Skip to main content

গল্পময় বাস্তবের সংগ্রহযোগ্য সংকলন - ‘ঝিঁকা’



হালিচারাথেকে গল্পের চারাগাছগুলো এবার পরিণত ফসলের পথে ধাবিত হলো মঞ্জরী হীরামণি রায়-এর গল্প যত পড়া হয় ততই অবাক হতে হয় একটি পড়ে শেষ হতেই আরেকটি পড়ার আগ্রহ জন্মে যায় স্বাভাবিক ছন্দে। হালে ২৮ টি অনবদ্য গল্প নিয়ে প্রকাশিত হলো তাঁর নবতম গল্প সংকলন ‘ঝিঁকা’। এবং কী আশ্চর্য প্রতিটি গল্পের শেষে, মনে ভাবনার ঝিঁকাটি অবশ্যম্ভাবী রূপে অনুভূত হলো। গল্পের ভেতরে পরতে পরতে ভাবনার এমন বিস্তৃত প্রকাশ খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। ভাষায়, শব্দে, বিষয় বৈচিত্রে, স্থানীয় ভাষার ব্যবহারে, সহজ সাবলীলতায়, আন্তরিক সংলাপে, প্রাসঙ্গিক অবসরে প্রকৃতির যথার্থ রূপ বর্ণনায় প্রতিটি গল্প পাঠককে পঠনসুখের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
মোট ১৭৬ পৃষ্ঠার এই সংকলনে ২৮ টি ভিন্ন স্বাদের গল্প সন্নিবিষ্ট হলেও কোথাও যেন গ্রথিত হয়ে আছে এক আপাতঃ অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে। তলিয়ে দেখলে দেখা যায় সেই অদৃশ্য বাঁধনটি অন্য কিছু নয়, গল্পকারের অদ্যাবধি প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি গল্পের সেই সামাজিক দায়বদ্ধতারই সূত্র। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের একেবারে অন্দরমহলে বিচরণ করে পাকা জহুরির মতো তুলে এনেছেন গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার জ্বলন্ত সমস্যা ও তার প্রতিচ্ছবি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন শিক্ষিত সমাজেরও অন্তরে নিহিত অশিক্ষিতের মতো আচার ব্যবহারের পরম্পরা। আর মেহেরিশ, মালতীদের মতো চরিত্রদের মাধ্যমে উত্তরণের সোপানও দেখিয়েছেন গল্পকার।
একের পর এক গল্পে তুলে এনেছেন সহজ চোখে না দেখা মানবিক ও মানসিক সমস্যার জড়কে। উদাহরণ আলো বাতাস, উড়ান, হিন্দোলা, অন্তর, হটফ্ল্যাস, গুঞ্জাশ্রী, মোহনার দিকে, বিলোলতৃষ্ণা ইত্যাদি। শেষোক্ত তিনটি গল্পে গল্পের বুনোট খানিকটা পরিবর্তিত আকারে প্রকাশ পেয়েছে। ভাষা, শব্দ এবং বাক্যবিন্যাস চমৎকারিত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়ে সম্ভবত তাঁর আগের সব রেকর্ডকে পিছনে ফেলে দিয়ে ধাবিত হয়েছে এক গল্পময় বিশ্বের অধরা বিন্দুর পানে।
সমসাময়িক গ্রামবরাকের খেটে খাওয়া গরিব পরিবারের অন্দরে বিদ্যমান টানাপোড়েন ও তার সহযাত্রী অন্ধ সংস্কারকে জনসমক্ষে এনে পরিবেশিত হয়েছে দক্ষ শিল্পীর মতো অসাধারণ গল্পময়তায়। স্পষ্ট উচ্চারণে তুলে ধরেছেন সেসব কথা -
‘আম্মার বেহালাটা দেওয়ালেই ঝুলানো থাকতো। কথা দিয়েও কথা রাখতে পারেননি আব্বা। দাদিজি আর দাদাজি বলতেন এসব গুনাহ। আল্লাহ্‌ বেজার হবেন। আজারা বুঝতে পারে না সুর কেন খোদাকে বেজার করবে ? আজানেরও তো সুর আছে।’ (গল্প - বাসি স্বপ্ন)
কিংবা - ‘হুজুররা তো ক’দিন আগেও মাইকে বললেন - কোরান পাঠ, রোজা, নামাজ ঠিক থাকলে করোনার সাধ্য কি শরীরে প্রবেশ করে ! তাহলে সরিবুন বুবুদের এত ভয় কেন ? ওরা তো কখনো রোজা নামাজ কাজা করে না।’ (গল্প - ঝাঁকা)
অথবা - ‘মা বলেন - সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। কিন্তু এমন অথৈ সমুদ্রে গোটা পরিবারকে ভাসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা কেন যে ঈশ্বরের হলো, ইশানির ছোট্ট মন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারে না।’ (গল্প - হিন্দোলা)।
গ্রন্থের প্রথম গল্পটিই ‘ঝিঁকা’ যা তাঁর পূর্ববর্তী গল্পগ্রন্থ ‘হালিচারা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। একটি অসাধারণ গল্প। সেই গল্পটির নামেই এই গ্রন্থ। প্রায় প্রতিটি গল্পেই প্রকৃতির কিছু বর্ণনা থেকে থাকে। আলোচ্য গ্রন্থের অন্তর্গত ‘বিলোলতৃষ্ণা’ গল্পে যেন তারই পূর্ণ রূপ। এভাবেই বিষয় বৈচিত্রে অভিনব মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন গল্পকার মঞ্জরী রায়। গল্পে ফিরে ফিরে আসে জন্মভূমি বরাকের প্রিয় নদী আর কৃষ্ণচূড়ার কথা। গল্পে অনায়াসে স্থান করে নেয় এই অনুষঙ্গ।
গল্পকার এই গ্রন্থটিকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর পিতামহী সাধ্বী হরিদাসী রায় এবং বাবা ভবানীচরণ রায়কে। ভেতরের শেষ প্রচ্ছদে সন্নিবিষ্ট হয়েছে তাঁর পুর্ববর্তী গল্প সংকলন ‘হালিচারা’র উপর এই আলোচকের আলোচনার স্ক্রীনশট। চমৎকার প্রচ্ছদের ভাবনা ও ছবি - রূপকথা তরী। স্পষ্ট এবং প্রায় একশো ভাগ নির্ভুল বানান সহ অক্ষরবিন্যাস ও প্রচ্ছদ অলংকরণে মান্না দেব। মুদ্রণ - সাইমা প্রেস। আই এস বি এন যুক্ত এই গল্পগ্রন্থটি অনায়াসে পুরস্কৃত হওয়ার দাবি রাখে নিশ্চিত।
 
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
‘ঝিঁকা’
মঞ্জরী হীরামণি রায়
মূল্য - ২৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৯৫৭৮৩২৯৪২, ৮৮১২৯৭৬৪৭৮

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...