ইংরেজীতে একটা কথা আছে
- Morning shows the day.
অর্থাৎ শৈশবেই মানুষের ভবিষ্যতের একটা আভাস পাওয়া যায়। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও জীবনে নান্দনিক শিক্ষার একটা মস্ত প্রয়োজন আছে। কলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্র কর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের উৎকর্ষতা প্রকৃত ভাবে পরিষ্ফূট হয়।
আমার জীবনের নান্দনিক শিক্ষার মূল কারিগর আমার নিজের আপন দিদি। প্রচণ্ড আর্থিক প্রতিকূলতা ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কেটেছে আমার শৈশব ও বাল্যকাল। কিছু সজ্জন ব্যক্তির আনুকূল্যে অতি কষ্টে সংসারের আটপৌরে প্রদীপ জ্বলছিল টিমটিম করে।
স্বাভাবিক শিক্ষাও যেখানে বিলাসিতা সেই কঠিন সময়েও একদিন কোথা থেকে যেন এক জোড়া তবলা এনে ঘরে হাজির করল দিদি আর আমাকে বলল - তোকে তবলা বাজানো শিখতে হবে। গরিবিয়ানার ছাপ পারতপক্ষে আমার উপর পড়তে দিত না কেউ। তাই হাতের কাছে তবলা পেয়ে হতভম্ব আমি তো বেজায় খুশি। কিন্তু কী করে যে বাজাব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না।
এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই গাঁয়ের এক মৃদঙ্গ বাদক আমাকে তবলা শেখানো শুরু করলেন। সেই অর্থে তিনিই ছিলেন আমার প্রথম গুরু। কিন্ত কিছু দিন শেখার পরই সেই বয়সের আমিই বুঝতে পারলাম যে আমার তবলা শিক্ষা ঠিক পথে এগোচ্ছে না। দিদিকে কথাটা বললাম।
এর কয়েক দিন পর এক দুপুরে দিদি এসে বলল - চল এক জায়গায় ঘুরতে যাব। কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে দু'টিতে গিয়ে হাজির হলাম দিদির এক বন্ধু স্থানীয় মহিলার বাড়িতে। ওঁনার নাম ছিল হেলেনা এন্দো। সেখানে গিয়ে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। সংগীত শিক্ষার বিশাল আসর। মেঝেতে পাটি পেড়ে একদিকে গান ও আরেক দিকে তবলা শেখানো হচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের।
সেদিন সেখানেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলো তবলা শিক্ষক শ্রী সজল কান্তি নাথের সঙ্গে। আমার তবলা শিক্ষার প্রকৃত গুরু।
এরপর সেই শিক্ষার আসর স্থান বদলে চলে আসল রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের এক শ্রেণিকক্ষে। সেখানেই চলল আমার তবলা শেখার পালা। মনে পড়ে তখন সেখানে গান শেখাতে সুদূর কালীবাড়ি বাজার থেকে আসতেন সংগীত শিক্ষক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ রায়। তাঁর দরাজ ও গুরুগম্ভীর আওয়াজের সাথে সজল-দার তবলা সঙ্গত সারা বিদ্যালয় চত্বরে সৃষ্টি করত এক অপরূপ মূর্ছনার।
দীর্ঘ তিনটি বছর সজল-দার তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভের পর মাঝপথেই আমাকে সাময়িক বিরতি নিতে হলো। কারণ তখন শিয়রে মাধ্যমিক পরীক্ষা। বিশারদটা আর দেওয়া হলো না।
পরে সেই সাময়িক বিরতিই আমার কাল হলো।
অভাবগ্রস্ত পরিবারের আমার তখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল রোজগার। তাই সাত সাতটি বছর ধরে অধ্যয়নকেই পাখির চোখ করে প্রথম চাকরি পেলাম উজান আসামের ডিগবয় শহরে।
কারিগরি আর নন্দন বিদ্যার আকাশ পাতাল তফাৎ। তবুও স্বপ পূরণের তীব্র নেশায় সেখানে বিশিষ্ট তবলা বাদক শ্রী পবন ভট্টাচার্যর অধীনে ভর্তি হলাম তবলা শিক্ষার ক্লাসে। পাশাপাশি চলতে থাকল চাকরি ও তবলা শিক্ষা। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে দ্বিতীয় বছরেই চাকরি বদলের সূত্রে চলে আসতে হলো নগাঁও।
অধরা রইল বিশারদের স্বপ্ন। নগাঁও থাকাকালীন নতুন চাকরির বর্ধিত দায়িত্ব ভার সামলাতে হিমশিম খেতে খেতেও সেই অধরা স্বপ্নের আকর্ষণে আবার গিয়ে হন্যে দিয়ে পড়লাম আসামের প্রথিতযশা তবলিয়া শ্রী বিবেকানন্দ ভট্টাচার্যর পদপ্রান্তে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলাম। কিন্তু আবারও সেই স্বপ্ন ভঙ্গ। এবার বদলি সুদূর ত্রিপুরা রাজ্যে। ততদিনে জীবনযাত্রারও হয়েছে অনেক পরিবর্তন। স্বপ্ন পূরণের আশা এবার ছাড়তে হলো চিরতরে।
তবে এতগুলো বছরে তবলার সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার জন্য লিখিত ভাবে বিশারদ পাশ না করলেও কার্যক্ষেত্রে বর্তমানের অনেক বিশারদ পাশ তবলচির তুলনায় হয়ে উঠেছিলাম অনেক বেশি পরিপক্ক। তাই এই ক'বছরে প্রাপ্তির ভাঁড়ার আমার প্রায় ভরে উঠেছিল কানায কানায়।
শিলচর ও নগাঁও জেলা গ্রন্থাগার সহ অন্যান্য মঞ্চ, তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড়, লখিমপুর সহ আরোও অনেক ছোট বড় মঞ্চে পরিবেশন করার বাইরেও নগাঁও বেতার কেন্দ্র ও মুম্বইতে অনুষ্ঠিত সারা ভারত সঞ্চার সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে আসামের মধ্যে প্রথম হয়ে অংশগ্রহণ হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
কিন্তু এত কিছুর পরেও স্বপ্ন পূরণের সেই অদম্য ইচ্ছা আমার রয়েই গেছিল শেষ অবধি।
তবে বোধ করি শেষেরও একটা শেষ থেকে যায়।
এবার আসি স্বপ্ন পূরণের সেই শেষ অধ্যায়ে। মানুষের জীবনের সব স্বপ্ন কখনও পূর্ণ হয় না। তবে তার অনেকখানিই পূর্ণ হয় সন্তানের মাধ্যমে। যেদিন আমি প্রথম আমার মেয়ের গানের সঙ্গে মঞ্চে তবলা সঙ্গত করি সেদিন আমার দু'চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নেমে আসে জীবনভর লালিত স্বপ্ন পূরণের গর্বিত জলোচ্ছ্বাস।
ষোলকলা সেদিন হলো পূর্ণ যেদিন মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আমার ছোট বেলার বিদ্যালয় রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠেরই এক কক্ষে তবলা বাদনে মেতে উঠলাম বালক বেলার সহপাঠী বন্ধু, বান্ধবী ও তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের সঙ্গে।
সার্থক হলো আমার সঙ্গে আমার দিদিরও স্বপ্ন।
সহপাঠী বন্ধু বান্ধবীদের মিলনোৎসব তাই আমার কাছে হয়ে রইল স্বপ্ন পূরণের সোপান।
প্রাক মিলনোৎসব সময়ে দীর্ঘ প্রায় চল্লিশটি বছর পর এক সন্ধ্যায় গুরু দর্শনের সেই মুহূর্তটাও হয়ে রইল স্মৃতির পাতায় ভাস্বর।
অর্থাৎ শৈশবেই মানুষের ভবিষ্যতের একটা আভাস পাওয়া যায়। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও জীবনে নান্দনিক শিক্ষার একটা মস্ত প্রয়োজন আছে। কলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্র কর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের উৎকর্ষতা প্রকৃত ভাবে পরিষ্ফূট হয়।
আমার জীবনের নান্দনিক শিক্ষার মূল কারিগর আমার নিজের আপন দিদি। প্রচণ্ড আর্থিক প্রতিকূলতা ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কেটেছে আমার শৈশব ও বাল্যকাল। কিছু সজ্জন ব্যক্তির আনুকূল্যে অতি কষ্টে সংসারের আটপৌরে প্রদীপ জ্বলছিল টিমটিম করে।
স্বাভাবিক শিক্ষাও যেখানে বিলাসিতা সেই কঠিন সময়েও একদিন কোথা থেকে যেন এক জোড়া তবলা এনে ঘরে হাজির করল দিদি আর আমাকে বলল - তোকে তবলা বাজানো শিখতে হবে। গরিবিয়ানার ছাপ পারতপক্ষে আমার উপর পড়তে দিত না কেউ। তাই হাতের কাছে তবলা পেয়ে হতভম্ব আমি তো বেজায় খুশি। কিন্তু কী করে যে বাজাব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না।
এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই গাঁয়ের এক মৃদঙ্গ বাদক আমাকে তবলা শেখানো শুরু করলেন। সেই অর্থে তিনিই ছিলেন আমার প্রথম গুরু। কিন্ত কিছু দিন শেখার পরই সেই বয়সের আমিই বুঝতে পারলাম যে আমার তবলা শিক্ষা ঠিক পথে এগোচ্ছে না। দিদিকে কথাটা বললাম।
এর কয়েক দিন পর এক দুপুরে দিদি এসে বলল - চল এক জায়গায় ঘুরতে যাব। কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে দু'টিতে গিয়ে হাজির হলাম দিদির এক বন্ধু স্থানীয় মহিলার বাড়িতে। ওঁনার নাম ছিল হেলেনা এন্দো। সেখানে গিয়ে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। সংগীত শিক্ষার বিশাল আসর। মেঝেতে পাটি পেড়ে একদিকে গান ও আরেক দিকে তবলা শেখানো হচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের।
সেদিন সেখানেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলো তবলা শিক্ষক শ্রী সজল কান্তি নাথের সঙ্গে। আমার তবলা শিক্ষার প্রকৃত গুরু।
এরপর সেই শিক্ষার আসর স্থান বদলে চলে আসল রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের এক শ্রেণিকক্ষে। সেখানেই চলল আমার তবলা শেখার পালা। মনে পড়ে তখন সেখানে গান শেখাতে সুদূর কালীবাড়ি বাজার থেকে আসতেন সংগীত শিক্ষক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ রায়। তাঁর দরাজ ও গুরুগম্ভীর আওয়াজের সাথে সজল-দার তবলা সঙ্গত সারা বিদ্যালয় চত্বরে সৃষ্টি করত এক অপরূপ মূর্ছনার।
দীর্ঘ তিনটি বছর সজল-দার তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভের পর মাঝপথেই আমাকে সাময়িক বিরতি নিতে হলো। কারণ তখন শিয়রে মাধ্যমিক পরীক্ষা। বিশারদটা আর দেওয়া হলো না।
পরে সেই সাময়িক বিরতিই আমার কাল হলো।
অভাবগ্রস্ত পরিবারের আমার তখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল রোজগার। তাই সাত সাতটি বছর ধরে অধ্যয়নকেই পাখির চোখ করে প্রথম চাকরি পেলাম উজান আসামের ডিগবয় শহরে।
কারিগরি আর নন্দন বিদ্যার আকাশ পাতাল তফাৎ। তবুও স্বপ পূরণের তীব্র নেশায় সেখানে বিশিষ্ট তবলা বাদক শ্রী পবন ভট্টাচার্যর অধীনে ভর্তি হলাম তবলা শিক্ষার ক্লাসে। পাশাপাশি চলতে থাকল চাকরি ও তবলা শিক্ষা। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে দ্বিতীয় বছরেই চাকরি বদলের সূত্রে চলে আসতে হলো নগাঁও।
অধরা রইল বিশারদের স্বপ্ন। নগাঁও থাকাকালীন নতুন চাকরির বর্ধিত দায়িত্ব ভার সামলাতে হিমশিম খেতে খেতেও সেই অধরা স্বপ্নের আকর্ষণে আবার গিয়ে হন্যে দিয়ে পড়লাম আসামের প্রথিতযশা তবলিয়া শ্রী বিবেকানন্দ ভট্টাচার্যর পদপ্রান্তে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলাম। কিন্তু আবারও সেই স্বপ্ন ভঙ্গ। এবার বদলি সুদূর ত্রিপুরা রাজ্যে। ততদিনে জীবনযাত্রারও হয়েছে অনেক পরিবর্তন। স্বপ্ন পূরণের আশা এবার ছাড়তে হলো চিরতরে।
তবে এতগুলো বছরে তবলার সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার জন্য লিখিত ভাবে বিশারদ পাশ না করলেও কার্যক্ষেত্রে বর্তমানের অনেক বিশারদ পাশ তবলচির তুলনায় হয়ে উঠেছিলাম অনেক বেশি পরিপক্ক। তাই এই ক'বছরে প্রাপ্তির ভাঁড়ার আমার প্রায় ভরে উঠেছিল কানায কানায়।
শিলচর ও নগাঁও জেলা গ্রন্থাগার সহ অন্যান্য মঞ্চ, তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড়, লখিমপুর সহ আরোও অনেক ছোট বড় মঞ্চে পরিবেশন করার বাইরেও নগাঁও বেতার কেন্দ্র ও মুম্বইতে অনুষ্ঠিত সারা ভারত সঞ্চার সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে আসামের মধ্যে প্রথম হয়ে অংশগ্রহণ হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
কিন্তু এত কিছুর পরেও স্বপ্ন পূরণের সেই অদম্য ইচ্ছা আমার রয়েই গেছিল শেষ অবধি।
তবে বোধ করি শেষেরও একটা শেষ থেকে যায়।
এবার আসি স্বপ্ন পূরণের সেই শেষ অধ্যায়ে। মানুষের জীবনের সব স্বপ্ন কখনও পূর্ণ হয় না। তবে তার অনেকখানিই পূর্ণ হয় সন্তানের মাধ্যমে। যেদিন আমি প্রথম আমার মেয়ের গানের সঙ্গে মঞ্চে তবলা সঙ্গত করি সেদিন আমার দু'চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নেমে আসে জীবনভর লালিত স্বপ্ন পূরণের গর্বিত জলোচ্ছ্বাস।
ষোলকলা সেদিন হলো পূর্ণ যেদিন মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আমার ছোট বেলার বিদ্যালয় রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠেরই এক কক্ষে তবলা বাদনে মেতে উঠলাম বালক বেলার সহপাঠী বন্ধু, বান্ধবী ও তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের সঙ্গে।
সার্থক হলো আমার সঙ্গে আমার দিদিরও স্বপ্ন।
সহপাঠী বন্ধু বান্ধবীদের মিলনোৎসব তাই আমার কাছে হয়ে রইল স্বপ্ন পূরণের সোপান।
প্রাক মিলনোৎসব সময়ে দীর্ঘ প্রায় চল্লিশটি বছর পর এক সন্ধ্যায় গুরু দর্শনের সেই মুহূর্তটাও হয়ে রইল স্মৃতির পাতায় ভাস্বর।
Comments
Post a Comment