Skip to main content

কাব্যগুণ-সংবলিত কবিতার সমাহার - ‘নীল আকাশ হলুদ ঘুড়ি’


উত্তরপূর্বের সাহিত্য পরিমণ্ডলে কাব্য সংকলন অর্থাৎ সম্পাদনা গ্রন্থের প্রকাশ নিয়মিত না হলেও বিরল নয় এই ধারায় পিছিয়ে নেই বরাক উপত্যকাও ২০২১ এর সেপ্টেম্বরে বরাক মূলের ২৫৩ জন কবির কবিতা সমৃদ্ধবৃষ্টিকথাকাব্য সংকলেন পর সম্প্রতি শ্রীভূমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি পিঙ্কু চন্দ সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থনীল আকাশ হলুদ ঘুড়ি একক প্রচেষ্টায় একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ বড় সহজ কথা নয় যদিও এই অসাধ্য সাধনে সংকলিত হয়েছে মোট ১০৪ জন নবীন-প্রবীণ কবির এক-পৃষ্ঠার কবিতা সংখ্যার বিচারে নিশ্চিত এক সাফল্যের মুখ দেখেছে সংকলনটি ভৌগোলিক সীমানার গণ্ডির মধ্যে সীমায়িত হয়নি এই সংকলন ফলত সন্নিবিষ্ট হয়েছে ডায়মন্ড হারবার থেকে ধুবড়ি, পন্ডিচেরি থেকে আন্দামান, ছত্তিশগড় থেকে বিলোনিয়া, মুম্বই থেকে বারইগ্রাম, সাব্রুম থেকে দুর্গাপুর, দিল্লি থেকে লালা, জামশেদপুর থেকে বাঁশকান্দি কিংবা মেদিনীপুর থেকে তিনসুকিয়ার কবিদের কবিতা যেন গোটা ভারতবর্ষের কবিতার এক মহামেলা
কেন এই গ্রন্থনাম, এই অসীম আয়োজন ? সম্পাদকীয়তে সম্পাদক লিখছেন - ...’নীল আকাশ হলুদ ঘুড়ি’ কবিতার আকাশে উড়তে থাকা কিছু উজ্জ্বল কবির কাব্যিক অনুভব, ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়ানো কিছু স্বপ্ন, বিহঙ্গ ডানায় ভেসে বেড়ানো কিছু হৃদিকথা দু’মলাটের ভেতর গ্রন্থিত করার ইচ্ছে থেকেই এ সংকলনের জন্ম...। এই সংকলন কোন বিশেষ আঞ্চলিক স্তরে সীমাবদ্ধ না থাকলেও উত্তর পূর্বের কবিদের বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরার এক সুপ্ত বাসনা গোপন থাকেনি।’ সম্পাদক আরও লিখছেন - ‘লেখক পাঠকদের সহযোগিতা পেলে আগামীতে আরও ব্যাপক এবং সার্থক সংকলন করার বাসনা রইল।’ পাঠক নিশ্চিতভাবেই এটা চাইবেন বলে ধারণা করাই যায়।
১০৮ পৃষ্ঠার হার্ডবোর্ড বাঁধাই সংকলনটিতে যে ১০৪টি কবিতা সংকলিত হয়েছে তার অধিকাংশ, বলা যায় প্রায় সবকটি কবিতাই কাব্যগুণে নন্দিত হওয়ার যোগ্য। আলাদা করে বিভাগিত করার কোনো পদ্ধতি কিংবা উপায় নেই। ধারণা করাই যায় যে কবিরা তাঁদের ঝুলি থেকে সেরা কবিতাই পাঠিয়েছেন নীল আকাশে, হলুদ ঘুড়ির গায়। কোন কোন কবিতা-বিশেষজ্ঞের মতে আমি/আমার, তুমি/তোমার জাতীয় শব্দের উপস্থিতি অর্থাৎ প্রথম পুরুষে লেখা কবিতার মান যথোপযুক্ত হয় না। এই মতবাদ আবার সর্বত্র গ্রহণযোগ্যও নয় কারণ খ্যাতনামা তথা নামিদামি বহু কবির এমন বহু বিখ্যাত কবিতা রয়েছেআলোচ্য সংকলনের ১০৪টি কবিতার মধ্যে এমন ১৬টি কবিতাই পাওয়া গেছে যেগুলো প্রথম পুরুষে লেখা হয়নি। কবিরা হলেন - অলকা গোস্বামী, ছন্দা দাম, দুর্গাদাস মিদ্যা, নকুল রায়, নবীনকিশোর রায়, নীলদীপ চক্রবর্তী, পিঙ্কু চন্দ, বিমলেন্দু চক্রবর্তী, বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য, মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম, রঞ্জিতা চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ দাস, রমলা চক্রবর্তী, শিখা দাসগুপ্ত, সংহিতা চৌধুরী, সুনীল শর্মাচার্য। এই কবিদের কবিতার মতোই প্রথম পুরুষের উদাত্ত আহ্বানযুক্ত অন্য সব কবিতাও যথেষ্ট সুপাঠ্য তথা সুখপাঠ্য। বহু কবিতার বহু পঙ্‌ক্তি, শব্দ-সুষমা উল্লেখনীয়। কিছু অনবদ্য পঙ্‌ক্তি এখানে তুলে ধরাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না -
...কফিনে আগুন ঢেলেই পোড়াবে যদি
এত অদল বদলের ঋতু কেন চাই!
মানুষের ছাই মানুষের ঘামে ভরা থাক
শস্য - গোলা - মাঠ।
(কবি - অভীককুমার দে)
...চুমুতেও খুশি না হলে লালার সাথে মিশিয়ে দেব
বাতিঘর আর ফিনিক্সের পালক।
(কবি - উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়)
স্বপ্ন বালুচরে নগ্ন পা রাখি যে করোটিতে
বিশ্বাস করুন হে মহামান্য আদালত
সে আদতে কোন মৃত মানুষ নয়।
(কবি - কমলিকা মজুমদার)
আর্ফিউসের মধুর বাঁশির সুনামি
একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে ঝিনুকের ভেতর
জীবনের গভীর নিস্তব্ধতা ফেটে বেজে ওঠে
একটি স্রোতের গোপন মৃত্যুর সংলাপ
(কবি - রাজীব ঘোষ)
কানে কলকাঠি নেড়ে কেউ সাবধান করে
জাগতে রহো
কাফিলা বেশি দূরে নয়
শহরের আস্তিনে চাঁদ এখনও ভোরের অপেক্ষায়
(কবি - লক্ষ্মী নাথ)
ঝঞ্ঝার ছদ্মবেশে অনামা প্লাবন আসে
উঁচু উঁচু শির
দমকা হাওয়া এসে লম্ফ নিভিয়ে দেয়
সে সকল প্রলয় রাতে
হ্যারিকেন হাতে মা আমার চিরকাল পথ চেয়ে রয়
(কবি - শান্তনু গঙ্গারিডি)
বুকের ভিতর জেগে আছে ছোঁয়া ভেনাসের
আদি ইতিহাসে
এখনও পদ্ম ফোটে তাই আশরাফ আলির
কবরের ঘাসে
(কবি সুদীপ ভট্টাচার্য)
কে কাকে মনে রাখে, কে ওড়ায় বাতাসে ধুলো
নগ্ন পিঠ উবু করে বসে যে থাকে
সে কি বধির, নাকি সে অন্ধ?
তার মাথার উপর নামে যে সংকট
সেও মনুষ্য রচিত
(কবি সেলিম মুস্তাফা)
এমনই সব সাবলীল ছন্দ, শব্দ, উপমার সংকিশ্রণে গড়ে উঠেছে অধিকাংশ কবিতা উপর্যুক্ত কবিদের বাইরেও যাঁদের কবিতা সংকলিত হয়েছে তাঁরা হলেন অখিল চন্দ্র পাল, অর্জুন দাস, অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস, অর্পিতা দাস, অশোক দেব, আশিসরঞ্জন নাথ, উত্তম চৌধুরী, ঋতা চন্দ, ঋত্বিক ত্রিপাঠী, কল্লোল চৌধুরী, কাজল সেন, খোকন সাহা, গীতাঞ্জলি রায়, গোবিন্দ মোদক, চন্দন মিত্র, চয়ন সাহা, চান্দ্রেয়ী দেব, চিত্রা চ্যাটার্জী, জিতেন্দ্র নাথ, ডালিয়া সিংহ, তন্ময় কবিরাজ, তমালশেখর দে, তাজিমুর রহমান, তাপস রায়, তীর্থঙ্কর দাশ পুরকায়স্থ, তৈমুর খান, দিপক চক্রবর্তী, দিলীপকান্তি লস্কর, দেবদত্ত চক্রবর্তী, দেবপ্রতিম দেব, দেবাশিস তেওয়ারী, নিমাই জানা, নিরুপম শর্মা চৌধুরী, পার্থপ্রতিম সেন, পারমিতা মোহান্ত, পীযূষ রাউত, প্রতিমা শুক্লবৈদ্য, প্রাণজি বসাক, বনানী চৌধুরী, বাউলা সঞ্জয়, বাপ্পী নীহার, বিজয় ঘোষ, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, মধুমিতা ভট্টাচার্য, মনোতোষ আচার্য, মন্দিরা পাল, মমতা চক্রবর্তী, মাহাতাবুর রহমান, মোহাজির হুসেইন চৌধুরী, মৃন্ময় রায় (সনেট), রবীন বসু, রসরাজ নাথ, রহিম রাজা, রাজীব ঘাঁটি, রীতা চক্রবর্তী, রূপন মজুমদার, শঙ্খশুভ্র পাত্র, শতদল আচার্য, শমিতা ভট্টাচার্য, শম্পা সামন্ত, শুভদীপ মাইতি, শুভেশ চৌধুরী, শুভ্রশংকর দাস, শেলি দাসচৌধুরী, শ্যামল শীল, শাশ্বত বোস, শ্বেতা ব্যানার্জি, সনৎ সেন, সাদিক মহম্মদ লস্কর, সুধাংশুরঞ্জন সাহা, সুমা গোস্বামী, সৈয়দ কওসর জামাল, স্নিগ্ধা নাথ ও হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সব কবিতা সজ্জিত হয়েছে বর্ণমালাক্রমে বিন্যস্ত সূচিপত্র অনুযায়ী
অপাংশু দেবনাথ, তাপস রায়, বিমলেন্দু চক্রবর্তী ও নিমাই জানার কবিতার শিরোনাম দীর্ঘ কেন তা অজ্ঞাত অথচ কবিরাই তো পারেন কিছু কথায় বহু কথা বলতে শেষোক্ত কবির কবিতার পাঠোদ্ধারের দায় তোলা রইল পাঠকের দরবারে
কাগজ ও ছাপার মান যথাযথ হলেও শব্দ বিন্যাসে ত্রুটি রয়ে গেছে কোথাও কোথাও। আধুনিক বানান অনুসৃত হলেও ফাঁক গলে রয়ে গেছে কিছু পুরোনো বানান। আন্তর্জাল থেকে নেওয়া প্রচ্ছদ কিছুটা সেকেলে হলেও অর্থবহ। সব মিলিয়ে এক গভীর প্রত্যয় ও অধ্যবসায়ের ফল একটি মানসম্পন্ন কাব্য সংকলন - ‘নীল আকাশ হলুদ ঘুড়ি’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২৫০ টাকা
প্রকাশক - স্কলার পাবলিকেশন, শ্রীভূমি।
যোগাযোগ - ৯৩৮৭১০৬৪৩০ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...