Skip to main content

দুর্গা দেখতে যাব


শরৎ এলেই পুজো আর পুজো এলেই সামনে-পিছনে তাকানো। এক ধারাবাহিক জীবনচর্চা। ভাদ্রের তালপাকা গরমে ফ্যান থেকে তালপাখা সবকিছুই যখন বেদম হয়ে যায় তখনই একটুখানি শাদা মেঘের খোঁজে, একটু ছায়াময় ঘন নীলাকাশের খোঁজে ঘন ঘন উপরের দিকে চেয়ে থাকার বাইরে আর গত্যন্তর থাকে না। বুক ধুকপুক প্রতীক্ষার শেষ প্রহর অবশেষে ঘনিয়ে আসে একসময়। সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থেকে গত কাল আর আগামী কালের প্রহর গোনা শুরু হয় এরপর।  
রাতে বাজার সেরে আসতে গিয়ে ঝুমা বউদিদের বাড়ির সামনে এসে এক পরিচিত গন্ধে যেন মনের মধ্যে আকুলিবিকুলিবুঝতে বাকি রইল না শিউলি ফুটেছে ঝুমা বউদির বাড়িতে। অমনি এক পরিচিত আনন্দে নেচে উঠল অন্তর সামনেই পুজো তাহলে। যৌবনে এমনই এক পুজোর প্রাক্কালে শিউলি এসেছিল ঝুমা বউদিদের বাড়িতেসে কী আনন্দ। সে কী আনন্দ। তারপর সেই যে চলে গেল একদিন আর দেখা হল না কোনোকালেই। 
শিউলিশেষে এবার আক্ষরিক অর্থেই যেন ঢেঁকিকলে (Sea-saw) চড়ে সামনে-পিছনে আন্দোলিত হওয়ার পালা। প্রতি বছরেই এমন অবস্থার সামনে পড়তে হয় আমাকে। সেইসব নিখাদ আনন্দের দিন গত হয়েছে কবেই। আনন্দময়ীর আগমনে এখন শঙ্কাময় হয়ে উঠি আমি। বুঝি শুধু আমিই এমন। সজল, কাজল, পরিমলদের দেখে কিন্তু এমন মনে হয় না। ভাবি ওরা কী করে এতটা হাসিখুশি থাকতে পারে এ অবস্থায় ? ওদের কি দায়-দায়িত্ব নেই একেবারেই ? আর সেটাই বা বলি কী করে ? ওরাও তো কত কিছু করে পুজোয়। হাসি ফুর্তির যেন অন্ত নেই ওদের। কেউ কেউ তো কুকুরের জন্যও নতুন জামা বানিয়ে আনে। নতুন জামার কথা মনে আসতেই ঢেঁকিকল একেবারে আকাশে চড়ে উঠল যেন। কেঁপে উঠি আমি পতনের আশঙ্কায়।
চারটি ভাই-বোনের সংসারে একটাই আসত নতুন কাপড়। সে আমার, এই ছোট সদস্যটির জন্য। আমার উপরের দাদা, দিদি দুটি কয়েকদিন মুখ গোমড়া করে থাকত আর আমার ভেতর লাড্ডু ফুটত কবে হস্তগত হবে সেই কাপড়ছয় জনের পরিবারে একটি শার্ট - শুধু আমার। অকৃতজ্ঞ আমার তবু কী আনন্দ। দাদাটি বাইরে বেরিয়ে পুজো মণ্ডপের সামনে গেলেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অন্য দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যেত মূর্তিকে পাশ কাটিয়ে। দেখে ফুলবাবু আমার কী হাসি। হায় রে অবুঝ মন। দাদার সেই দুঃখটি যদি সেদিন বুঝতাম।
সে আর হয় কী করে ? আমার তো তখন দম ফেলার ফুরসত নেই। কত কাজ পড়ে আছে। পুজোর দিন এসেই পড়ল বলে। রাত ভোর হতেই পাশের ঘরের শমীক দাদা এসে ডাকাডাকি শুরু। আমি তো উত্তেজনায় শেষ রাত থেকেই জেগে আছি। বেরিয়ে এলাম ফুলের সাজি হাতে। দুজন মিলে বিশাল ঝুড়ির আকারের দুটি সাজি ভর্তি করে তবেই শান্তি। গ্রামের এবং পাশের গাঁয়েরও সবার বাড়িতে ফুলের সমাহার। শিশির মাখা জবা - কত রঙের, গুলাইচ (গুলঞ্চ), পলাশ, কামিনী-কাঞ্চন, বেলি, জুই, গন্ধরাজ, অপরাজিতা, অতসী। আর সুধা গন্ধে ভরা শিউলি। সেও যে কত ধরন, কত আকার। ঘরে এসে মালা গেঁথে চানটান সেরে সকাল সকাল পূজা মণ্ডপে দে ছুট। মূর্তির সামনে এসে দাঁড়াতেই কী এক অপার মুগ্ধতা। তাকিয়েই থাকি। ইঁদুর থেকে মহাদেব, কলাবউ থেকে হাঁস খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও আশ মেটে না অন্তরের। মধুর…. মধুর ধ্বনি বাজে, হৃদয়কমলবন মাঝেদিনজোড়া সে কী ব্যস্ততা - অঞ্জলি, মহাপ্রসাদ, আরতি, দুর্গা দেখতে যাওয়া, আড্ডা
ভাবতাম এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না…. কিন্তু সে তো হবার নয়। সময় থেমে থাকে না। বয়স থেমে থাকে না। দিদির বিয়ে হয়ে গেল। দাদাদের চাকরি হল। আমিই বা কী করে থেকে যাই সেই দিনে। ধীরে ধীরে পিছনে যেতে লাগল সব বালখিল্য, সামনে তাকিয়ে জীবন গড়ার এক পাহাড় দায় নিয়ে ন্যুব্জ হবার পালা। ঝুমা বউদিরা যেন স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে কবেই। শিউলি এখনও আসে নিয়ম করে, গাছে গাছে। কিন্তু আমাকে আর আকৃষ্ট করতে পারে না। সুবাস ছড়ায় আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় জুড়ে। ক্ষণিকের জন্য এক ভালো লাগা এসে জাপটে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। আবার পরমুহূর্তেই দায়ভার এসে তাড়নায় তাড়িয়ে মারে। বুঝতে পারছি স্পষ্ট দাদা দিদিদের সেদিনের কষ্ট। বড় অসহায় লাগে নিজেকে মা-বাবার অসহায় মুখমণ্ডলের চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠলে। চাকরি পেয়ে বিয়ে-থা করে আমিও আজ বাবারই পদানুসারী। দুটি সন্তানের পিতা হয়ে দায়িত্বের দায়ভারে আজও আমি ছুটছি শুধু ছুটছি নিত্যদিনের খরচ আর ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের পিছনেসামনে একদিকে কোটিপতিদের পুজোবিলাস, অন্যদিকে গরিবের পুজোসন্ত্রাস। দুয়ের মাঝে আমি টেনেটুনে এগোনোর চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ছুটছি মধ্যবিত্তের মানসিকতা নিয়ে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নতুন জামাকাপড়ের চিন্তাই শুধু নয় মধ্যবিত্তের আরোও অনেক কিছুই করতে হয়। মা আসছেন, তাঁর জন্য একখানি কাপড় আনতেই হয়। আত্মীয় স্বজনরা রয়েছেন, রয়েছেন পাড়াপড়শি। পাশের ফ্ল্যাটের অনিমেষদা ওরা প্রতি বছর ছেলে-মেয়ে দুটিকে কাপড় কিনে দেন। ভালোবেসে, আদর করে। ওদের তিন সন্তানদের প্রতিও তো আমার ভালোবাসা থাকা বাঞ্ছনীয়। একই সূত্রে দাদা দিদিদের সন্তানদের জন্যও কিছু পাঠানোর দায় আছে আমার - এবং একইভাবে গৃহিণীরওদ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের স্ত্রী-জামাতা, সন্তানসন্ততিদের কথাও আমাকে ভাবতে হবে বইকী। গৃহসহায়িকা ও তাঁর সন্তানের কথ আমার না ভাবলে কি চলে ? সমাজে মুখ তো দেখাতে হবে। নিজের সন্তানের গৃহশিক্ষক থেকে স্কুলবাসের ড্রাইভারের কথাও ভাবতে হবে। পুজো বলে কথা।
সবটা সেরে নিঃস্ব, কপর্দকহীন হয়ে যাবার পর মোক্ষম কথাটিও শুনতে হবে। তোমার জন্য কিছু কিনলে না যে ? আমতা আমতা করে বলি - কিনব। ব্যস, এতটুকুই। উভয় তরফেই এক গোপন, চোরা শান্তি। মনে মনে ভাবি পুজোর ঘোরাঘুরি তো বাকিই রইল। দু-এক বেলা বাইরে খাওয়া, কাছেই কোথাও একদিনের জন্য বাইরে যাওয়া। সেও তো পূজারই অনুষঙ্গ। গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এমাসেই পড়ে গাড়ির ইনসিওরেন্স, এমাসেই পড়ে ফ্ল্যাটের মেনটেনেন্সএকদিন বন্ধুদের আড্ডায়ও তো যেতে হবে। সব মিলিয়ে যাকে বলে ল্যাজে গোবরে। ঝড় সামলে মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াইতবু সামনে তাকাই। একদিন বাবার মতো বড় হব। মেয়ের বিয়ে দেব, ছেলে-বৌমা-নাতি নাতিনী নিয়ে সংসার করব। পুজো এলে ফিনফিনে কাপড়জামা পরে গৃহিণীকে নিয়ে দুর্গা দেখতে যাব।
এ স্বপ্ন মধ্যবিত্তের স্বপ্ন। ফিবছর পুজোশেষে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই ফের যুদ্ধে নেমে পড়া। এখন শুধুই যুদ্ধ। সেই দিন আর নেই এখন প্রয়াত ঝুমা বউদিদের কথা আজও মনে পড়ে। ফিবছর শিউলির গন্ধ এসে আচ্ছন্ন করে ক্ষণিকের জন্য। এতকিছুর পরেও বিসর্জন যাত্রায় দেবীর চলে যাওয়া দেখি। দেবী ভাসেন নদীর জলে, আমি ভাসি চোখের জলে। ভাবি এমন দৃশ্য আর কদিন দেখব ? দুহাত জোড় করে প্রণাম করি আর বলি - আবার এসো মা - পুনরাগমনায় চ।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...