Skip to main content

আদিমা মজুমদারের ‘দামিনী এবং অন্যান্য গল্প’



দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হাতে এলো বিশিষ্ট গল্পকার আদিমা মজুমদারের চতুর্থ গল্প সংকলন - ‘দামিনী এবং অন্যান্য গল্প হয়তো সোজাসুজি গল্পবিশ্বে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন বলেই ভূমিকা এখানে নিষ্প্রয়োজন তাই নেই কোনও নান্দীমুখ আছে শুধু অণিমা বৈদ্য ভট্টাচার্যের সংক্ষিপ্ত কথামুখ এবং এই কথামুখেই সম্যক ভেসে আসে গল্পকার ও সংকলনের গল্পসমূহের এক অতি সংক্ষিপ্ত সারাৎসার।
মোট ৮৩ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ১৫টি গল্প। এর আগেও এই সফল গল্পকারের সাবলীল গল্পময় চলনের যে পরিচয়টি পাওয়া গেছে সেই একই ধারায় এখানেও আদিমা স্বচ্ছসলিলা কিন্তু অতি অবশ্যই খরস্রোতাও বটে। কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, গল্পকার তাঁর এই সৃষ্টিকে সমর্পণ করেছেন ‘অতীব স্নেহে মমতায়, প্রিয় জন্মস্থান - ইছারপার’কে। জন্মভূমির প্রতি তাঁর এই দায় দাগ কাটে মনে।
এই গল্পকার আমাদের অতি কাছের জন এবং তাঁর সোজাসাপটা ভাবপ্রকাশের ধারার সঙ্গে আমরা খুব বেশি পরিচিত। ব্যতিক্রম নয় ‘দামিনী’ও।
“দিঘি থেকে উঠে এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াই মামার ঘরের চারপাশে এলোমেলো পায়ে এদিক ওদিক ছুটতে থাকি আসাম টাইপ ঘর - - - - - - দক্ষিণ দিকে আরেকটি ছোট ঘর খেলাঘরের মতো মুরগি, মুরগির বাচ্চা উঠছে নামছে - - - - - উৎসুক হয়ে ঘরের কাছে যাই কী যেন লেখা দরজার উপরে, মাতৃভাষা বাংলায় ঘন রঙ দেওয়া হয়েছে তবু লেখাগুলো স্পষ্ট বুঝা যায়হরে কৃষ্ণ হরে রাম লেখাটির উপর আমার চক্ষু কতক্ষণ স্থির ছিল বলতে পারবো না বুকটা ধুকধুক করতে থাকে এ যে ঠাকুর ঘর ছিল শকড হয়ে যাই ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে আমার চোখ থেকে তুলসী বেদীতে দেখি কামরাঙা মরিচের গাছ জীবনে এমন বিষদৃশ্য কখনো দেখিনি - - - - - আহা, কোন হিন্দু লোকের বাড়ি ছিল, কত কষ্ট করে ঠাকুর ঘরটা পাকা করেছিল - - - - - দেশ ভাগের সময় মুসলমানরা হিন্দুর বাড়ি দখল করেছে শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি আজ নিজের চোখে দেখে নিজেকেই ধিক্কার দেইএই বাড়ির লোকজন কোথায় আছো গো কেমন আছো তোমরা’ ? খেতে বসে খেতে পারিনা ঘর বা, বার ঘর করতে থাকি - - - - -
বাথরুমে ঢুকে বড় আয়নাটার সামনে নিজেকে একটু একটু নগ্ন করে মনে হয় তার প্রত্যেক মানুষই কাপড়ের নিচে এক একটা পশু মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে - ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম খাবার টেবিলে বসে আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে আসেহরে কৃষ্ণ হরে রাম - - - - -
রাতে ঘুম হয় না চোখ বন্ধ করলেই, চোখের উপর ভেসে আসে লাইনটা ঘুমোলেই স্বপ্ন মামারা মারামারি করছে তাড়িয়ে দিচ্ছে হিন্দু মানুষদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি দেখতে পায় ঠাকুর ঘরে বসে মাসিমা পাঁচালি পড়ছেন - ‘উমা বলে মেনকারে হিমালয় পাটে / দুঃখের কথা কী কইমু কইতে বুক ফাটে / বৈশাখ মাসেতে মাগো দেওয়ায় ডাকে জোরে / কার্তিক গণাই কোলে আমার দেহা কাঁপে ডরে / জ্যৈষ্ঠ না মাসেতে মাগো বড় তুফান ভারি / লতা পাতায় ছাওয়া ঘরে রইতে নাহি পারি - - - -‘ দিন দিন নজমুল কেমন যেন উদাসীন সংসার বিমুখ হয়ে পড়ে ঝিম ধরে বসে থাকে অসুস্থ হয়ে যায় আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শি সবাই জেনে গেছে নজমুলকে বাংলাদেশের ইন্দু (হিন্দু) ভূতে পাইছে
গল্পের নামহরে কৃষ্ণ হরে রাম এই একটি গল্পই তাঁর এই গ্রন্থটিকে এক আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে গল্পকারের জাতটা আরোও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আদিমা মজুমদার সঙ্গে মানুষ আদিমাকেও আরোও একবার এর পর আর আলোচনার কিছু বাকি থাকতে পারে না তবুও আলোচনার খাতিরে এগোতে হয়
সাম্যের জয়গান গেয়েছেনঅসাম্যের ঈদগল্পেবাঁকা চাঁদগল্পে কিছু স্পষ্ট কথা, কিছু প্রতিবাদে সমাজের নগ্ন চেহারাকে সরাসরি উন্মুক্ত করেছেন সচরাচর অনুচ্চারিত কিছু শব্দের দৃপ্ত উচ্চারণে বাস্তবকে খোলাখুলি চোখের সামনে তুলে ধরেছেনপাখির বাসাগল্পে শুধুই বর্ণনা, তবু কী অসাধারণ গদ্যে গ্রাম্য শব্দের প্রয়োগে সমাজের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা মিথ্যে নিয়মের বেড়াজালকে চোখের সামনে দৃশ্যমান করেছেনভাবিগল্পে প্রেমের গল্পেও দেখিয়েছেন দক্ষতা তাঁরলাল সুতো নীল সুতোগল্পে
প্যারাদাইস লস্টগল্পে গল্পকার আদিমা অনেকটাই খোলামেলা আজকের মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার পয়োভারের দিনে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা কাকে বলে দেখিয়েছেন এই গল্পটিতে
শেষ গল্পদামিনীবড়ই নিদারুণ একেবারেই কাছের মানুষের দ্বারা ধর্ষিতা এক নারীর দুঃখভরা বয়ানে চোখে জল আনে তৎক্ষণাৎ মিলে যায় অভিশপ্তা দামিনী নামের যুবতীটির সাথে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অপরাধের এক জ্যান্ত নিদর্শন
অন্যান্য গল্পগুলিও সমান সুখপাঠ্য - তা সে যতই দুঃখদায়ক হক না কেন এক একটি অমোঘ বার্তা প্রতিটি গল্পের ভেতরে থেকে যেন কল্পনার জগৎ থেকে কঠর বাস্তবে নামিয়ে আনে পাঠককে কী নেই সেখানে ? বিদেশি সমস্যা থেকে শুরু করে নোট বাতিলের সমস্যা সবই দক্ষতার সঙ্গে ছুঁয়ে গেছেন গল্পকার আদিমা
আদিমা মজুমদারের গল্প শুধুই গল্প নয় আছে সাহিত্যের এক অনাবিল ধারা ভাষায়, বুনোটে প্রতিটি গল্প নিখুঁত বিরূপ সমালোচনার কোনও স্থান নেই
এই গ্রন্থটি না পড়লে বোধ করি অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে পাঠকের কাছে শামিম আহমেদ-এর মানানসই প্রচ্ছদ আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় পঠনের বাঁধাই মলাট হলে বোধ হয় এমন অমূল্য গ্রন্থের সংরক্ষণে সুবিধে হতো পাঠকের
 
দামিনী
আদিমা মজুমদার
মূল্য - ৮০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২৭২৩৪৯৬
- - - - - - - - - - -

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়