Skip to main content

বিষাদ-মেঘের কবিতা সংকলন - ‘শ্রী’



কবি গীতশ্রী ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘শ্রী’। ভূমিকায় তাঁর কথায় - ‘আমার বইয়ের নাম দিয়েছি ‘শ্রী’। ‘শ্রী’ মানে সুন্দর, শ্রী মানে সব ভালো কিছু। আর ‘শ্রী’-র মধ্যে কিছুটা এই ‘আমি’ও লুকিয়ে আছি।‘ ৫৬ পৃষ্ঠার বোর্ড বাঁধাইয়ের দুই মলাটের মধ্যে সাজানো আছে মোট ৫০টি কবিতা। প্রতিটি কবিতা এক পৃষ্ঠার। শিল্পী/লেখক কুণাল ভট্টাচার্য লিখছেন - সুললিত বিষাদের অনবদ্য ক্যানভাস - ‘শ্রী’। “এ কাব্যগ্রন্থে কবি এক নৈর্ব্যক্তিক চিত্রশিল্পী, নিজেকেই ক্যানভাস করে এঁকেছেন অনবদ্য বিষাদ। - - - - কখনও এক মনোরম চিরাকাঙ্ক্ষিত কল্পজগতের নির্মাণ-বিনির্মাণ করেছেন। কখনও হতাশা আর বিষাদের আড়ালে এক আধ্যাত্মিক যাত্রারম্ভ করেছেন কবি।“
এই সংকলনের প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই ধরা আছে এক নৈরাশ্য, এক বিষাদের সুর। কবিতার নামকরণেও পরিষ্ফুট হয়েছে এই সুর - হারানো আমি, আটপৌরে, বিষাদ-মালা, ফুল ফোটে না, ফাগুন এলে না ?, অনাসক্তি, বিষাদ সঙ্গী, খরা ইত্যাদি।
কবিতায় অনুভূতির কুসুমকলিকে যথাযথ ভাবে প্রস্ফুটিত করে তোলা যেন এক চিত্রকরের তুলির মোচড়ে অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলা। সেখানে এক অবয়বের দরকার। নিরাকার দৃশ্যকল্পে পার্থিব মানুষ তৃপ্তির ছোঁয়া থেকে চিরবঞ্চিত। সেই আকার, সেই অবয়ব এবং তার সাথে অনুভূতিকে কাব্যিক নৈপুণ্যে সাজিয়ে তোলা মোটেই সহজ কাজ নয়। তাই তো সব প্রেমের কবিতায় প্রেম ধরা দেয় না, সব স্বপ্নের কবিতায় স্বপ্নময়তা এসে মূর্ত হয় না। ঠিক তেমনি বিষাদময়তাকেও কবিতার অবয়বে অঙ্কন করা এতটুকুও সহজ নয়। কিন্তু গীতশ্রী এখানে অনেকাংশেই সফল। তাঁর স্পষ্ট কথনে অধিকাংশ কবিতার মধ্যেই ফুটে উঠেছে বিষাদের সুর। কবিতার পরতে পরতে বিষাদগ্রস্ততার প্রকাশ। প্রথম কবিতা ‘হারানো আমি’তে কবি লিখছেন -
দিনান্তের শেষ আলো প্রতিদিন কেড়ে নেয়
আমার বেঁচে থাকার সাধ, প্রতিটি সূর্যোদয়
আমাকে ঠেলে দেয় আবার একটি অনাকাংক্ষিত
শেষ হতে না চাওয়া দীর্ঘতম দিনের দিকে।
- - - - - - -
আমি হারিয়ে যাচ্ছি সেই কোথায়,
যার সাকিন কেউ রাখেনি, কেউ খোঁজেনি
হারিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি।
শুধু পার্থিব বিষাদ নয়, কিংবা নয় কোনও আত্মবিষাদ, তাঁর কবিতায় ছেয়ে আছে অপার্থিব এক বিষাদময়তাও। বিষাদকে সাজিয়ে তুলেছেন প্রতিটি অনুভবের গভীর বিশ্লেষণের মধ্যে। কোথাও এক গভীর অভিমান, এক অন্তরতম অতৃপ্তি, এক বুকফাটা অনুযোগ ধ্বনিত হয় কবিতার অবয়ব জুড়ে।
কত ক্ষয়, কত ভয় জমে আছে মাটির বুকে।
কতটা দ্বিধা দ্বন্দে ফুল ফোটে না শাখায়
তুমি জানো না, পৃথিবী জানে, আকাশ জানে
আর জানে মাটির সোঁদা গন্ধ।
(কবিতা - ফুল ফোটে না)।
কিংবা -
সানাই বাজেনি জীবনের পটচিত্রে
বাঁশির মোহিনী সুরে জাগিনি ভোরে
অথবা গহীন ঘুমঘোরে
রজনীগন্ধা অথবা জুঁই হাতে দিয়ে
কেউ বলেনি চুলে পরে এসো
সুবাস নেবো আত্মা জুড়ে।
(কবিতা - আশাবরী)
স্পষ্ট, সরল বিষাদ গাথাকে কবিতার মাধুর্যে উপস্থাপন করতে পেরেছেন কবি তাঁর নিজস্ব নৈপুণ্যে যা পাঠক হৃদয়ে অনুভবের বাইরেও সৃষ্টি করে এক কাব্যিক পরিতৃপ্তি। আবার শুধুই বিষাদের উচ্চারণেই থেমে থাকেননি কবি। তাঁর চোখে ধরা দেয় এক স্বপ্নময় আগামীর ইঙ্গিত। বিষাদই শেষ কথা নয়। তাই আশার বাণীও শুনিয়েছেন অবচেতনে -
এত নৈঃশব্দের ফোঁকরে হঠাৎ কীসের
মিষ্টি, সুরেলা আওয়াজ
আগে তো শুনতে পাইনি।
এমন মধুর শিস, এমন ধ্বনি বাজেনি তো
কয়েক যুগ, অনেক বছর
সাড়া জাগানো শিস শোনার জন্য
উন্মুখ আমার দেওয়াল, উৎসুক আমি।
তুমি যেই হও না পথিক,
আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়
শিস দিয়ে যেও, সুরেলা শিস
জাগিয়ে দিয়ে যেও, 
অনন্ত ঘুমে থাকা
আমার আমিকে।
(কবিতা - সুরেলা শিস)।
কিংবা -
ইদানীং মৃত্যু কামনা করি না
পেয়েছি অমৃতের স্বাদ
জীবন পাত্রে পূর্ণ করে রাখতে চাই
অমৃত কণার প্রসাদ বারি।
(কবিতা - দুটি কবিতা)।
একের পর এক বিষাদের ছবি যেমন এঁকে রেখেছেন সহজ মুন্সিয়ানায় তেমনি দিয়েছেন বিষাদময়তা থেকে মুক্তির বার্তাও। কাব্যিক সুষমায় অঙ্কিত হয়েছে জীবনবোধের দায়বদ্ধতা। বিষাদময়তার পাশাপাশি হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলেছে কাব্যময়তাও। তাই কবিতা পাঠের স্পৃহা আগাগোড়া বজায় থেকে যায় পাঠকের অন্তরে।
এক কথায় এক দুঃখময় কবিতার সুখময় পঠন। কোথাও বানান ভুল বা ছাপার ভুল জাতীয় অ-সুখ নেই। তবে কিছু কবিতায় পংক্তি সজ্জার দিকটাতে আরোও সতর্ক হওয়ার সুযোগ হয়তো ছিল। কিছু শব্দ পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সারিতে অধিক স্বচ্ছন্দ লাগতো। আগামীতে কবির কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেল বহুগুণ।
শ্রীময়ী প্রচ্ছদ করেছেন রাজু দাস। প্রকাশক আর জি পাবলিকেশনস, গুয়াহাটি। মুদ্রণ - নীল ড্রিম, গুয়াহাটি। শেষ প্রচ্ছদে ছবি সহ আছে বরাকজাত এই কবির লেখালেখির কথা, আছে সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয়।
 
‘শ্রী’
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৮০১১০২৮৭৭৪
- - - - - - - - - - -

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়