Skip to main content

ড্রাইভার

 ড্রাইভার

 

মাস্কশব্দটা বলতে ভীষণ এলার্জি রূণার। বড্ড খটমটো উচ্চারণ। বিশেষ করে যদি কালো মাস্ক হয়। ছাত্র জীবনে বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়েছিল রুণা। কিছু বই পত্তরও পড়েছে এ নিয়ে। তাই মাস্ক বলতে গিয়ে মার্ক্স - আর কালো হলে তো সরাসরি কার্ল মার্ক্সই বলে ফেলে প্রায়শই। এ নিয়ে বিদ্রুপ করে দেবাশিস। আর বাবার কথায় ফোড়ন দেয় পুঁচকি মেয়েটাও। এখন তাই ওই বিদঘুটে শব্দটাকে এড়িয়ে বলে - ‘নাকেরটাএ নিয়ে ঘরে প্রায়ই হাসাহাসি। দেবাশিস কোথাও বেরোচ্ছে তো কাজে ব্যস্ত রুণা পেছন থেকে রিমাইণ্ডার দেয় - নাকেরটা নিয়েছ ? প্রথম প্রথম রসিকতা করত দেবাশিস। বলত - হ্যাঁ, নাকছাবিটা নিয়েছি। তবে কানের আর গলারটা পরিনি। হাসির রোল উঠত। এখন সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। শোধরায়নি রুণা।

সেদিন - এক দুপুরে, দেবাশিস তখন অফিসে। অত্যাবশ্যকীয় বিভাগে চাকরি করার সুবাদে লক ডাউনেও রেহাই নেই দেবাশিসের। বিশেষ দরকারে তাই নিজের নাকেরটাভালো করে লাগিয়ে নিয়ে রুণা বেরোয় পথে। রোদে প্রায় আধ মাইল দূর হেঁটে যেতে হবে। দরকারি কিছু ওষুধ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। এখনই না আনলে নয়। কাল ভুলে গেছে দেবাশিসকে বলতে। বাধ্য হয়েই তাই বেরোতে হয়েছে। আগে হলে নিতাইকে ডেকে গাড়ি করেই যেতে পারত। নিতাই ওদের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত এবং খুবই দক্ষ ড্রাইভার। কিন্তু এখন নিজেদের গাড়ি করেও বাইরে বেরোতে মানা। তাছাড়া অনেক দিন ধরে নিতাই এর আর কোনও খোঁজখবরও নেওয়া হয়নি। কেমন আছে কী জানি ? লক ডাউনে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে নিতাই-এর মতো কত শত ছেলেরা। অথচ ভীষণ রকমের তৎপর ছেলে ছিল নিতাই। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। গাড়ি করে এদিক ওদিক যেতে গিয়ে কত জায়গায় যে কত রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে রুণাদের। কিন্তু নিতাই-এর উপস্থিত বুদ্ধি আর বাকচাতুর্যে বেরিয়ে এসেছে সহজে। মনে পড়ে রুণার - বাবা বলতেন নাপিত আর ড্রাইভাররা নাকি খুব চালাক ও বুদ্ধিমান হয়। নরানাং নাপিত ধুর্ত, পক্ষীধুর্ত বায়সঃ।

###

রোদের উত্তাপ খুব প্রখর না হলেও অসহনীয় লাগছে রুণার। কিন্তু কিছু করার নেই। তাই পা চালাতে থাকে। রাস্তায় লোকজন খুবই কম। কেমন যেন বদলে গেছে চেনা পৃথিবীটা। খানিকটা পথ এগোনোর পর কিছু লোকজন, কিছু খোলা দোকানপাট দেখতে পেলো। এক পাট খোলা রেখে অবৈধ ভাবে বিকিকিনি চালাচ্ছে অসহায় দোকানদাররা। পথ চলতি লোকেরা যে যা পারছে কিনছে। পথের পাশের ফুটপাথে কিছু পুরুষ মহিলা শাকসব্জি নিয়ে বসেছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে চলছে রুণা। মনে পড়লো - আরোও খানিকটা এগোলেই নিতাইদের ঘর। পথের পাশেই। মনে মনে ভাবল একটু খোঁজ খবর নেবে সম্ভব হলে।

নিতাইদের ঘরের কাছাকাছি যেতেই একটু চমকে উঠলো রুণা। এই তো নিতাই। ঘরের সামনের ফুটপাথে একটি তরমুজ আর দুমুঠো পাট শাক নিয়ে বসে আছে। নিতাইকে এভাবে দেখে কান্না পেয়ে যায় রুণার। হে ভগবান, এ কী দশা করেছ তুমি এই গরিব মানুষগুলোর ? ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে রুণা।

পা চালিয়ে কাছে আসতেই এবার চিত্রনাট্য পুরোপুরি বদলে গেল চোখের সামনে। এক খরিদ্দার ভদ্রলোক দাম দর করছেন নিতাই-এর সঙ্গে। তরমুজ - একেবারে তরতাজা দেখাচ্ছে। নিতাই বলছে - “কাকু, একদম লাল ভেতরটা। আমাদের গাছের তরমুজ। নিতাই-এর কথা শুনে রুণার ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। ফিক করে হেসে ফেলেও গুটিয়ে নেয় নিজেকে। শেষটা দেখতে হবে। ইতিমধ্যে খরিদ্দার নিতাই-এর কথায় উৎসাহী হয়ে কিনেই নিলেন একমাত্র তরমুজটি। ভদ্রলোক চলে যেতেই এবার সামনে এসে রুণা বলে - কী রে নিতাই ? কোথা থেকে এনেছিস তরমুজ ?

রূণাকে দেখে লজ্জা পেয়ে নিতাই বলে - বাজার থেকে এনেছি দিদিমণি।

- তাহলে একটা কেন মাত্র ?

- ঘরে আছে অনেকগুলি, একটা একটা করে আনবো এখানে।

- আর পাট শাক শুধু দুমুঠি কেন ?

- সেও অনেক আছে দিদিমণি। সকালেই এনেছি বাজার থেকে। তবে সেও ওই দুচার মুঠি করেই এখানে আনছি।

রুণা বুঝে যায় নিতাই-এর ফন্দি। অল্প অল্প করে এখানে এনে রেখে সবই ঘরের বলে বিক্রি করছে নিতাই। এতে সহজেই খরিদ্দারের মন জয় করতে পারছে আর পুলিশ আসলে জিনিষপত্র নষ্ট হওয়ার আশংকাও নেই। আসলে এখন বুদ্ধি বেঁচেই খাচ্ছে নিতাই।

রুণা এরপর খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করে। জবাবে হতাশা ঝরে পড়ে নিতাই-এর চোখে মুখে। রুণার সময় চলে যাচ্ছে অনেকটা। বলে - “আমি ফেরার পথে কিছু পাট শাক কিনবো তোর কাছ থেকে। বলে পা বাড়ায় রুণা। নিতাই দৌড়ে ঘরের ভেতর যায় পরবর্তী তরমুজটি আনার জন্য।

###

ওষুধপত্র কিনে ফেরার পথে রুণা যখন আবার প্রায় এসেই পড়েছে নিতাইদের ঘরের খুব কাছাকাছি ঠিক তখনই ঘটে যায় এক অভাবনীয় ঘটনা। দেখতে পায় একটি মারুতি ভ্যান গাড়ি প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে যায় একেবারে নিতাই-এর পসরার সামনে, রাস্তার উল্টোদিকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসেন এক পুলিশ কর্মী আর সেই গাড়িটির ড্রাইভার। হকচকিয়ে উঠে নিতাই। ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রুণা। মনে পড়ে বাবা বলতেন - বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্তিশ ঘা। রুণা নিশ্চিত এবার সব পসরা লণ্ডভণ্ড করে উঠিয়ে নিয়ে যাবে ওরা আর হয়তো নিতাইকেও উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ভীষণ মুষড়ে পড়ে রুণা।

কিন্তু এরপর রুণার চোখের সামনে যা ঘটলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। পুলিশ কর্মীটি নেমে পসরার দিকে এগিয়ে আসতে না আসতেই নিতাই প্রচণ্ড জোরে কাশতে শুরু করলো আর এক পলক সূর্যের দিকে তাকিয়েই পুলিশের প্রায় মুখের উপর ছুঁড়ে দিল এক বিরাশি সিক্কার - হাঁচি।

আর যায় কোথায় ? দুহাতে নাক মুখ ঢেকে পড়িমরি করে পুলিশ আর ড্রাইভারটি গাড়িতে উঠেই চোখের নিমিষে পগার পার।

ঘটনার ঘনঘটায় হতচকিত রুণার মনে হচ্ছিল হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। এগিয়ে এসে নিতাই-কে জিজ্ঞেস করে - “কী রে নিতাই, তোর সর্দি কাশি হয়েছে ?”

জিভটা কামড়ে লজ্জিত নিতাই বলে - “না, না দিদিমণি। ও এমনি।

এবার আর হাসিটা আটকে রাখতে পারে না রুণা। একচোট হেসে নিয়ে কিছু পাট শাক কিনে হাতে রাখা টাকার ব্যাগটি খুলে আলাদা করে একটা পাঁচশো টাকার নোট নিতাই-এর হাতে দিয়ে বলে - “এটা রাখ। না ফেরালেও চলবে।

কুণ্ঠিত নিতাই অসহায়ের মতো হাত পেতে নেয় টাকাটি। বলে - “কিছু লাগলে বলবেন দিদিমণি।

সায় দিয়ে ঘরের পথে পা বাড়ায় রুণা। মনে পড়ে বাবা আরোও একটি কথা বলতেন - একশোটি শেয়াল মলে একটি নাপিত আর একশোটি নাপিত মলে একটি - - - - - - ।

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...