Skip to main content

'হে ঈশ্বর' - আশিসরঞ্জন নাথ


অকপট উচ্চারণের কাব্যগ্রন্থ - ‘হে ঈশ্বর


বিগত চারটি দশক জুড়ে সাহিত্যের আঙিনায় যাঁর সগর্ব পদচারণা, গবেষণাধর্মী ছোট পত্রিকার সম্পাদনায় যিনি পুরস্কৃত, বিভিন্ন আঙ্গিকের গদ্য রচনায় যিনি ইতিমধ্যেই আলোচিত এবং পরিচিত - তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থহে ঈশ্বরসম্প্রতি উন্মোচিত হলো ২০২২ এর কবিতা দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কবি আশিসরঞ্জন নাথ গ্রন্থের ভূমিকায় ‘আমার কথা’ শিরোনামে সবিস্তারে লিখেছেন এ অনুভব - ‘আশির দশকে কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি ...... কোনও যশোপ্রার্থী হওয়ার অভিলাষ পোষণ করি না। নিজের খেয়াল, নিজের আনন্দ নিয়ে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। ... জীবন সায়াহ্নে এসে একখানা কবিতার বই করতে গিয়ে বহু কবিতা পাইনি খুঁজে। এছাড়া, কবিতা লেখা ও ছাপা হওয়ার পরও অনেক কবিতা পছন্দ না হওয়ায় বাদ দিয়েছি ওইসব কবিতা। যেগুলো গ্রন্থিত হয়েছে সেগুলোও কবিতা হয়েছে কি না এ নিয়ে মনে অতৃপ্তি রয়ে গেছে। তবুও সাহসে বুক বেঁধে ক্ষীণতনু এই কবিতার বই প্রকাশে প্রয়াসী হয়েছি ......’।
এই ভূমিকার মাধ্যমেই আলোচ্য গ্রন্থের একটি আভাস পাওয়া যায় যা পঠনান্তে মিলে যায় হুবহু। কিছু কবিতা হয়তো কবির পছন্দের তালিকায় নাও থাকতে পারে কিন্তু অধিকাংশ কবিতায় তাঁর সহজ ও সপাট উচ্চারণ পাঠক মনে এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ের আভাস দেয় নিশ্চিত। সন্দিহান কবির কবিতার সাথে যেন এক লুকোচুরি খেলা -
আমাকে দু’বছর ধার দাও, হে শব্দমালা
কিছু সুরেলা শব্দ, আমি কবিতা লিখি
বহতা নদীর মত, প্রেমের কবিতা
অনেক দিন লিখতে পারিনি
কেমন যেন নিঃস্ব মনে হয় ......
লুকোচুরি খেলায় নাকি কবিতা খুবই পটু
ধরা দিয়েও অধরা, কথা বলেও নির্বাক
কেবল হাতছানি আর হাতছানি
কবি যেন কবিতার বুকে মুখ লুকিয়ে
সুখ পায়
যেমন বহতা নদীর বুকে অবগাহনের সুখ।
(কবিতা - লুকোচুরি)
গ্রন্থের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুই মলাটের ভেতরে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে এক সন্দিহান জিজ্ঞাসা।
হে ঈশ্বর,
কোথায় তোমার বাস
থাকো কোথায় তুমি
তোমার ঠিকানা কী ?
... তুমি নিরাপদ দূরত্বে আছো
নাকি মানুষের নাগালের মধ্যে ......
(কবিতা - হে ঈশ্বর)।
এছাড়া ৬০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে যে ৪৯ টি কবিতা আছে তার মধ্যে বেশ ক’টি বিষয়ভিত্তিক কবিতাও রয়েছে। যেমন - ডিটেনশন ক্যাম্প নামের এক কলঙ্কিত সময়ের কথা। শহিদ স্মরণে এ অঞ্চলের অভিমান ‘উনিশে মে’ নিয়ে রয়েছে একাধিক কবিতা।
এছাড়াও রয়েছে প্রেম ভালোবাসার ব্যতিক্রমী উচ্চারণ -  
তোমার চিঠি এলে গাছের পাতায় কৈশোর শ্যামলিমা
কোরকে কোকিলে যৌবন আভাস,
তোমার চিঠি এলে পলাশে শিমূলে সলজ্জ আবিরে
বহতা নদীর মতো নিরন্তর সাঁতার।
তোমার চিঠি এলে নীলিমা মৃত্তিকায় তোমাকেই দেখা
কমলে সূর্যে চাঁদে ও শিশিরে।
তোমার চিঠি এলে হৃদ জগতে প্রেম ও সংগ্রাম
স্বপ্নে ও চেতনায় শব্দের ভাণ্ডার।
(কবিতা - তোমার চিঠি এলে)
ভালোবাসার আবহে আছে নদী নিয়ে নস্টালজিয়া -
...... ও মেয়ে, গাঁয়ের মেয়ে
কী নাম তোর ...
মুখ ফিরিয়ে বাঁকা ঠোঁটে হাসির আভা
ঝুলিয়ে বলে -
আমাকে চিনতে পারোনি।
আমি যে গো তোমার নদী।
(কবিতা - নদী)
আছে নদীর আবহে বিপন্ন পৃথিবীর প্রতি কবির গরজ -
এখানে একটি নদী ছিল
নদী ছিল বেগবতী
...... আজ এখানে নদী নেই
নদীর নামে ক্ষীণ ধারা টিকে আছে কোনমতে
... কাঠবেড়ালি, বাঁদর আর যত ছিল
ছোট বড় পাখি
কিছু আর নেই আজ
আছে কেবল মানুষের কোলাহল।
(কবিতা - এখানে একটি নদী ছিল)।
গ্রন্থ জুড়ে কবিতা যত এগিয়েছে, পুরুষ্টু হয়েছে ধারে ও ভারে। বিষয় বহির্ভূত কবিতার মধ্যে আছে কিছু অনবদ্য উপস্থাপনা। যেমন - ‘সিরিয়ার সেই ছোট্ট মেয়েটি’। অসাধারণ মানবিক স্মৃতিচারণের কবিতা।
...... বৃষ্টি, তুমি সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে দাও
ওর কবরে, তোমার শান্তির ছোঁয়ায় পিপাসা মিটুক
দু’দণ্ড জিরিয়ে নিক
সিরিয়ার সেই ছোট্ট মেয়েটি।
এছাড়াও ‘সময় এখন থমকে আছে’, ‘আমার ঈশ্বর’, ‘আমার নৌকাজীবন’, ‘পাখি’ ইত্যাদি কবিতা পাঠক মনে ছাপ রেখে যায় নিশ্চিত। ছন্দের পথে হাঁটেননি কবি তবু কবিতায় ধরা দেয় এক অনায়াস ছন্দময়তা। এখানেই আশিসরঞ্জনের কবিতার সারসত্য। শেষ কবিতায় আবার ফিরে এসেছে গ্রন্থনামের প্রসঙ্গ ... এবং হয়তো কোনও এক মীমাংসাসূত্রও -
একটা পাখি উড়ে যায় অনন্ত আকাশে
ঈশ্বর-সান্নিধ্যের আশায়
দু-ডানায় অফুরন্ত শক্তি নিয়ে উড়ে চলে
উড়ে চলে অনন্ত পথে।
... একদিন হারিয়ে যায় অনন্ত নীলে।
(কবিতা -পাখি)।
প্রবাহ প্রকাশনী, হাইলাকান্দি থেকে প্রকাশিত বইটির মুদ্রণে আছে সাধনা প্রেস, বর্ধমান। গ্রন্থের এক সম্পদ হলো নির্ভুল বানান। কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন - ‘শ্রীচরণেষু মা’কে। মানানসই চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন গণেশ নন্দী। সব মিলিয়ে প্রথম কাব্যগ্রন্থে অধিকাংশ কবিতার গ্রন্থনায় পাঠকের দরবারে এক প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন কবি আশিসরঞ্জন।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘হে ঈশ্বর’
আশিসরঞ্জন নাথ
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮১১০১০৫৪০   

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...