Skip to main content

দায়বদ্ধ ভাবনার নান্দনিক প্রকাশ - শারদীয় সংখ্যা ‘শতরূপা’


‘শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির চিন্তা ও চেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে রয়েছে। বাঙালির আধ্যাত্মিক চিন্তার পাশাপাশি শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে ঘটে জাতিটির মননের উত্তরণ। আর তারই প্রকাশ দেখা যায়, পুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালির শিল্প-সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চিন্তা ও চেতনাতে...।’ - সম্পাদকীয়র শুরুতেই পত্রিকা প্রকাশের অন্তরায়সমূহের উল্লেখ থাকলেও পাশাপাশি উৎসবের সঙ্গে নান্দনিকতার যে সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে বা নান্দনিকতাবোধের যে গরজ দেখা গেছে, বলা যায় পুরো পত্রিকা জুড়ে তারই প্রয়াস এবং প্রকাশ। শারদীয় উৎসবের অন্য একটি আঙ্গিক যেন উন্মোচিত হয় পাঠকের সামনে। অসম্ভব ভালো একটি শৈল্পিক প্রচ্ছদ প্রথমেই মন কেড়ে নেয়। এমনকি ‘শতরূপা’র প্রতীকটি পর্যন্ত এক চমৎকার শৈল্পিক ভাবনাসঞ্জিত অঙ্কন। ভেতরের পাতায় অলংকরণে, ব্যতিক্রমী আঙ্গিকের রচনা সম্ভারেও তারই প্রতিফলন।
মধ্য অসমের লংকা থেকে প্রতিবারের মতোই প্রকাশিত হয়েছে ‘শতরূপা’ পত্রিকার শারদ সংখ্যা। ১/৪ ক্রাউন পেপারে ৫৬ পৃষ্ঠার পত্রিকাটির সম্পাদক অন্যান্যবারের মতোই কবি, গল্পকার মনোজকান্তি ধর। গল্প, কবিতা প্রবন্ধের বাইরেও রয়েছে গ্রন্থ আলোচনা এবং একটি অভিনব বিভাগ - ‘শ্রীহট্টীয় কবিদের এক গুচ্ছ পুজো-ভাবনা’। যে বিষয়টি ‘শতরূপা’র ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় তা হল পত্রিকা সম্পাদক লেখালেখির জন্য প্রতিষ্ঠিত বা নামিদামি কবি লেখকদের লেখার তুলনায় স্থানীয়, অপেক্ষাকৃত কম নামি তথা নবীন প্রজন্মকে নিয়েই পথ চলার পক্ষপাতী। সেই হিসেবে পত্রিকায় লেখালেখির মান নয়, একটি সাহিত্য-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি তথা ভবিষ্যৎ বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থাৎ বলতে গেলে ‘শতরূপা’ হচ্ছে একটি দায়বদ্ধ পত্রিকা ও একটি সাহিত্য-চর্চা ও সাহিত্য-সৃষ্টির সোপান।
আলোচ্য সংখ্যার প্রথমেই রয়েছে বেশ কয়েকটি কবিতা। নানা স্বাদের, নানা বিষয়ের কবিতাগুলোর মধ্যে বিশেষোল্লেখে রাখতেই হয় অভিজিৎ দাস, কমলেশ্বর কলিতা (অনুবাদ - সম্পাদক), কমলেশ চৌধুরী, সমরবিজয় চক্রবর্তী, রতীশ দাস, বিশ্বজিৎ দেব, অপূর্ব দেব-এর কবিতাকে। এর বাইরেও রয়েছে রকমারি বিষয়ভিত্তিক একগুচ্ছ কবিতা। লিখেছেন - রুবী গুপ্তা, ড. সাথী দে, কল্পনা দে, মানিক চক্রবর্তী, সমরজিৎ দাস, সুদীপ্তা পাল, প্রতিমা পাল, হরিপদ চন্দ, শিল্পী দাস ও মোহিত চন্দ। কবিতার ধারাবাহিকতায় এরপরেই রয়েছে সেই অভিনব বিভাগ যেখানে ‘শ্রীহট্টীয় কবিদের এক গুচ্ছ পুজো-ভাবনা’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন কনোজ চক্রবর্তী (বুলবুল), পরিতোষ বাবলু, পিয়া চৌধুরী, মান্না পাল ও শামীমা নীপা।
প্রবন্ধ বিভাগে রয়েছে তিনটি রচনা। মীনাক্ষী চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘বাঙালি জীবনে দুর্গাপূজা এবং দুর্গোৎসব’ শিরোনাম অনুযায়ী সবগুলো দিক ছুঁয়ে এক পূর্ণাঙ্গ শারদীয় প্রতিবেদন। নিত্যানন্দ দাসের নিবন্ধ ‘একটি লুপ্তপ্রায় নদী উৎসব : তেনার কন্যা ভাসান’ লোকসংস্কৃতি বিষয়ক এক ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা। বহু পাঠকের কাছে এক নতুন বিষয়। তিথি ও তারিখ বিষয়ের উল্লেখে সামান্য অসামঞ্জস্য থেকে গেলেও সম্পূর্ণ নতুন বিষয়ে লেখা এক অনবদ্য রচনা। মেঘালী দাসের নিবন্ধ ‘দুর্গাভিত্তিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে দুর্গাভিত্তিক লোকসঙ্গীতের তুলনা’। এটিও একটি ব্যতিক্রমী ভাবনার ফসল। তবে একাধিক তথ্য সন্নিবিষ্ট হলেও বিস্তৃতির সুযোগ ছিল বলেই মনে হয়েছে। গ্রন্থ আলোচনা বিভাগে রয়েছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর - ঈশান বাংলার অবিসম্বাদিত সাহিত্যিক মনোমোহন মিশ্র ও তাঁর ‘খেয়াঘাট’।
গল্প বিভাগে প্রথমেই রয়েছে সুব্রত দত্তের দুটি ছোটগল্প। একজন লেখকের দুটি গল্প সচরাচর সন্নিবিষ্ট হতে দেখা যায় না পত্রপত্রিকায়। কেন এমন ? এর সদুত্তর দিতে পারবেন একমাত্র সম্পাদকই। সুব্রতর প্রথম গল্প ‘মৌ-বিলাস’ ব্যতিক্রমী প্লটে, যথাযথ বুনোট ও আঙ্গিকে এক প্রাসঙ্গিক, বার্তাবহ সার্থক ছোটগল্প। তৎসম শব্দের অধিক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। দ্বিতীয় গল্প ‘সদ্ব্যবহারের আত্মতৃপ্তি’ বাস্তব প্রেক্ষাপটে এক সৎ ভাবনার টানটান গল্প। এই গল্পে একই স্থাননামে দুরকম বানান লেখা হয়েছে। সম্পাদক মনোজ ধর লিখেছেন গল্প ‘আবছা খণ্ডচিত্র’। গল্পের একটি ভালো প্লট রয়েছে, রয়েছে বাস্তব প্রেক্ষিত। কিন্তু বর্ণনায়, বুনোটে রয়ে গেছে কিছু ‘আবছা’, এলোমেলো ভাব। বিস্ময়কর ভাবে গল্পের প্রায় প্রতিটি লাইন কাব্যিক আঙ্গিকে লেখা হয়েছে। ফলে ‘গদ্যকবিতা’র মতো এই রচনাকে ‘পদ্যগল্প’ জাতীয় অভিধায় চিহ্নায়িত করা যায়। একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসলও বলা যেতে পারে, গল্পকার হিসেবে যা মনোজের স্বভাবজাত। রমা মজুমদার লিখেছেন গল্প ‘ভাবনা আর বাস্তব’। বহুল ব্যবহৃত প্লটেও কাহিনির চলন বজায় রেখেছেন গল্পকার। চরিত্রের নামোল্লেখে নামের সঙ্গে পদবির পুনঃ পুনঃ উল্লেখ বিসদৃশ লেগেছে। শেষ গল্প সঞ্জয় সরকারের ‘হলধরের হাল খতিয়ান’। পুরোনো ধাঁচের প্লট ও লেখা। বিষয় রোচক হওয়ায় হালেও উতরে যাবে হয়তো সাধারণ পাঠকের কাছে। এরকম প্লট, লিখনশৈলী আগেকার দিনের উপন্যাসে উপলব্ধ।
চমৎকার প্রচ্ছদের পরিকল্পনায় অভিজিৎ দাস (নন্দু)। পঠনবান্ধব ফন্টে স্পষ্ট ছাপা, কাগজের মান তথা অক্ষর বিন্যাস যথাযথ। বানান ভুলের ব্যাপারে অধিক যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। একাধিক রচনার শিরোনামেও রয়ে গেছে বানান ভুল। সব মিলিয়ে একাধারে নান্দনিক ভাবনা ও ছোটপত্রিকার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রকাশিত একটি শারদ সংখ্যা - ‘শতরূপা’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮২২৪৬৪৬২৩ 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়