Skip to main content

সার্বিক উৎকর্ষের সংকলন - ‘লঘু গদ্য গুরু গদ্য’


প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে এমন নিটোল, নিছক একটি গদ্য সংকলন সচরাচর প্রকাশিত হতে দেখা যায় না এ অঞ্চলে, এমনকি অন্যত্রও মাঝে মাঝে যা কিছু আসে সেসব এক একটি গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ সংকলন মাত্র আজকের ইন্টারনেট ও মোবাইলের যুগে যেখানে অনেক পাঠকই ক্রমশ ই-বুকের দিকে ঝুঁকছেন সেখানে এমন একটি গদ্য সংকলন পাঠকের ছাপা-বই পড়ার আগ্রহ জিইয়ে রাখতে সমর্থ হবে নিশ্চিত
প্রাবন্ধিক সঞ্জীব দেবলস্করের গদ্য সংকলনলঘু গদ্য গুরু গদ্যধারে, ভারে ও দর্শনে যুগপৎ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তার অন্তর্নিহিত বিষয়-ভাষ্যে, নান্দনিকতায় লেখক সম্ভবত এক একটি লেখার, অধ্যায়ের বিস্তার ও আয়তনের দিকটি বিবেচনা করেই লঘু ও গুরুতে বিভাজন করেছেন সন্নিবিষ্ট নিবন্ধ বা অধ্যায়গুলিকে। তবে পাঠকের বিচারে প্রতিটি পদই যে গুরু হয়ে উঠবে এমন প্রত্যয় করা যেতেই পারে। এর কারণ সেই বিষয় ও ভাষ্য বা রচনার উৎকর্ষ। গদ্যগুলিকে লেখক সুনির্দিষ্ট বিভাগে বিন্যস্ত করেছেন। সংক্ষিপ্ত ভূমিকার কয়েকটি লাইন এখানে অবান্তর হবে না নিশ্চয়ই - ‘কয়েক বছর আগে শিলচরের প্রভাতি অনুষ্ঠানের জন্য লিখেছিলাম কিছু ছোট বড় মাঝারি কথিকা। ...রেডিওতে একটিবার উচ্চারিত হয়েই আকাশে মিলিয়ে যাওয়াই তো ছিল এর ভবিতব্য... কিছু উদ্ধার করতে পেরেছি বিনা পরিশ্রমে, গুনে দেখি হাতে এসেছে শতাধিক কপি। কেমন মায়া পড়ে গেল, আবর্জনার স্তূপে ফেলতে গিয়েও পারলাম না। এর মধ্যে ৬৫টি লেখা নিয়ে এ সংকলন...।’
এ যে লেখকের ভদ্রজনোচিত বিনয় তা অচিরেই উপলব্ধিতে আসে নিমগ্ন পাঠকেরবিন্যাস অনুযায়ী প্রথমেই ‘সংকলিত আজকের প্রসঙ্গ’ বিভাগে আছে ৪২টি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ, আজকের দিনে যা অণুনিবন্ধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতে দেখা যায়। এক থেকে দেড় পৃষ্ঠার এই সব গদ্যাংশ বা কথিকায় যে উঠে এসেছে কত বিচিত্র বিষয় তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিটি বিষয় সুচয়িত এবং অতিশয় সুলিখিত। নিবিষ্ট পাঠকের জো নাই একটি অধ্যায়ও না পড়ে এড়িয়ে যাওয়ার। কথা থেকে গান, গোরু থেকে গাড়ি, বানান থেকে কবিতা, ভুবনতীর্থ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ, রমজান থেকে ক্রিসমাস কী নেই এখানে। প্রতিটি লেখাই যেন একাধারে এক একটি স্বল্পদৈর্ঘের তথ্যভাঁড়ার এবং রসাশ্রয়ী উপস্থাপন
পরবর্তী পর্বে ‘নির্বাচিত কলাম’ শীর্ষক আটটি বিভাগে রয়েছে ২১টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর অধ্যায়। একই সাবলীলতায় এখানেও এসেছে নানা প্রসঙ্গ। মাতৃভাষা দিবস, শেখ মুজিবুর, কবি শক্তিপদ, উনিশের চেতনা, ড. হীরেন গোঁহাই, প্রতিবাদের ভাষা, গানের সুর, সিলেট ও সিলেটি, ঐতিহাসিক সুজিৎ চৌধুরী, জি সি কলেজ ইত্যাদি। আপন অনুভব ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত সব বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধ যার ব্যাপ্তি দেড় থেকে আড়াই পৃষ্ঠা। তত্ত্ব ও তথ্যে ঠাসা এসব বিষয় নিয়ে নান্দনিক ভাষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে এক একটি অধ্যায়। এতটাই জমজমাট যে এখান থেকে নবীন পাঠক বেছে নিতে পারেন তাঁর লেখালেখি কিংবা গবেষণার আকর তথ্যসমূহ।
শেষ পর্বে রয়েছে তিনটি গল্প। বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করার আগে, সূচিপত্রে চোখ বুলিয়ে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হতেই পারে যে একটি গদ্য বা নিবন্ধ সংকলনে আবার ‘গল্প’ কেন? ব্যাপারটা কি খানিক ‘লঘু’ হয়ে গেল না ? আলোচকের মননেও এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে। তবে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় গল্পসমূহের পাঠশেষে। প্রতিটি গল্পই আসলে গল্পের আদলে এক একটি তথ্যভিত্তিক নিবন্ধ। এক বিচিত্র, মার্জিত লিখনশৈলীতে লিখিত গল্পগুলিও পাঠকের দরবারে উপস্থাপিত হয়েছে সংলাপে, বুনোটে, চরিত্রের উপস্থাপনায় এক ভিন্নতর আবহে, ভিন্নতর আঙ্গিকে। সূচিপত্রে তাই ‘গল্প’ বলে উল্লেখ করা হলেও আদতে সম্পূর্ণ গ্রন্থই এক উৎকৃষ্ট গদ্য সম্ভার।
গ্রন্থের স্পষ্ট ছাপা ও বাঁধাই, যথাযথ অক্ষর বিন্যাস। সততই বানান সচেতন লেখকের বানান নিয়েও আছে নির্বাচিত গদ্য। সুতরাং আধুনিক বানানের যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় গ্রন্থ জুড়ে - যদিও নগণ্য সংখ্যক শব্দে বানান ও ছাপার বিভ্রাট রয়ে গেছে, যা প্রকৃতার্থে ‘অনিবার্য’ই। প্রকাশক অক্ষর পাবলিকেশনস্‌-এর বইয়ে যুক্তাক্ষর সততই অগতানুগতিক। ফলত পাঠবিভ্রাটের দিকটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পুস্পল দেব-এর প্রচ্ছদ যথারীতি নান্দনিক। গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন ‘আকাশবাণী শিলচরের প্রাক্তন অধিকর্তা শ্রীমতী জয়তি পুরকায়স্থ ও দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী তৈমুর রাজা চৌধুরীর প্রতি’। সব মিলিয়ে সার্বিক এক উৎকর্ষের গদ্য সংকলন - ‘লঘু গদ্য গুরু গদ্য’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২৭৫ টাকা
প্রকাশক - অক্ষর পাবলিকেশনস্‌ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...