুন্দর হোটেল - ওদের কল্পনায়
ছিল না। রুমে ঢুকে তো একেবারে উচ্ছসিত। ঠাণ্ডা ততক্ষণে জাঁকিয়ে বসেছে। রাতের
খাবারের অর্ডার দিয়ে দেওয়া হলো। আজ বেশি দেরি করা যাবে না। কাল নকলাক অভিমুখে সারা
দিনের সফর।
উপরে ডাইনিং হলে
যাওয়ার পথে বাইরে তাকিয়ে চোখ দু’টো যেন বিস্মিত হয়ে গেল। আলোর রোশনাই-এ উদ্ভাসিত
মোককচঙ। দূরে আবছা আলোয় পাহাড় আর কুয়াশার চাদর পেরিয়ে একা চাঁদের ঔজ্জ্বল্য যেন
স্থবির করে দিয়েছে আমাকে। সফরসঙ্গীদের তাড়ায় হুঁশ ফিরে পেয়ে নিমেষে রাতের খবার
সেরে আবার এসে দাঁড়ালাম বাইরে। অপলক তাকিয়ে আছি দূর পাহাড়ের দিকে। জীবন ধারার
প্রতিটি মোড় যেন ফিরে ফিরে আসছে কল্পনার হাত ধরে। কোথাকার আমি এখানে এলাম কী করে ?
শুনেছি একটা সময় বাংলা ছোটপত্রিকা বেরোত এখান থেকে। প্রকৃতির এমন শোভায় শোভিত
মানুষের কল্পনা থেকে সাহিত্যের স্ফূরণ তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এত সৌন্দর্য যে
লুকিয়ে থাকে রাতের পাহাড়ে তা তো আগে জানতাম না। সাবলীল পাহাড়ি নদীর স্রোতের মতোই
অন্তর তোলপাড় হয়ে বেরিয়ে এলো ভাবনা - কবিতার হাত ধরে -
এই যে ঘন
হিমের পরশ
ঘুমন্ত এই
সাঁঝের বেলায়
দূরান্তের এই
পাহাড় পথে
আকাশ জোড়া
গোপন প্রেমের
নিভৃত
রাত্রিবাস -
এ তো
নিত্যদিনের অভিসারের
সলাজ অধিবাস।
কোন সে
চিত্রকরের
জানি না সে
কোন যে গরজ।
জানি শুধু
দিবস যাপন
নিক্তি ধরে
মঞ্চ জুড়ে
কুশীলবের নাম
ভূমিকায়
বাঁধা ছকের
সব আলাপন।
এমন করেই নৈশ
নিঝুম বেলায়
আমি তুমি সে
ও সখা
ভুলেই থাকি
দুঃখ ব্যথা যত,
এমনি করেই
পার হয়ে যাই
জীবন নদীর
এপার ওপার
যাই হারিয়ে আকাশ-জমিন মেলায়।
#####
পরদিন সকাল সাতটায়
কথা ছিল যদিও চা-পর্ব সেরে বেরোতে গিয়ে প্রায় আটটা বেজে গেল। হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে
মালপত্র তুলতে গিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। স্থাপত্যবিদ্যার
অসাধারণ নিদর্শন এই হোটেল। পাহাড়ের গায়ে
থরে থরে সাজিয়ে তোলা হয়েছে যেন এই প্রাসাদোপম নিরালাবাসের ঠিকানা। তাকাতে তাকাতেই আরেক চমক। হোটেলের এক দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে অনেকগুলো। অনুসন্ধিৎসু মন। ধীরে ধীরে ওদিকে
যেতেই চোখে এলো এক নাতিগভীর পুকুর। পুকুর ? এই পাহাড়ের
উপর ? নিজের চোখদু’টোকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল
না। কাছে যেতেই নজরে এলো একটি সাইনবোর্ড। পুকুরের ব্যাপারে স্পষ্ট লিখা আছে সেখানে - এই পাহাড়টির
চূড়া থেকেই একসময় বইতো নিরন্তর জলধারা। ক্রমে সেই জলধারাই দদীর আকার পেয়ে ভাটিতে আসামের জাঁজী নদীতে পর্যবসিত
হয়েছে। মনে পড়ে গেল জোড়হাটের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জাঁজী
নদী। উজান আসামের পথে এই নদীটি পেরোতেই হবে। সুস্বাদু মাছের ভাণ্ডার এই নদী। আচ্ছা, তাহলে এখানেই জাঁজী নদীর উৎপত্তি
? এখন সেই জায়গাটিকে পুকুরের আকারে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। সারা বছর জল থাকে এই পুকুরে। বৃষ্টি না হলেও। কিমাশ্চর্যম !!
এবার যাত্রাপথ হলো
মোককচঙ থেকে তুয়েনসাং হয়ে নকলাক। রাস্তার হাল দেখে মনে পড়ে গেলো পঁচিশ তিরিশ বছর
আগের কথা। আজো সেরকম রাস্তা আছে তাহলে। তিনটে জেলা সদরের সংযোগী রাস্তা এতখানি
এবড়োখেবড়ো হতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না। ঘণ্টায় বড়জোর বিশ কিলোমিটার বেগে এবং দুই
নম্বর গিয়ারেই চলতে লাগলো গাড়ি। এরই ফাঁকে সর্বভুক রায়চৌধুরী তাঁর খানা খাজানার
গল্পে সামিল করে নিয়েছেন রংমেই আর আলোকে। মাঝে মাঝেই যোগ দিচ্ছে আছু ভাইও। ফড়িং
থেকে মিথুন, ঝিঁঝিঁ পোকা থেকে বাঁদর। সব আমিষ খাদ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে লাগলো
পেছনে। আমি সামনে বসে মগ্ন হয়ে রইলাম ঘন পাহাড়ের রহস্যময় সৌন্দর্যের রূপ আস্বাদনে।
ঘণ্টা দুয়েক পর চারে নামের জায়গাটিতে সাঙ্গ হলো সকালের প্রাতঃরাশ। চা, পুরি আর
সঙ্গে থাকা মুড়ির মোয়া। আবার শুরু হলো পথচলা। একের পর এক গ্রাম - কিডিং, ট্রঙ্গার,
আঙ্গাংবা, হেলিপং হয়ে দুপুর আড়াইটায় তুয়েনসাং। পেটের ভেতর ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে
ইঁদুর দৌড়। কিন্তু খাবার হোটেল কেন কোনও দোকানই তো খোলা নেই। জানা গেল রবিবারে
এখানে সব বন্ধ থাকে। সবাই চার্চে চলে যায় প্রার্থনার জন্য। শুধু এখানেই নয়। পুরো
রাজ্যেই এক অবস্থা। শেষমেশ এক পথের ধারের বন্ধ হোটেলের দরজা খুলিয়ে খানিকটা গরম
জলের ব্যবস্থা করলো আলো আর রংমেই। সঙ্গে থাকা কাপ-ও-নুডলসে গরম জল ঢেলে হলো সাময়িক
ক্ষুন্নিবৃত্তি।
দেরি না করে চলতেই
থাকলো গাড়ি। কিছু কথা, কিছু ঝিমুনির ককটেলে একটা সময় ফুরিয়ে এলো দিনের আলো। সন্ধের
পর পাহাড় ঘেরা এক চিলতে রাস্তা ধরে চলছি তো চলছিই। এ যেন এক অনন্ত যাত্রা। একেকটা
বাঁক পেরোলেই চোখে পড়ে আরোও চারটে বাঁক। দূরে কোথাও কোন কোন পাহাড়ের গায়ে ততক্ষণে
জ্বলে উঠেছে আলো। মনে হয় ওই বুঝি আমাদের গন্তব্য। পরক্ষণেই মিলিয়ে যায় চোখের সামনে
থেকে। আবার ভেসে ওঠে হঠাৎ করে। এমনি গোলকধাঁধার পথ পেরিয়ে একটা সময় রাত প্রায়
সাতটায় পৌঁছে গেলাম নকলাকের প্রধান চৌরাস্তায়। থামতে বলা হলো আছুকে।
আগে বলা হয়নি। নতুন
জেলা সদর নকলাকে কোনও হোটেল নেই। কিছু সরকারি গেস্ট হাউস আছে। কিন্তু পরদিন
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সব বুকিং হয়ে আছে আগে থেকেই। সেই হিসেবে
আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল নকলাক সংলগ্ন একটি গ্রাম নকিয়ানের ব্যাপ্টিস্ট
চার্চের গেস্ট হাউসে। নকলাক পয়েণ্টে গাড়ি থামতেই এগিয়ে এলো দু’টি ছেলে। আগে থেকেই
যোগাযোগ করা হয়েছিল। ওরা নকিয়ান গ্রামেরই ছাত্র। নেমে পরিচিত হলাম ওদের সঙ্গে। আলো
জন্মসূত্রে ওই অঞ্চলেরই মেয়ে। তাই স্থানীয় উপজাতি ভাষা চাং খুব ভালো করেই জানে।
ছেলে দু’টি এতটা আশা করেনি। খুব খুশি হলো। খুশি হলো আলোও। গেস্ট হাউসের পথে আমাদের
এগিয়ে নিয়ে গেল বাইকে বসা ছেলে দু”টি। চার্চের কম্পাউণ্ডের ভিতরেই স্কুল ঘরের মতো
গেস্ট হাউস। আমাদের জন্য দু’টি রুম আগে থেকেই বরাদ্দ করা ছিল। আছুর জন্য অপর একটি।
জিনিসপত্র নামিয়ে ঘরে ঢুকে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
কনকনে ঠাণ্ডায় ইতিমধ্যে
হাত পা হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এর মধ্যেই বারান্দায়
বেরিয়ে রাতের নকিয়ানকে একবার দেখে নেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাকিয়ে যেন চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। রাতেরও এত নীরব সৌন্দর্য। উপরে পাহাড়ের ঢল বেয়ে গ্রাম। বাড়ি ঘরের আলোর
ফুলকি দেখে মনে হয় যেন তারকাখচিত আকাশ নেমে এসেছে ধরণীতে। মস্ত বড় চাতাল। গীর্জার পাশেই
গেস্ট হাউস। গেস্ট হাউসের কাছাকাছি আলাদা রান্নাঘর। নাগাদের রান্নাঘরের বিলাসিতা সবখানেই দেখার মতো। এখানেও ব্যতিক্রম নয়। প্রশস্ত প্রকোষ্ঠের ঠিক মাঝামাঝি খোলা উনুন জ্বলতেই থাকে। উনুনের উপর মাঁচা বেঁধে নানা রকম আমিষ খাদ্যসামগ্রী। ঝলসানো হচ্ছে দিনের পর দিন। এর চারপাশে বসে আগুনের তাপ নেওয়ার জন্য বসার ব্যবস্থা। এক পাশে খাওয়ার বেঞ্চ ও টেবিল। রাত তখন প্রায় সাতটা বাজে। খাওয়ার তাগাদা এসে গেল। খানিকটা তরতাজা হয়ে সবাই মিলে রান্নাঘরে গেলাম। আগুনের পাশে সার দিয়ে রাখা মোড়ায় বসে খাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। অনেকগুলো পদ রান্না করে রাখা আছে আমাদের জন্য। কিচেনের দায়িত্বে আছে একটি স্বল্পভাষী নাগা ছেলে। ওর নাম পুচং। ওর কথা বিস্তারিত লিখবো পরে। সব চাইতে আশ্চর্য
হলাম একটি মেয়েকে দেখে। সে আমরা আসবো
বলে স্বেচ্ছা সেবায় এসেছে। রান্না ঘরের দায়িত্ব
অনেকটাই সামলেছে পুচং-এর পাশাপাশি। কথায় কথায় জানা গেল ও ইতিমধ্যে এনথ্রপোলোজি নিয়ে মাস্টার্স করেছে। অবাক হলাম এদের দায়বদ্ধতা আর এসব ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এও জানা গেল - কাল অন্য কেউ আসবে এই
দায়িত্ব সামলাতে। রাতেই এলেন গীর্জার
প্যাস্টর। খবরাখবর নিলেন। ব্যবস্থাপনা সব দেখে নিলেন। এত কদর, আপ্যায়নের
এত আন্তরিকতা দেখে ভীষণ ভালো হয়ে গেল মনটা। সারা দিনের অভুক্ত থাকার ব্যাপারটা যেন ভুলেই গেছি। কিন্তু খেতে বসেই বিপত্তি। সবগুলো পদেই বাঁশের গুড়ো (ব্যাম্বু
শ্যুট) দিয়ে সুস্বাদু বানানো হয়েছে। কিন্তু এই বস্তুটি গন্ধ আমি মোটেই সহ্য করতে পারিনা। তাই মুখে দিতে পারলাম না কিছুই। শেষে শুধু লবণ মেখেই দু’এক গ্রাস
ভাত মুখে তুলে নিলাম। ব্যাপারটা দেখে
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো পুচং এবং সেই মেয়েটি। এবার মেয়েটি এগিয়ে
এসে জিজ্ঞেস করলো ডিম খাবো কি না। আমি মাথা নেড়ে
সায় দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ডিমের ওমলেট বানিয়ে দিল। আমারও খাওয়া হলো আর ওরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। খাওয়া শেষে আবার ফিরে এলাম রুমে। রাত বড়জোর আটটা হবে তখন। এত তাড়াতড়ি কি আর ঘুমানো যায় ? খানিক বইপত্র পড়ে, মোবাইল হাতে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে খানিক বিচরণ করে ঘুমোতে যাওয়ার আগে টয়লেটে
যাবো বলে বাইরে বেরোতেই আবার সেই সুন্দরী রাতের দৃশ্য নজরে এলো। এবার আকাশ আলো করা চাঁদ যেন নেমে এসেছে পাহাড় পেরিয়ে
একেবারে হাতের মুঠোয়। ওদিকে মোহময়ী
পাহাড় যেন চাঁদের আলোয় আপাদমস্তক প্রসাধনে মগ্ন। দৃষ্টি যেন আটকে রইল সেই ‘একটি শিশির বিন্দু’র উপর। দাঁড়িয়ে রইলাম
একাকী। চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে যেন। মনের ভেতর জীবনধারার আলেখ্য। কত কথা, কত যাপন বেলার বৃত্তান্ত সব যেন
এসে ভিড় জমালো অন্তরে। এত সৌন্দর্য, জীব ও
নির্জীবের ফারাক নিমেষে উধাও হয়ে যায় এমন দৃশ্যকল্পে। একে একে সামনে এসে দাঁড়ায় যত আপন, যত মন উজাড় করা চিত্র
- সে যে আমার স্বপনচারিণী। আহা, পাশে যদি দাঁড়াতো এসে। কবিতা যেন কুলুকুলু ঝরনার মতো পাহাড় বেয়ে তরতরিয়ে নেমে এলো মনগগনে -
কেমন সখ্য
চাঁদ পাহাড়ে - আহা
সারাটি রাত
শুধুই লুকোচুরি।
একা চাঁদ
বিলিয়ে সোহাগ
সামলে রাখে
নগ্ন পাহাড় সারি।
আকাশ বেয়ে
পাহাড় জাগে
দেখবো ছুঁয়ে - আয় না ছুটে চাঁদ
বাঁকা চাঁদ
পালায় ধীরে ধীরে
বিছিয়ে
প্রেমের পাহাড় জোড়া ফাঁদ।
পূবের আকাশ
সাক্ষী সেজে রয়
আমিও আজ
কিশোরী রাতের পাশে
অপলকে জুড়াই
নয়ন সুখ
চেনা মুখের আদল শুধু ভাসে।
###
দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম
থেকে উঠেই নজরে এলো কাল রাতের উদ্ভাসিত চাঁদের জায়গা নিয়েছে শীতের আমেজ মাখানো রৌদ্রের
উৎস সূর্য। এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম চারপাশের পরিবেশ। সামনেই বড়জোর বিশ পা দূরেই বিশাল গির্জা। শান্ত সমাহিত যিশুখ্রিস্টের পবিত্র ক্রস খচিত গির্জা
যেন প্রেম ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের মূর্ত প্রতীক। ভাবলাম একবার
ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে। গির্জার ভেতরে
কখনো ঢোকার সুযোগ হয়নি। ওদিকে উঁচু পাহাড়ের
গায়ে সজ্জিত গ্রামের বাড়িগুলো। গির্জার কাছাকাছিই
এসে শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে সকালের চা নিয়ে হাজির পুচং। চা খেয়ে স্নানটান সেরে বেরিয়ে পড়লাম কাজে। সারা গাঁ ঘুরে বেড়াতে হবে তাই সঙ্গে নিলাম স্থানীয়
সেই ছাত্র ছেলেদের। বড়ই অমায়িক এবং নম্র স্বভাবের ছেলেগুলো। পইপই করে ঘুরে দেখালো গ্রাম। চড়াই আর উৎরাই-এর পদযাত্রায় যতটুকু না
কষ্ট হচ্ছিল তার চাইতে ঢের বেশি আনন্দ হচ্ছিল নতুন জায়গার সাথে, মানুষজনের জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হয়ে। সাথের মেয়ে দু’টোও খুব আনন্দিত। গ্রামে মোট একশোটির মতো ঘর এবং চারশোর মতো জনসংখ্যা। সবগুলো পরিবারই মূলতঃ কৃষি অর্থাৎ জুমখেতি নির্ভর। কিছু সংখ্যক সরকারি চাকুরে। প্রতটি ঘরের সন্তানরাই শিক্ষিত। অনেকেই পড়াশোনা করছে। স্কুল কলেজের অভাবের জন্য মূলতঃ অনলাইনেই পড়াশোনা। কেউ কেউ তুয়েনসাং, কোহিমা
কিংবা আরোও দূরে শিক্ষারত। গ্রামের বিভিন্ন
জায়গায় মাচাং বেঁধে কিছু ঘর দেখতে পেলাম। উঁচু এই ঘরগুলোর
ভেতরে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছের কাণ্ডের ভেতরটাকে ফাঁকা করে গোলাকৃতি আকার দেওয়া হয়েছে। এগুলো কী জিজ্ঞেস করায় ছাত্ররা বুঝিয়ে দিল। ওগুলোকে বলে কাম মরং। আগেকার দিনে যখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল একেবারেই সীমিত তখন গ্রামপ্রধান
বা পূর্বপুরুষরা এইসব প্রকাণ্ড গাছের গুড়িতে অন্য একটি কাঠের দণ্ড দিয়ে আঘাত করে জোরে
জোরে শব্দ সৃষ্টি করতেন। তখন গ্রামবাসীরা
বুঝতো যে কোনও ব্যাপারে আলোচনার জন্য ডাকা হচ্ছে। তখন সবাই ছুটে আসতো। এসব শুনে শুনে
আমি যেন হারিয়ে যাছিলাম সেইসব দিনগুলোতে যখন যোগাযোগের অভাবে মানুষ যেভাবে দিন কাটাতো
তা আজকের দিনে আমাদের কল্পনারও অতীত।
দুপুর প্রায় তিনটে নাগাদ
কাজকর্ম সেরে এসে দেখি পুচং আমাদের অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে। ভীষণ মায়া লেগে গেল ছেলেটার উপর। না খেয়ে আছে অথচ মুখের হাসিটি কিন্তু অম্লান। খেতে গিয়ে আরোও অবাক। আজ কোনও পদেই
বাঁশের গুড়ো নেই। অর্থাৎ আমার উপযুক্ত খাদ্য। বিকেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধে নাগাদ একটু চায়ের
কথা বলবো ভাবছি অমনি দেখি চায়ের পেয়ালা হাতে হাজির পুচং। প্রচণ্ড কর্মদক্ষ। রাতে রান্নাঘরের
উনুনের চারপাশে বসে আছি। পুচং এসে জিজ্ঞেস
করলো - কাল মাছ খাবেন ? আমার তো শুনেই মুখে মুচকি হাসির ছোঁয়া। বললাম কী মাছ পাওয়া যায় ? বললো
- রুই আর পাংগাশ। বললাম - রুই
হলে চলবে। খুব খুশি হলো পুচং। আমাকে উপযুক্ত খাওয়া যুগিয়েই যেন ওর যত আনন্দ। মাঝে মাঝে উদাস দৃষ্টিতে তাকায়। জিজ্ঞেস করায় বললো - আপনি কিছুই খেতে পারছেন না। বললাম - কোথায় খাচ্ছি না। সবই তো খাচ্ছি এখন। কিন্তু এরকম না করে অন্যদের পছন্দের খাবারও বানাবে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস আমি নাগামিজ বুঝতে পারবো না। তাই আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলে। খুব ধীরে ধীরে কিন্তু একেবারে নির্ভুল হিন্দি ওর। রাত আটটার মধ্যে দ্বিতীয় রাতের খাওয়াও শেষ। ফিরে এলাম রুমে। দিনের কাজের কিছু নোট লিখে রাখতে গিয়ে প্রায় দশটা বেজে গেল। ঠাণ্ডায় হাত পা যেন জমে যাচ্ছে। কাজ শেষ করে এই প্রথম পেছনের বারান্দার দিকের দরজাটা
খুললাম কৌতূহলবশতঃ। দরজা খোলার সাথে সাথেই যেন আরেক বিশ্বদুয়ার খুলে
গেল চোখের সামনে। আশ্চর্য, কাল কেন খুলে দেখলাম না এ দরজা
? এই পাহাড়গুলোকেই তো খুঁজছিলাম কাছে থেকে দেখবো বলে। দিনের বেলা সময় করে উঠতে পারিনি। ওই পাহাড়গুলোর ওপারেই তো ভিন দেশের সাকিন। সেই ব্রহ্মদেশ, রেঙ্গুন - শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পটভূমিকা। আজকের মায়ান্মার। পাহাড়গুলো কি
তা জানে
? দেখে তো মনে হলো না। কাল্পনিক সীমারেখাকে
যেন বিদ্রুপের হাসিতে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রাতের কুয়াশা, চাঁদ
আর অসীম আকাশকে সাথে নিয়ে আরেক নতুন রসায়ন। বিশাল পাহাড়ের সারি গুলো দীর্ঘ ঢল বেয়ে যেন এ ওর গায়ে শুধুই ঢলাঢলি। ওদিকে আকাশের চাঁদকে ছোঁয়ার যেন এক প্রতিযোগিতা। আমার মন প্রাণ জুড়ে শুধু মগ্ন বিস্ময়ের উথাল পাথাল। জ্যোৎস্না বেয়ে শেষ রাতের মায়াবী পথে এগিয়ে এসে
ধরা দিল তৃতীয় রাতের কবিতা -
দাঁড়িয়ে
আছি সীমার এপারে
ওপার জুড়ে
আস্ত একটি দেশ,
মাঝে পাইনি
দেখা কোথাও সীমারেখা -
হারিয়ে গেছে
মেঘ পাহাড়ের খাঁজে।
ঢাল বেয়ে
নেমে একের পর এক পাহাড়
এ ওর গায়ে
শুধুই ঢলাঢলি,
কে জানে কোন
দেশের সীমারেখা
কোন সে
দিশায় কোন পথে যে গেছে।
ভোরের বেলা
সরিয়ে কুহেলি চাদর
রোদ ঝলমল
আকাশটাকে দেখে,
সারা বেলা
কাটায় সঙ্গোপনে,
শেষ
সন্ধ্যায় জোছনা গায়ে মেখে
এপার ওপার সব
একাকার করে -
মুচকি হাসি
দেয় ছড়িয়ে
কল্পনার ওই সীমারেখা জুড়ে।
###
পরদিন সকালে উঠে এক
অবাক দৃশ্য। মাঝেমাঝেই দেখছি কেউ কেউ আসছেন হাতে করে এক একটি মুর্গি নিয়ে। এক
ফাঁকে গিয়ে পুচংকে জিজ্ঞেস করলাম - ব্যাপার কী ভাই ? মুচকি হেসে বললো - স্যর, আপনি
যে অন্য কিছু খান না এই খবরটা সবাই জেনে গেছে। তাই।
আমি তো এসব শুনে
একেবারে হতভম্ব। এমনও হয় ? যাই হোক, কী আর করা যাবে। এতগুলো মুর্গি শেষ করতে হলে
আমাকে নির্ঘাত আরোও সপ্তাহ খানেক এখানেই থাকতে হবে। তাই, পুচংকে বললাম এসব শেষ
করতে।
জীবনে প্রথম বারের
মতো স্থানীয় একজন লোককে সঙ্গে করে গিয়ে ঢুকলাম গির্জার অভন্তরে। মঞ্চে মস্ত বড়
ক্রস। ফাদার এবং প্যাস্টরের বসার জায়গা। নিচে প্রায় হাজার মানুষের বসার জায়গা।
ভক্তিভরে অনুভব করলাম পরিবেশ। এইসব পর্বতবাসীদের আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিক্ষিত করে
তুলতে খ্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের অবদানও কিছু কম নয়। আজ থেকে বহু বছর আগে দুর্গম,
প্রত্যন্ত পাহাড়ে এসে আস্তানা গেড়ে অসীম কষ্টে ছড়িয়ে দিয়েছেন আধুনিকতার আলো।
আবার কাজের তাড়নায়
কেটে গেল দিন। ছুটে বেড়িয়েছি সারাটি শহর। শহর নকলাক বলতে কিছু সরকারি অফিস আর গোটা
বিশেক দোকান। এ নিয়েই যাত্রা শুরু নতুন জেলার। দেখা হলো নতুন জেলার অতিরিক্ত
উপায়ুক্ত এবং পুলিশ প্রধান ম্যাডামের সঙ্গে। দূর হরিয়ানা থেকে আসা সাহসী এই
অফিসার-এর কী অসীম ব্যক্তিত্ব। অভিভূত হয়ে গেলাম তাঁর সাথে কথা বলে। খবর পাওয়া গেল
মুখ্যমন্ত্রী নাকি এই নতুন জেলার নামাকরণ করেছেন ইস্টার্ন ফ্রণ্টিয়ার বলে। আমার
কিন্তু স্থানীয় ভাষার নকলাকটাই পছন্দ ছিল।
দুপুরের খাওয়া আজ
বাইরেই খেতে হলো। খুঁজে পেতে একটা ভাতের হোটেল পাওয়া গেল। মন্দ নয়। তাপমাত্রার
পারদ ক্রমাগত নামতে নামতে এদিন ছয় ডিগ্রিতে পৌঁছেছে। কাবু হয়ে পড়ছি যেন ক্রমশঃ।
এরকম অবস্থায় গরম গরম ডাল ভাত ভালোই খেলাম। সঙ্গীরা পর্ক সহযোগে ভুরিভোজন সারলেন।
কাল শেষ রাতের পর থেকেই ঘন কুয়াশার চাঁদরে যেন অবগুণ্ঠিত হয়ে আছে অপরূপা নকলাক।
আমার যেন দেখে দেখে আর আশ মেটে না। যাই হোক। কাজ সেরে আবার ফিরে এলাম ডেরায়। আজ আর
দেরি নয়। দিনের আলো ফুরিয়ে যেতেই পেছনের বারান্দায় চেয়ারখানা পেতে তাকিয়ে রইলাম
দূর পাহাড়ের দিকে নির্নিমেষ। আশ্চর্য, ওদিকে তাকালেই কবিতাগুলো কেমন যেন হাতের
ঈশারায় ডেকে নেয় আমাকে। চলতে থাকে আঙুল -
দিন তিনেকের
আনাগোনায়
কেমন যেন
আটকে আছি মায়ার বাঁধনে
খুবই কাছের, খুব
চেনা সব।
তাকিয়েই
থাকি অপলক -
পেছনের এক
ফালি ঝুলবারান্দায়
ছুটে যাই বার
বার এক অমোঘ টানে,
চেয়ারখানায়
বসে থাকি নির্নিমেষ।
কথা বলি চোখের
ভাষায় - ওরাও বলে,
মুহুর্মুহু
সাজিয়ে গুছিয়ে বদলায় নিজেকে।
আমি অবাক হয়ে
তাকিয়ে দেখি
তাদের
যুগান্তরের সখ্য।
এ ওর গায়ে
হেলান দিয়ে
যুগ যুগ ধরে
শুয়ে থাকে ওরা
সবাই মিলে
তাকিয়ে আকাশ পানে।
আমিও ভাবি
তাদেরই মতো
নীল আকাশে
কোন সে পারাবার
যেখানে - পানসি ছুটে সারা বেলা,
কিংবা অহরহ
ভাসে দুষ্টু মেঘের ভেলা ?
কখনো ওরা
নীলাম্বরী,
কখনো শুভ্র বসনা
কখনো আবার
আপন ছাঁচে
সেজে ওঠে ওরা
সবুজের সমারোহে।
এতদিনের
নীলপাহাড়ি -
এবার আমার
অন্তরঙ্গ
আপন পরাণ সখা,
এতদিনে ধন্য হলো দেখা।
###
আজ সকাল থেকেই শুরু
হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আনাগোনা। তাপমাত্রা নেমে চারের কোঠায়। তবে কি বরফ পড়বে ?
সকাল হতেই বিদায় বেলার অনুষঙ্গে সবার মন খারাপ। চা-পর্ব শেষ হতেই ধীরে ধীরে জড়ো
হতে থাকলেন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। প্যাস্টর মশাই এসে দুঃখ করে বললেন -
আপনাদের ঠিক মতো দেখভাল করতে পারলাম না। এসেছেন গ্রাম সভার সব পদাধিকারীরাও। বিদায়
নহবত যেন বেজে ওঠার অপেক্ষায়। পাশের কোঠায় অবস্থানরত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমরা ছ’জনের
হাতে তুলে দিলেন স্থানীয় জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা আসল মধুর ছয়টি বোতল। এবারে সবাই
মিলে সমস্বরে আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য গেয়ে উঠলেন প্রার্থনা সঙ্গীত।
সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতায় কানায় কানায় ভরে উঠছে
হৃদয়। চোখদু’টো যেন সিক্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আমি তাকিয়ে আছি পুচং-এর বিষণ্ণ মুখটির
দিকে। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। শুধু মনে মনে বললাম - তোমায় ভুলবো না পুচং
এ জীবনে। এত যত্ন, এত আদর - এ কি ভুলার ? গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই। ফেরৎ যাত্রার
নহবতে এবার পূর্ণ সঙ্গত করতে লাগলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। যেন আমাদের বিদায়ে প্রকৃতিও
আমাদেরই মতো হয়ে আছে সিক্ত। নকলাক-এ কিছুই নেই। কিন্তু যা আছে তার মূল্যায়নে, তার
স্মৃতির রোমন্থনে কেটে যাবে বাকি থাকা দিনগুলো। ফেরার পথে স্যাডল নামের জায়গাটিতে গাঢ়
মেঘের মধ্যে পথের পাশের চায়ের দোকানের আড্ডা এ জীবনে ভুলতে পারবো না।
সব মিলিয়ে শেষ হলো
অসাধারণ এক সফর। শেষ হলো প্রতি রাতের কবিতার হাত ধরে ছুটে চলার অনন্যসুন্দর যাপন
বেলা - মনের মধ্যে কত কথার কথকতা যেন অফুরান আবেগে আবার ধরা দিল এসে কবিতা হয়ে -
লুকিয়ে আছে
বনানী আজ মেঘের আড়ালে
সারা গায়ে
জড়িয়ে চাদর
সারাটি দিন
মগ্ন অলস ঘুমে।
কাল, সন্ধে
হতেই হিমের পরশ
জাপটে ধরে
ঝিরিঝিরি,
সেই সুখেতে
শীত ঘুমের এই
অলস বেলায়
শিশির মেখে
ঘুমিয়ে আছে
তন্দ্রাবিভোর
একের পর এক
সুপ্ত হিমালয়।
নীল পাহাড়ের
এ আস্তানায়
উঠলো বেজে
বিদায় বেলার গান।
সাঙ্গ হলো প্রতি রাতের
পংক্তি ধরে
মনের কথার
রঙিন সুরের
তান।
- - - - - - - - - - -
Comments
Post a Comment