Skip to main content

বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধের উৎকৃষ্ট সমাহার - ‘লোকসংস্কৃতি’


নান্দনিক আবির্ভাব সংখ্যার পর জাতীয় লোকসংস্কৃতি পরিষদের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল মুখপত্র তথা সাহিত্য পত্রিকা ‘লোকসংস্কৃতি’র দ্বিতীয় সংখ্যা। দেরিতে হাতে এলেও এই পত্রিকার প্রচ্ছদ সততই এতটা আকর্ষণীয় যে পড়তে বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। ১২৩ পৃষ্ঠার আলোচ্য সংখ্যাটির পরতে পরতে উন্মোচিত হয়েছে লোকসংস্কৃতি, লোকসাহিত্য বিষয়ক অসংখ্য জানা অজানা তথ্য ও তত্ত্ব।
তিনজন সম্পাদক অমিত চট্টোপাধ্যায়, অহীন্দ্র দাস ও মন্টু দাস আশাপ্রদ সম্পাদকীয়তে লিখছেন - ‘প্রথম বর্ষপূর্তি শেষে আমরা উপনীত হলাম মহা-সম্মেলনে… সফলতার মুখ দেখেছি - আজ বলা চলে সহজেই। …আরও ব্যাপকতার পথে আমরা পা রাখব। দীর্ঘায়িত হবে আমাদের আগামীর পথ চলা। ততক্ষণ অঙ্গীকার থাক - বৃহত্তর লক্ষ্যকে স্পর্শ করার।’ পত্রিকার অন্দরে সন্নিবিষ্ট সাহিত্য সম্ভার এমন প্রত্যয়ের সপক্ষেই কথা বলে।
সংখ্যাটি পুরোটাই সেজে উঠেছে প্রবন্ধ নিবন্ধের সমাহারে। সূচিপত্র ধরে এগোলে প্রথমেই রয়েছে ড. চিত্তরঞ্জন মাইতির বিস্তৃত নিবন্ধ ‘বাংলাদেশে পটচিত্র’। নিবন্ধে আছে - ‘...পটচিত্র ঐতিহ্যানুযায়ী শিল্প। এই শিল্প চলে বংশ পরম্পরায়। পটচিত্রকে formalized folklore এর মধ্যে ফেলা যায়। এটি বাক্আশ্রয়ী এবং শিল্প আশ্রয়ী…।’ আসলে পটচিত্র তথা পটের গান এই দুয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পটশিল্প বা পট সংস্কৃতি। এর মধ্যে বাংলাদেশে পটচিত্রের বিষয়ে আলোচ্য নিবন্ধটি নিশ্চিতই এক তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। নিবন্ধটির পাঠে জানা যায় কত বিস্তৃত এই শিল্পকথা। লক্ষ্মণ কর্মকারের নিবন্ধ ‘লোকশিল্প ও রবীন্দ্রনাথ’ও যথেষ্ট বিস্তৃত। বিভিন্ন উদাহরণ সহ যত্ন সহকারে উপস্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনে লোকসংস্কৃতির গভীর অনুরাগ ও কর্মকুশলতার খতিয়ান। নিবন্ধ ‘ডরাই বিষহরি পূজা ও গুরমার নাচ’। লিখেছেন মন্টু দাস। গভীর অনুসন্ধানমূলক একটি উৎকৃষ্ট রচনা। বহু তথ্য ও তত্ত্বে সজ্জিত প্রায় সাত পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত এই নিবন্ধ যদিও সুবিস্তৃত তবু নিবন্ধের আকার সংকুচিত রাখার খাতিরে আরও বিস্তৃতির অবকাশ ছিল বলে লিখেছেন নিবন্ধকার। ড. গীতা সাহার নিবন্ধ ‘লোকশিক্ষা ও লোকসাহিত্য’। লোকশিক্ষা ও লোকসাহিত্যের পরিসর এতটাই বিস্তৃত যে একটিমাত্র নিবন্ধে এর পূর্ণ উপস্থাপন অসম্ভব। স্বভাবতই সংক্ষিপ্তাকার উল্লেখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে নিবন্ধ। একই ভাবে অমিত চট্টোপাধ্যায়ের রচনা ‘লোকসংস্কৃতি… তার উদ্ভব ও প্রয়োজনীয়তা’ নিবন্ধটিও এক বিশাল বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন। সুপ্তা দাস-এর নিবন্ধ ‘পৌষ সংক্রান্তিতে পল্লি অঞ্চল’। লেখক যতটা সম্ভব বিস্তৃতির চেষ্টা করলেও আসলে এই বিষয়টির ব্যাপ্তিও এতটাই যে একটি অঞ্চলের এই উৎসবের ব্যাখ্যাতেই হয়ে যেতে পারে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ। ‘ত্রিপুরার লোকসংগীত, লোকনৃত্য এবং পূজা-উৎসব’ নিবন্ধে ননীগোপাল দেবনাথ বর্ণনা করেছেন মূলত ত্রিপুরার উপজাতি সংস্কৃতির বৈচিত্র। খুবই প্রাসঙ্গিক, জ্ঞাতব্য এবং উপভোগ্য রচনা। ড. অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের নিবন্ধ ‘পুরুলিয়ার ছৌ ও ধর্ম গবেষণা এবং জাতিতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিত’। তথ্যসমৃদ্ধ একটি উৎকৃষ্ট রচনা। গোপালচন্দ্র দাস লিখেছেন তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ ‘লোকায়ত জাগগান’। এই লোকসংস্কৃতির বিষয়ে এ যাবৎ উপস্থাপন খুবই সীমিত। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতিতে এই ‘জাগগান’-এর উপস্থিতি ও তার বর্ণনায় নিশ্চিত মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক। ‘লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে কার্তিক সংক্রান্তিতে ভোলাভুলি’ নিবন্ধটি লিখেছেন অহীন্দ্র দাস। পূর্ব বাংলার শ্রীহট্ট, পশ্চিম বাংলার অঞ্চল বিশেষে এবং ত্রিপুরা ও আসামের পল্লি অঞ্চলে বিভিন্ন নামে ও আঙ্গিকে কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে পালিত ভোলাভুলির এক বিস্তৃত তথ্যসম্বলিত নিবন্ধ। অরূপ কুমার ভূঞ্যার নিবন্ধ ‘জনপ্রিয় লোকশিল্প ছৌনাচ’। আসলে এটি এক লোকসংস্কৃতি যার প্রসার বহু বিস্তৃত। তবে লেখক এখানে ‘শিল্প’ বা ‘সংস্কৃতি শিল্প’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘ ভূমিকা মূল বিষয়ের পরিসর সংকুচিত করেছে।
দিব্যেন্দু নাথ-এর ‘বাবাহর’ এক সুবিস্তৃত দীর্ঘ নিবন্ধ যেখানে গ্রামাঞ্চলে আঞ্চলিক পর্যায়ে আজও, ব্যাপ্তিতে সীমিত হলেও পালিত বাবাহরের সেবার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক লোককাহিনির বিস্তারিত উল্লেখে এক দশ পৃষ্ঠাব্যাপী সুখপাঠ্য নিবন্ধ। তাপসী ভট্টাচার্যের ‘গীতিকা কীভাবে অঙ্কুরিত’ নিবন্ধটি সুচয়িত উদ্ধৃতিসম্বলিত ব্যতিক্রমী বিষয়ভিত্তিক একটি রচনা এবং স্বভাবতই অবশ্যপাঠ্য যদিও খানিকটা সুসংহত হতে পারত বলে মনে হতে পারে। ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’ নিবন্ধটি লিখেছেন মিতা চক্রবর্তী। শিরোনাম অনুযায়ী হলে এ বিষয়ে বিশাল গ্রন্থ হতে পারত। একটি নিবন্ধে তার ছিটেফোঁটাও আসত না। তবে লেখক নিবন্ধটি সীমিত রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতির উপর। এবং তা সত্ত্বেও যথেষ্ট সংকুচিত করেও একটি এগারো পৃষ্ঠার নিবন্ধ রচিত হয়েছে। নিবিষ্ট লিখনশৈলীতে যতটা সম্ভব উল্লেখে রয়েছে নানা প্রসঙ্গ ও বিষয়। প্রতিমা শুক্লবৈদ্যের ‘বরাকের ধর্ম সংস্কৃতির অঙ্গনে বৃক্ষপূজা’ একটি সুলিখিত ব্যতিক্রমী নিবন্ধ।
এছাড়াও রয়েছে জহর দেবনাথ, শ্রী রূপকুমার পাল, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, সন্ধ্যা দেবনাথ ও নিবারণ নাথ-এর বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ। রয়েছে নিভা চৌধুরীর কতিপয় শ্রীহট্টীয় আঞ্চলিক ভাষার ‘ডিটান’ বা দুই লাইনের শ্লেষাত্মক ছড়া। পরিশিষ্ট হিসেবে রয়েছে লেখকদের সচিত্র (সাদা কালো) সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
সব মিলিয়ে লোকসাহিত্য, লোকসংগীত ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক এক বিস্তৃত সম্ভার - ‘লোকসংস্কৃতি’। নান্দনিক তথা প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে শ্রী অর্ঘ্যদীপ দাস। কাগজের মান, ছাপার স্পষ্টতা যথাযথ হলেও কিছু শব্দের বানান ও ছাপার বিভ্রাটে কিছু বাক্যও বিসঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে যা হয়তো নজর এড়িয়ে গেছে সম্পাদকত্রয় ও প্রুফ রিডারের। এতে মাঝে মাঝে সরল পঠন ব্যাহত হয়েছে। একটি সদ্যোজাত সংগঠন সত্ত্বেও যা অচিরেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে আশা করা যেতেই পারে কারণ এক মহৎ উদ্যোগ ও গরজের সুস্পষ্ট ছাপ প্রত্যক্ষ করা গেছে আলোচ্য সংখ্যাটিতে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - কালজয়ী, হাওড়া
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০৫৩৯৬৬৩৯

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...