জলরং অথবা লিথোগ্রাফ - একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া
সদ্য হাতে এলো কবি মমতা চক্রবর্তীর
ছিমছাম কাব্যগ্রন্থ
- ‘জলরং অথবা লিথোগ্রাফ’। হাতে এলো বেশ খানিকটা দেরি করেই। প্রথম
ও একমাত্র প্রকাশ যদিও লিখা আছে ২০১৬ কিন্তু প্রকাশিত হতে হতে হয়েছে ২০১৭। বছর
তিনেক হয়ে গেছে যদিও তবুও পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখার লোভ সংবরণ করা গেলো না। কারণ - ‘কিছু কথা কখনো পুরোনো
হয় না’।
মনোগ্রাহী প্রচ্ছদ ও নামাঙ্কনের পারিপাট্যেই ‘জাত’ চেনা যায় গ্রন্থটির। সাত ফর্মার এই নিটোল কাব্যগ্রন্থের
প্রচ্ছদ এঁকেছেন দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক। কোলকাতার অক্ষর প্রকাশন থেকে প্রকাশিত
এই কাব্য সংকলনে সন্নিবিষ্ট রয়েছে মোট ৫১টি কবিতা। কবির জীবনের এক দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে
লিখিত এই কবিতাগুলোকে উৎসর্গ করা হয়েছে তাঁর লোকান্তরিত মা মিনতি চক্রবর্তী, বাবা মনীন্দ্র চক্রবর্তী
ও অকালপ্রয়াত সহোদরা মঞ্জুলিকা চক্রবর্তীর স্মৃতিতে।
অনু থেকে পৃষ্ঠাজোড়া কবিতাগুলোতে এক
বিশাল ব্যাপ্তি, বৈচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় কবির কবিতায়। অধিকাংশ কবিতাই আত্মকথন পর্যায়ের। কবিমনের
চাওয়া পাওয়া, ক্ষোভ, অনুভূতির বিস্তৃত প্রতিফলন। প্রাথমিক
পর্যায়ে লিখিত কিছু কবিতায় যেমন সরাসরি উগরে দেওয়া হয়েছে ভাব তেমনি কিছু কবিতায় অপূর্ব
ব্যঞ্জনায় কথিত হয়েছে বক্তব্য। তাই এক কথায় বলতে গেলে ভাব বৈচিত্রে
ভরপুর এক কবিতা সম্ভার এই গ্রন্থটি। সন্নিবিষ্ট হয়েছে কবির লিখা প্রথম
কবিতাটিও (সপ্তম শ্রেনিতে পড়ার সময় লিখিত)।
কবির ভৌগোলিক অবস্থানের বৈশিষ্ট বারবার
ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর একাধিক কবিতায়। উনিশ আর একুশ ফিরে এসেছে কবিতান্তরে। ঠিক
তেমনি বরাক আর কৃষ্ণচূড়াও এসেছে একাধিকবার। স্বল্প কথায় অসাধারণ প্রকাশ ঘটে অভিব্যাক্তির। যেমন -
কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণচূড়া
কৃষ্ণচূড়া ফুল।
তুমিই আমার উনিশ একুশ
প্রাণ করা আকুল।।
(কবিতা, কৃষ্ণচূড়া ফুল)
কিংবা -
একুশ বাজায় ‘অগ্নিবীণা’ উনিশ ‘বিষের বাঁশি’
এদের জন্যে হাসি-কাঁদি, অথৈ জলে ভাসি,
উনিশ ফোটায় কৃষ্ণচূড়া, হৃদয় ছলোছলো
একুশ ফোটায় হাজার পদ্ম রঙে ভুবন আলো।
(কবিতা, ঊনিশ - একুশ)
কবির
আত্মসচেতনতা তথা দৃপ্ত মননের পরিচয় শব্দের সাবলীল চয়নে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে কিছু
কবিতায়। কিছু কবিতার কিছু পংক্তি চমকে দেওয়ার মতো। যেমন -
প্রতিদিন অসূয়ার আগুনে পোড়াই
আম ও আমার আবাস
তাই তোমার যাজ্ঞসেনী চোখে
আমার জীবন-মরণ-সহবাস।
(কবিতা, জাজ্ঞসেনী চোখে)
কিংবা -
শব্দ ঝরো অস্ত্র হয়ে
আগুন হয়ে -
আগুন আমার দুচোখ পোড়াও
ওষ্ঠ পোড়াও অধর পোড়াও
কলজে পোড়াও, হৃদয় পোড়াও
নাসিকা পোড়াও, নাভিও পোড়াও
-- হে আমার আজন্ম প্রেমিক
আমি যেন নির্দ্বিধায় বলতে পারি -
‘রাজা তোর কাপড় কোথায় ?’
(কবিতা, আজন্ম প্রেমিক)
প্রচলিত
বা ছাঁচভাঙা ছন্দের ধার না ধেরেও অবলীলায় তরতরিয়ে এগিয়ে গেছে কবিতার ধারা। আধুনিক
কবিতার বৈশিষ্টকে অটুট রেখে সুচারু রূপে এড়িয়ে গেছেন অত্যাধুনিক কবিতার
দুর্বোধ্যতা। এখানেই কাব্য সংকলন পাঠের সুখ ও স্বাচ্ছ্যন্দ। কবি নিজেই হয়তো পাঠক
মননে কাব্যগ্রন্থের স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তাই তো
এই নামাকরণ - ‘জলরং অথবা লিথোগ্রাফ’। কিন্তু পাঠক হিসেবে এটুকু অবশ্যই বলা যায় যে
এ মোটেই জলরং নয়, এ একেবারে খাঁটি লিথোগ্রাফ। কখনো মুছে যাবার নয়।
Comments
Post a Comment