Skip to main content

নিঃশব্দে কারা যেন পুকুরঘাটে লিখে রাখে বিরহ-চিহ্ন......। ‘ডুবসাঁতার’


পাহাড়ি শরীরের ভাঁজে ভাঁজে
মেঘের চুমুক
চিবুক ধোয়া সন্ধ্যায় চুঁইয়ে পড়ে
বৃষ্টিজল... (দার্জিলিং শীর্ষক প্রথম কবিতার প্রথম স্তবক)।
কলকাতার পালক পাবলিশার্স পরিবেশিত ও ‘নির্বাণ’ প্রকাশিত আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম থেকে ৫৬তম কবিতার এই সফরকে এক কথায় এক ডুবসাঁতারই বলা চলে, যাতে উঠে এসেছে কবিতার বহু ধনসম্পদ, মণিমাণিক্য কী সেই সম্পদ, সেই হিরে জহরত ? তা ক্রমশ প্রকাশ্য প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে ৬৪ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৫৬ পৃষ্ঠা জুড়ে সংখ্যার হিসেবে রয়েছে ৫৬টি কবিতা চার লাইন থেকে পৃষ্ঠা পেরোনো সার্বিক ভাবে গ্রন্থনামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যেসব সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায় তার কিছু আছে গ্রন্থনাম শীর্ষক এই কবিতায় -
দীর্ঘতর অন্ধকারে / বৃষ্টি ছুঁয়েছি বহুদিন, / স্বপ্ন দেখেছি / মাঝ সমুদ্রে… /
এখন উত্তাল ঢেউয়ে / দিশেহারা গন্তব্য– / তবু, ডুবসাঁতারে / ছেকে আনি / শেকড়-মাটির ঘ্রাণ, আর / প্রতিস্রোতে টের পাই / পরিচিত স্বর…  (কবিতা - ডুবসাঁতার)
শেকড়-মাটির ঘ্রাণের অনুষঙ্গ হয়ে উঠে আসে পাহাড়, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, সাগর, স্রোত-প্রতিস্রোত, চাঁদ, গাছ, রোদ্দুর, জ্যোৎস্না, নৈঃশব্দ্য, প্রেম-ভালোবাসা আর কবির শহর শিলচর ও শহরের প্রান্ত ছুঁয়ে যাওয়া বরাক নদী ও তার সাম্প্রতিক বন্যার বিভীষিকা। বন্যার করাল থাবায় বিপন্ন মানুষের হাহাকারে আন্দোলিত কবি রত্নদীপ দেব এখানে সন্নিবিষ্ট করেছেন ‘জলবন্দি’ সিরিজের আটটি কবিতা। প্রতিটি কবিতার শেষ স্তবকে কবি নির্মোহে এঁকে দিয়েছেন কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অমোঘ পঙ্‌ক্তি যার উল্লেখ না করলেই নয় -
বন্যার ঘোলাজলে / এখন ধূসর হচ্ছে / শহুরেপনাও... (জলবন্দি - ১)
জানালায় চোখ রেখেছে / জলবন্দি কিশোরীও... (জলবন্দি - ২)
নদীর জলস্তরেই মাপছি এখন / প্রিয়জনদের অসুখ... (জলবন্দি - ৩)
জলের তলায় খড়কুটো খুঁজছে / নাগরিক সম্ভ্রম... (জলবন্দি - ৪)
জলমগ্ন শহরে নেই জল ! (জলবন্দি - ৫)
...বরং তাণ্ডব শেষে নদীর কাছেই / নতজানু হোক সভ্যতা / তখন ফের জলের বুকে নামবে / কত আকাশের ছায়া... (জলবন্দি - ৬)
সংবাদ শিরোনাম... / ফের বিপদসীমার উপরে বরাক / ৩ সেমি করে বাড়ছে জল (জলবন্দি - ৭)
মেয়েটির চোখের তারায় এখন কীসের পিছুটান / খড়কুটো খুঁজছে আস্ত একটা শহর... (জলবন্দি - ৮)
গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই দোলা দেয় পাঠকমনে। এক তীব্র পঠনসুখের জন্ম দেয় প্রতিটি কবিতা। নৈপুণ্য আর বক্তব্য যেন পাশাপাশি এগিয়ে গেছে কবিতার শরীর বেয়ে। বৃষ্টিকে নিয়ে কবির জলকেলি কিংবা কবিতাকেলি খানিকটা বেশিই অনুভূত হয়। আসলে সব কবির কবিতায়ই বৃষ্টি চিরদিন এক বিস্ময়, এক অপ্রতিরোধ্য অনুষঙ্গ। আলোচ্য গ্রন্থেও তাই কবি লিখেছেন দুটি ‘বৃষ্টিমুখর কাব্য (১ ও ২)। কিছু পঙ্‌ক্তি -
এসো বৃষ্টি, কবিতাকে ছুঁয়ে যাও / প্রতিদিন প্রতিরাতে, / মুছে যাক সেইসব গ্লানি / নিস্তব্ধ রাতে শুনি / যতসব অপ্রাপনীয়ের কথকতা / এসো বৃষ্টি / চোখের পাতায় পাতায়, / জীবনের পবিত্র স্বাদে বেঁচে উঠি / আরও একবার... (বৃষ্টিমুখর কাব্য ১)
বৃষ্টিমুখর দিনলিপি থেকে এবার জেগে ওঠ / প্রেম, নৈঃশব্দ্য আর / সাতরঙা শব্দ / যদি ভাব, ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো বার্তা নেই / তবে জেনে রেখো / মেঘবাড়ির ছাদ ভেঙে / একদিন ফের / বৃষ্টি নামবেই নামবে / আমার বুকে... (বৃষ্টিমুখর কাব্য ২)।
বৃষ্টি নিয়ে একাধিক কবিতায় কবি যেন ঢেলে দিয়েছেন যাবতীয় কাব্যসুধা। উদাহরণ -
ফেসবুকে তোমার মেঘরঙা ছবি পোস্ট হলে / বৃষ্টি নামে বারান্দায় / গায়ে অবিতাছাঁট এলে / কমবয়েসি একটা সময় হাতে হাত রাখে / খোলা জানালায়... (কবিতা - কবিতাছাঁট)। কিংবা -
সন্ধেশহর রেলিং ধরে শুকোচ্ছে / প্রেমতলার মোড়ে... / আপলোড হয় একের পর এক সেলফি / আর, কোথাও কোনো এক পুকুরপাড়ে / দুহাতে বৃষ্টি মেখে / শপথ নিচ্ছে / পুরোনো প্রেম... (কবিতা - শপথ)।
এভাবেই ক্রমে ক্রমে মেঘ, বৃষ্টি, জল, নদী সাগরের গভীরে কবির ডুবসাঁতারে উঠে এসেছে গুচ্ছ গুচ্ছ অনাবিল সব পঙ্‌ক্তি যা দাগ রেখে যায় মননে, পঠনশেষে। হার্ডবোর্ড পাকা বাঁধাইয়ের গ্রন্থের ছিমছাম নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন সৌরভ দে। কাগজের মান যথাযথ, স্পষ্ট ছাপা, বিন্যস্ত অক্ষর/শব্দ/পঙ্‌ক্তি। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর পাঁচজন ‘দীর্ঘবছরের সহযাত্রী কবিতামগ্ন প্রিয় বন্ধুদের’। আধুনিক বানান অনুসৃত হলেও ফাঁক গলে থেকে গেছে কিছু বানানের ত্রুটি, যা প্রকৃতপক্ষে ‘প্রায়’ অনিবার্য। গ্রন্থের দ্বিতীয় ব্লার্বে সচিত্র কবি-পরিচিত থাকলেও প্রথম ব্লার্বটি খালি থাকায় কিছু বিসদৃশ লেগেছে।
সবকিছু মিলিয়ে যাবতীয় দুর্বোধ্যতা থেকে দূরে স্বচ্ছ নান্দনিক বোধ ও কবিতার বনেদিয়ানাযুক্ত এক নয়নশোভন ও পঠনসুখের কাব্যগ্রন্থ ‘ডুবসাঁতার’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১৭০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৫১৬১০৬ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...