Skip to main content

জন্মের প্রথম শুভক্ষণ


কিছু কথা তীব্র অপ্রিয় হলেও বলতে হয় বইকী তবু এসব কথা অপ্রিয় বলেই শুধু বলেন না অনেকে এতে ভবিষ্যতে বড়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বাবাও কোনোদিন বলেননি আগে কিন্তু মাস ছয়েক আগে একদিন নিভৃতে কাছে ডেকে আমাকে বললেন কথাগুলো বাবা এমন একটা সময় বেছে নিয়েছিলেন যখন মা ঘরে নেই আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল যদিও, বোধ করি আমরা এই যুগের ছেলে মেয়েরা হৃদয়ের দিক দিয়ে অনেকটাই শক্তপোক্ত হয়ে জন্মাই জন্ম থেকেই এই পৃথিবীর রং রূপ দেখে অনেকটাই প্র্যাকটিক্যাল হয়ে পড়ি নিজেরই অজান্তে সেদিন তাই অপ্রিয় হলেও, বারকয়েক বাবাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোটা শুনেছিলাম মন দিয়েই
কী বলেছিলেন সেদিন বাবা ?
তার আগে একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার আছে বাবার সঙ্গে বাবাকে আমি মোটেও রাশভারী বলব না খুব আমুদে এবং হইহই টাইপের ছিলেন তিনি জীবনটাকে সামর্থ্যের মধ্যে উপভোগ করতে জানতেন বাজে খরচ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতেন এ নিয়ে আমি আর মা মুখ টিপে টিপে হাসতাম কৃপণ মনে হতো বাবাকে অথচ কত বার কত জায়গায় যে আমাদের নিয়ে বেড়াতে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই বলতেন ভ্রমণে জ্ঞান বাড়ে এদিকে নিজের জন্য খরচের বেলায় ভীষ্ণ রকমের আলসে ছিলেন বাবা একই কাপড় পরে কাটিয়ে দিতেন বছরের পর বছর ব্যবহার করতেন বাজারের সবচাইতে কম দামি জিনিসপত্র আমাদের বেলায় আবার অনেকটাই উদার ছিলেন মানা করতেন না কোনো কিছুতেই  
বয়স ষাট পেরোতে না পেরোতেই খানিকটা গাম্ভীর্যের ছাপ লক্ষ করতাম বাবার আচরণে চিন্তাগ্রস্ত মনে হতো আমি এতদিনে গ্র্যাজুয়েশন করে উচ্চ শিক্ষার পাঠ নিতে বাইরে চলে এসেছি মাঝে মাঝে চলে আসতাম ঘরে, যেহেতু খুব বেশি দূরে আমি থাকতাম না যখন বাইরে থাকতাম, রোজ রাতে কথা হতো মা ও বাবার সঙ্গে আমাকে নিয়ে বাবার অনেক দায়, অনেক চিন্তার কথা শুনতাম মায়ের থেকে যদিও সরাসরি এসব আমাকে বলতেন না বাবা নিজের সন্তান হলেও সম্ভবত বিপরীত লিঙ্গের ব্যাপারটা বাবার মননে ক্রিয়াশীল থাকত সতত মানসিক দিয়ে বাবার সঙ্গে যতটা নৈকট্য ছিল, দৈহিক দিক থেকে ঠিক সেই কারণেই একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই কিশোরী বেলাতেই, যখন দেহের প্রাথমিক পরিবর্তনগুলো দেখা দিয়েছিল আমার মনে আছে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর যখন আমার জন্য ব্যাংকে পাসবুক খোলা হল তখন একটা এটিএম কার্ডও হাতে পেয়েছিলাম মা ও বাবার আগে থেকেই এই কার্ড ছিল আমার পাসবুকে পরিমাণে সীমিত হলেও নিয়মিত টাকা জমা রাখতেন বাবা এটিএম কার্ড হাতে আসার পর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পাসওয়ার্ড কী রাখব ? বাবা বলেছিলেন তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনের তারিখটা পিন হিসেবে নিয়ে নাও তাহলে আর ভুলে যাবার সুযোগ থাকবে না বাবার কথা মতোই আমার জন্মতারিখটাই (শুধু দিন ও মাস) পিন হিসেবে সংরক্ষণ করেছিলাম এখনও তাই আছে এক এক করে বাস্তবের সঙ্গে এভাবেই বাবার মাধ্যমে বড় হচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত আজ হয়তো ডিজিট্যালি বাবার চাইতেও অনেক বেশি জেনে ফেলেছি আমি তবু এখনও মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাবারই সহায়তা নিতে হয় আমাকে মাঝে মাঝেই
এভাবেই দিন চলছিল এরই মধ্যে একদিন বাবা আমাকে ডেকে বললেন - এখন অনেকটাই বড় হয়েছিস মা দিন পর চাকরিবাকরি করবি, সংসার করবি তোকে কয়েকটা কথা বলি শোন - বলে একটা ফাইল থেকে বাবার সঞ্চয়ের কাগজপত্রগুলো দেখিয়ে কোনটা কবে ম্যাচিওর হবে বুঝিয়ে দিলেন আমি আমতা আমতা করলেও মোটামোটি দেখে রাখলাম ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারলাম না বাবা কেন এগুলো এখনই দেখালেন পরে মনে হল বাবা হয়তো নিজের অনুপস্থিতিতে যাতে আমরা অসুবিধায় না পড়ি এমনটা ভেবেই এটা করলেন এক্ষেত্রে বাবা হয়তো কিছুটা তাড়াতাড়িই এসব করতে গেলেন - এমনই মনে হল আমার আবার এটাও ঠিক যে আজকাল কখন কার কী হয় তার ঠিক নেই সেক্ষেত্রে বাবাই সঠিক
কিন্তু বাবা যে এতটাই সঠিক তা বুঝতে পারলাম ওই ঘটনার মাস তিনেকের মাথায়, যখন আচমকা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বাবা কাউকে কিছু না বলেই পাড়ি দিলেন পরপারে বুক জুড়ে কান্নারা এসে আমাকে নাস্তানাবুদ করতে লাগল মা সাংসারিক কাজকর্মের বাইরে কোনোদিনই এতটা সাবলীল ছিলেন না বাইরের কাজে দুঃখব্যথা বুকে ধরে তাই এখন সবটা আমাকেই সামলাতে হবে
বাবা যেদিন মারা গেলেন তার সপ্তাহখানেকের মাথায় বাবার এটিএম কার্ড দিয়ে আশু কিছু টাকা ওঠানোর দরকার পড়ল জয়েন্ট আকাউন্ট থাকলেও চেকবুক না থাকায় মায়ের পক্ষে তখন ব্যাংকে গিয়ে টাকা ওঠানোর মতো অবস্থা ছিল না কার্ডটি নিয়ে বেরনোর মুহূর্তে মনে হল বাবার এটিএম কার্ডের পিন তো আমার জানা নেই এটা তো বাবা বলে যাননি আর ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়ল বাবার সেদিনের কথাটি বাবা নিশ্চয়ই তাঁর জন্মতারিখটাই রেখেছেন পিন হিসেবে সেই ধারণা নিয়েই গিয়ে দাঁড়ালাম এটিএম কাউন্টারে টাকা ওঠানোর জন্য পিনটা বসাতেই ভেসে উঠল - ‘রং পিন তার মানে বাবা এই পিন সেট করেননি তাহলে কী হতে পারে ? আমি ভেবেই পাচ্ছি না হঠাৎ মনে হল অফিসিয়ালি বাবার আরোও একটা জন্মতারিখ আছে সেটাও আমি জানি এবার সেই হিসেবে পিন বসালাম মেশিনে কিন্তু এবারও ডিক্লাইন হল লেনদেন একই মেসেজ - রং পিন সাথে একটা সতর্কবার্তাও এল সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া বাবার মোবাইলে আর একটিমাত্র সুযোগ আছে, ভুল হলে লক হয়ে যাবে এটিএম কার্ড ভীষণ সমস্যায় পড়ে গেলাম টাকাটা আজই খুব দরকার অথচ বেরিয়ে এলাম কাউন্টার থেকে
বাইরে বেরিয়ে কিছু সময় চিন্তা করতে থাকলাম এবং এবং হঠাৎ করে যেন একটা যোগসূত্র এল মাথায় কিছু সময় পরেই তাই ফের গিয়ে দাঁড়ালাম কাউন্টারে দেখাই যাক নাহয় কিছু একটা করে আজকের দিনটা পার করে কাল নিজেই ব্যাংকে এসে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে নতুন পিন সেট করাতে হবে
বাবার চেহারাটা যেন মুহুর্মুহু ভেসে উঠছে চোখের সামনে সদাহাস্য, নিরুদ্বিগ্ন চেহারা মনে হল একদিন বলেছিলেন মাকে একদিন নয়, বহু দিনই বলেছেন মা বলতেন আমাকে আমার জন্মের সেই শুভ মুহূর্তটির কথা কী হয়েছিল সেদিন ? জন্মের পর আমার নীল হয়ে যাওয়ার কথা উদ্বেগের কথা হাসপাতালের সব স্টাফদের মিষ্টি খাওনোর কথা স্টাফরা বলাবলি করছিল - কন্যাসন্তানের জন্মের পর এত খুশি হতে দেখিনি কাউকে বলতেন বাবা আর হেসে লুটোপুটি খেতেন সেদিনের সেই কথাগুলোর সঙ্গে আমাকে বলা কথাটি মিলিয়ে এবার আমার জন্মতারিখটিই বসিয়ে দিলাম পিন হিসেবে এবং আমাকে অবাক করে বেরিয়ে এল নোটের তোড়া
ওদিকে মেশিন থেকে সশব্দে বেরিয়ে আসছে একের পর এক নোট আর এদিকে আমার চোখ উপচে বেরিয়ে আসা জলের ধারায় আমি তখন স্নাত হচ্ছি পিতৃস্নেহে নতুন করে আবিষ্কার করছি আমার বাবাকে, বাবার আমিকে
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়