উত্তরপূর্ব তথা বাংলা সাহিত্যের গল্পবিশ্বে
‘অনিশ’ এবং ‘শতক্রতু’ যুগ থেকে শুরু করে আজও যে ক’জন লেখক, গল্পকার
নিরলস ব্রতী রয়েছেন কলম হাতে তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বল একটি নাম মিথিলেশ ভট্টাচার্য।
সম্প্রতি এ বছরের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলনটি। এ নামের
ব্যাখ্যায় গল্পকার লিখছেন “শ্রেষ্ঠ ও সেরা শব্দ দু’টি সমপর্যায়ভুক্ত। তবুও শ্রেষ্ঠ
শব্দটি আমার বেশি পছন্দ। তাই এই সংকলন গ্রন্থের নাম রেখেছি শ্রেষ্ঠ গল্প। ......”
অগণিত গল্প থেকে সেরা গল্পসমূহকে বাছেই করে যদি মানগত বিচারে তালিকাভুক্ত করা যায় তবে প্রথম দিকের গল্পগুলোকেই শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যাদা প্রদান করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ গল্পের এই সংকলনটি পাঠকের দরবারে পরিবেশন করে গল্পকার এ অঞ্চলের পাঠকদের উপহার দিয়েছেন এক অনবদ্য সাহিত্যসুধা।
মিথিলেশের গল্প পাঠককে বেঁধে রাখে গল্পের বুনোট ও প্রাঞ্জল গল্পময়তায়। গল্পের অবয়বের মধ্যে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না বিশাল কোনও ঘটনাপ্রবাহ, পাওয়া যাবে না কোনও ঘটনার ঘনঘটা, চাপান উতোর, বিশাল কোনও চমক কিংবা এক দম বন্ধ করা ক্লাইম্যাক্স। তবু পাঠককে পড়ে শেষ করতেই হবে গল্প। এবং পাঠান্তে পাঠক চিত্তে অবধারিত হয়ে ফুটে উঠবে গল্পের রেশ। সার্থক ছোটগল্পের সংজ্ঞায়িত সমাপ্তির একশো ভাগ নিয়ম মেনে শেষ হওয়া প্রতিটি ছোটগল্পের বিষয় এবং সমস্যার সমাধানকল্পে গল্পকারের দাওয়াই নিয়ে ভাবতে হবে নিরালায় বসে। প্রতিটি অনিয়ম, প্রতিটি সমস্যাকে গল্পের মোড়কে এমন অনায়াসলব্ধ নৈপুণ্যে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয় যেন পাঠক চলেন গল্পের সাথে সাথে আটপৌরে জীবনপথে। কিন্তু পাঠান্তে ভেসে উঠবে গল্পের বিষয়বস্তু এবং মনে হবে কত চেনা সব দৃশ্যপট যেন পুনঃ উন্মোচিত হলো চোখের সামনে।
এ সংকলনের সব ক’টি গল্পই প্রায় উপরোক্ত বিন্যাসে বিন্যস্ত। একজন লেখকের, গল্পকারের যে বিশেষত্ব তা তো ফুটে উঠবেই তাঁর সেরা কিংবা শ্রেষ্ঠ গল্পসমূহে। এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু ‘শ্রেষ্ঠ’ তাই সবগুলো গল্পই বুনোটে, বয়ানে, বিশিষ্টতায়, সংলাপে সমপর্যায়ভুক্ত। তবু প্রতিটি গল্পের মধ্যে যেন মিশে রয়েছে আলাদা রকমের এক স্বকীয়তা যা পাঠকের পঠনসুখকে নিরন্তর বজায় রেখে যায়। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে চলে যেতে উদ্বুদ্ধ করে নিমেষে।
‘চিন্তা’, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ২১৪ পৃষ্ঠার এই ‘চিন্তা গল্প সিরিজ ১০’ এর অন্তর্গত সংকলনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ২৬ টি গল্প। গল্পগুলির প্রকাশকাল বিগত চারটি দশক। বিভিন্ন গল্পের পাঠক্রমে অনুভব করা যায় এই সময়সীমাকে। মূলত বরাক ও শহর শিলচরের প্রেক্ষাপটেই লিখিত অধিকাংশ গল্প। খেটে খাওয়া গরিবগুর্বোদের থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সমাজের টানাপোড়েনে আবদ্ধ চরিত্ররাই প্রাধান্য পেয়েছে গল্পগুলিতে। আটপৌরে চরিত্রদের যে পাহাড়প্রমাণ সমস্যা সেইসব সমস্যার গভীরে প্রোথিত যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তারই কাঁটাছেড়া বিশ্লেষণে প্রোথিত হয়েছে গল্পসমূহের গভীরতা। সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বিদ্বজন অবধি তাই এই গল্পসমূহের সমান গ্রহণযোগ্যতা।
স্বল্প পরিসরে ছাব্বিশটি গল্পের আলাদা আলাদা করে বর্ণনা কিংবা আলোচনা কোনোটিই সম্ভব নয়। অথচ পড়তে পড়তে ইচ্ছে হয় পুরো গল্পটাই তুলে ধরা হোক পাঠকের চোখের সামনে। সংলাপে সংলাপে তরতর করে এগোয় গল্প, গ্রথিত হয় সময়। অথচ কী আশ্চর্যের কথা সময় যেন বদলাতে বদলাতেও থেমে থাকে একই জায়গায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাস্তাঘাটের জীর্ণ দশা, নদীর পথ বদলের কথা, সমাজের অধিকাংশ সমস্যা যেন যুগ পুরানো। একই ধারায় আবর্তিত হচ্ছে দু’কুড়ি বছর সময় ধরে। রূপক আর ব্যাঞ্জনা যেন লেখকের সহজাত দক্ষতা। একাধিক গল্প - যেমন ‘গোপাল যখন বিচারক’, ‘দৌড় ৪০’, ‘জন্মভূমি, পুনশ্চ’, ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’, ‘জগৎ পারাবারের তীরে’, ‘অথ মহাসেন কথা’, ‘প্রণতি বুক স্টল’ ইত্যাদি। ভিন্ন প্রেক্ষাপট, ভিন্ন আঙ্গিক তবু বর্ণনার ঘনঘটায় সবগুলি গল্প সরস এবং সার্থক। ‘একটি অবাস্তব ঘটনার খসড়া চিত্র’ দাঙ্গাবিরোধী একটি অনবদ্য গল্প যেখানে শুধু সমস্যার গভীরেই আলোকপাত করে থেমে থাকেননি গল্পকার, সমাধানের পথও দেখিয়েছেন। এখানেই মিথিলেশের স্বাতন্ত্র্য। যেমন অপরাপর দেশভাগের উপর লিখা গল্পসমূহের দুঃখ, দুর্দশা, কান্নার বিপরীতে সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করতে পারেন গল্পকার মিথিলেশ তাঁর ‘এক যে ছিল...’ গল্পে।
ভাষার চাতুর্যে প্রকৃতি আর ভালোবাসা, দুঃখগাথা আর জড়ের ব্যক্তিকরণের মতো জটিল বিষ্যকে অনবদ্য মুনশিয়ানায় লিপিবদ্ধ করেন লেখক -
“একটি বাড়ির গভীর কালো দীর্ঘ ছায়া যখন অন্য আরেক সিঁদুর মাখানো বাড়িকে পূর্ণগ্রাসে উদ্যত, রক্তে তখন ‘জলকে চল্’ চাঞ্চল্য। কত বৃথা এই চঞ্চলতা ......”
“চূর্ণ আঁধার যখন চিলের ডানার মতো চুপে গভীর নীলকে কালচে সীসাবর্ণ করে দেয়; বুকে তখন তিরবেঁধা পাখির আর্ত আকুলতা...।” (গল্প - সৌরকলঙ্কে তার ছায়া)।
কিংবা - “ঘরের মেঝেতে নেমে অভ্যস্ত পায়ে হেঁটে লীলা দরজার কাছে গিয়ে জীর্ণ পাল্লা দু’টো শব্দ তুলে হাট করে খুলে দেয়। খুলে দিতেই দরজার গায়ে ওৎ পেতে বসা একফালি শাদা জোছনা বেড়ালছানার মতো নধর শরীরে ঘরের উঁচু-নিচু, অসরল মেঝেতে লাফ মারে। ঘরের ভিতরকার দমচাপা জমাট অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়ে আসে তাতে।” (গল্প - ছারপোকা)।
বেশ কিছু গল্পে প্রেম, ভালোবাসার অসাধারণ এক একটি চিত্র অঙ্কিত হয়েছে অসামান্য দক্ষতায় যেখানে হৃদয়ের আকুলতা এবং শরীরী ভাষার সহাবস্থান যেন স্বচ্ছ জলের মতো পরিস্ফুট হয়ে আছে।
‘কেশবলালের ভূমিকা’ গল্পে সামান্য একটি ঘাস কাটার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির অসামান্য বর্ণনা আলাদা করে দাগ কাটে পাঠক মনে। ঠিক তেমনি ‘প্রণতি বুক স্টল’ গল্পে বই পড়ার যুগ শেষে একটি বুক স্টলের বর্ণনাও - “দুপুরবেলার হইচই মুখর, জমজমাট শহরে সকলে কেমন নিজ নিজ পসার সাজিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে, আর প্রণতি বুক স্টল স্তব্ধ বোবা, অসাড় হয়ে পড়ে আছে এক কোণে। মৌচাক ঘিরে মৌমাছির অহর্নিশ ব্যস্ততার মতো পথের দু’পাশে অসম্ভব চঞ্চল এক ব্যস্ততা। কাপড়-জুতোজামা-ওষুধপত্র-মনোহারি জিনিস-ঘড়ি-মোবাইল-সাইবার কাফে-পার্লার-মিষ্টি-ফলপাকুড়-জাঙ্কফুড-শপিংমল-বিগবাজার-হোটেল-রেস্তোঁরা - রমরমা ব্যবসা হাঁকডাক বেচাকেনা - শুধু ক্রেতাহীন হাঁকডাকশূন্য পড়ে আছে ভীষণ একেলা বোবায় ধরা প্রণতি বুক স্টল !...”।
এমনি বিচিত্র ও ব্যতিক্রমী সব ঘটনাপ্রবাহের সাজানো গোছানো বর্ণনাময় বাখান এই ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলন। গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘জীবনের সেরা প্রাপ্তি প্রণতি (রুবি) ভট্টাচার্যের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে’। ছিমছাম শোভন প্রচ্ছদের কৃতিত্ব রাজীব চক্রবর্তীর। অক্ষর, শব্দ, বাক্য বিন্যাস যথাযথ এবং নিখুঁত। সামান্য কিছু বানান/ছাপার ভুলের বাইরে এক কথায় এক পুরস্কারযোগ্য এবং অবশ্যপাঠ্য সার্বিক প্যাকেজ এই গল্প সংকলন।
অগণিত গল্প থেকে সেরা গল্পসমূহকে বাছেই করে যদি মানগত বিচারে তালিকাভুক্ত করা যায় তবে প্রথম দিকের গল্পগুলোকেই শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যাদা প্রদান করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ গল্পের এই সংকলনটি পাঠকের দরবারে পরিবেশন করে গল্পকার এ অঞ্চলের পাঠকদের উপহার দিয়েছেন এক অনবদ্য সাহিত্যসুধা।
মিথিলেশের গল্প পাঠককে বেঁধে রাখে গল্পের বুনোট ও প্রাঞ্জল গল্পময়তায়। গল্পের অবয়বের মধ্যে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না বিশাল কোনও ঘটনাপ্রবাহ, পাওয়া যাবে না কোনও ঘটনার ঘনঘটা, চাপান উতোর, বিশাল কোনও চমক কিংবা এক দম বন্ধ করা ক্লাইম্যাক্স। তবু পাঠককে পড়ে শেষ করতেই হবে গল্প। এবং পাঠান্তে পাঠক চিত্তে অবধারিত হয়ে ফুটে উঠবে গল্পের রেশ। সার্থক ছোটগল্পের সংজ্ঞায়িত সমাপ্তির একশো ভাগ নিয়ম মেনে শেষ হওয়া প্রতিটি ছোটগল্পের বিষয় এবং সমস্যার সমাধানকল্পে গল্পকারের দাওয়াই নিয়ে ভাবতে হবে নিরালায় বসে। প্রতিটি অনিয়ম, প্রতিটি সমস্যাকে গল্পের মোড়কে এমন অনায়াসলব্ধ নৈপুণ্যে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয় যেন পাঠক চলেন গল্পের সাথে সাথে আটপৌরে জীবনপথে। কিন্তু পাঠান্তে ভেসে উঠবে গল্পের বিষয়বস্তু এবং মনে হবে কত চেনা সব দৃশ্যপট যেন পুনঃ উন্মোচিত হলো চোখের সামনে।
এ সংকলনের সব ক’টি গল্পই প্রায় উপরোক্ত বিন্যাসে বিন্যস্ত। একজন লেখকের, গল্পকারের যে বিশেষত্ব তা তো ফুটে উঠবেই তাঁর সেরা কিংবা শ্রেষ্ঠ গল্পসমূহে। এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু ‘শ্রেষ্ঠ’ তাই সবগুলো গল্পই বুনোটে, বয়ানে, বিশিষ্টতায়, সংলাপে সমপর্যায়ভুক্ত। তবু প্রতিটি গল্পের মধ্যে যেন মিশে রয়েছে আলাদা রকমের এক স্বকীয়তা যা পাঠকের পঠনসুখকে নিরন্তর বজায় রেখে যায়। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে চলে যেতে উদ্বুদ্ধ করে নিমেষে।
‘চিন্তা’, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ২১৪ পৃষ্ঠার এই ‘চিন্তা গল্প সিরিজ ১০’ এর অন্তর্গত সংকলনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ২৬ টি গল্প। গল্পগুলির প্রকাশকাল বিগত চারটি দশক। বিভিন্ন গল্পের পাঠক্রমে অনুভব করা যায় এই সময়সীমাকে। মূলত বরাক ও শহর শিলচরের প্রেক্ষাপটেই লিখিত অধিকাংশ গল্প। খেটে খাওয়া গরিবগুর্বোদের থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সমাজের টানাপোড়েনে আবদ্ধ চরিত্ররাই প্রাধান্য পেয়েছে গল্পগুলিতে। আটপৌরে চরিত্রদের যে পাহাড়প্রমাণ সমস্যা সেইসব সমস্যার গভীরে প্রোথিত যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তারই কাঁটাছেড়া বিশ্লেষণে প্রোথিত হয়েছে গল্পসমূহের গভীরতা। সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বিদ্বজন অবধি তাই এই গল্পসমূহের সমান গ্রহণযোগ্যতা।
স্বল্প পরিসরে ছাব্বিশটি গল্পের আলাদা আলাদা করে বর্ণনা কিংবা আলোচনা কোনোটিই সম্ভব নয়। অথচ পড়তে পড়তে ইচ্ছে হয় পুরো গল্পটাই তুলে ধরা হোক পাঠকের চোখের সামনে। সংলাপে সংলাপে তরতর করে এগোয় গল্প, গ্রথিত হয় সময়। অথচ কী আশ্চর্যের কথা সময় যেন বদলাতে বদলাতেও থেমে থাকে একই জায়গায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাস্তাঘাটের জীর্ণ দশা, নদীর পথ বদলের কথা, সমাজের অধিকাংশ সমস্যা যেন যুগ পুরানো। একই ধারায় আবর্তিত হচ্ছে দু’কুড়ি বছর সময় ধরে। রূপক আর ব্যাঞ্জনা যেন লেখকের সহজাত দক্ষতা। একাধিক গল্প - যেমন ‘গোপাল যখন বিচারক’, ‘দৌড় ৪০’, ‘জন্মভূমি, পুনশ্চ’, ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’, ‘জগৎ পারাবারের তীরে’, ‘অথ মহাসেন কথা’, ‘প্রণতি বুক স্টল’ ইত্যাদি। ভিন্ন প্রেক্ষাপট, ভিন্ন আঙ্গিক তবু বর্ণনার ঘনঘটায় সবগুলি গল্প সরস এবং সার্থক। ‘একটি অবাস্তব ঘটনার খসড়া চিত্র’ দাঙ্গাবিরোধী একটি অনবদ্য গল্প যেখানে শুধু সমস্যার গভীরেই আলোকপাত করে থেমে থাকেননি গল্পকার, সমাধানের পথও দেখিয়েছেন। এখানেই মিথিলেশের স্বাতন্ত্র্য। যেমন অপরাপর দেশভাগের উপর লিখা গল্পসমূহের দুঃখ, দুর্দশা, কান্নার বিপরীতে সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করতে পারেন গল্পকার মিথিলেশ তাঁর ‘এক যে ছিল...’ গল্পে।
ভাষার চাতুর্যে প্রকৃতি আর ভালোবাসা, দুঃখগাথা আর জড়ের ব্যক্তিকরণের মতো জটিল বিষ্যকে অনবদ্য মুনশিয়ানায় লিপিবদ্ধ করেন লেখক -
“একটি বাড়ির গভীর কালো দীর্ঘ ছায়া যখন অন্য আরেক সিঁদুর মাখানো বাড়িকে পূর্ণগ্রাসে উদ্যত, রক্তে তখন ‘জলকে চল্’ চাঞ্চল্য। কত বৃথা এই চঞ্চলতা ......”
“চূর্ণ আঁধার যখন চিলের ডানার মতো চুপে গভীর নীলকে কালচে সীসাবর্ণ করে দেয়; বুকে তখন তিরবেঁধা পাখির আর্ত আকুলতা...।” (গল্প - সৌরকলঙ্কে তার ছায়া)।
কিংবা - “ঘরের মেঝেতে নেমে অভ্যস্ত পায়ে হেঁটে লীলা দরজার কাছে গিয়ে জীর্ণ পাল্লা দু’টো শব্দ তুলে হাট করে খুলে দেয়। খুলে দিতেই দরজার গায়ে ওৎ পেতে বসা একফালি শাদা জোছনা বেড়ালছানার মতো নধর শরীরে ঘরের উঁচু-নিচু, অসরল মেঝেতে লাফ মারে। ঘরের ভিতরকার দমচাপা জমাট অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়ে আসে তাতে।” (গল্প - ছারপোকা)।
বেশ কিছু গল্পে প্রেম, ভালোবাসার অসাধারণ এক একটি চিত্র অঙ্কিত হয়েছে অসামান্য দক্ষতায় যেখানে হৃদয়ের আকুলতা এবং শরীরী ভাষার সহাবস্থান যেন স্বচ্ছ জলের মতো পরিস্ফুট হয়ে আছে।
‘কেশবলালের ভূমিকা’ গল্পে সামান্য একটি ঘাস কাটার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির অসামান্য বর্ণনা আলাদা করে দাগ কাটে পাঠক মনে। ঠিক তেমনি ‘প্রণতি বুক স্টল’ গল্পে বই পড়ার যুগ শেষে একটি বুক স্টলের বর্ণনাও - “দুপুরবেলার হইচই মুখর, জমজমাট শহরে সকলে কেমন নিজ নিজ পসার সাজিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে, আর প্রণতি বুক স্টল স্তব্ধ বোবা, অসাড় হয়ে পড়ে আছে এক কোণে। মৌচাক ঘিরে মৌমাছির অহর্নিশ ব্যস্ততার মতো পথের দু’পাশে অসম্ভব চঞ্চল এক ব্যস্ততা। কাপড়-জুতোজামা-ওষুধপত্র-মনোহারি জিনিস-ঘড়ি-মোবাইল-সাইবার কাফে-পার্লার-মিষ্টি-ফলপাকুড়-জাঙ্কফুড-শপিংমল-বিগবাজার-হোটেল-রেস্তোঁরা - রমরমা ব্যবসা হাঁকডাক বেচাকেনা - শুধু ক্রেতাহীন হাঁকডাকশূন্য পড়ে আছে ভীষণ একেলা বোবায় ধরা প্রণতি বুক স্টল !...”।
এমনি বিচিত্র ও ব্যতিক্রমী সব ঘটনাপ্রবাহের সাজানো গোছানো বর্ণনাময় বাখান এই ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলন। গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘জীবনের সেরা প্রাপ্তি প্রণতি (রুবি) ভট্টাচার্যের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে’। ছিমছাম শোভন প্রচ্ছদের কৃতিত্ব রাজীব চক্রবর্তীর। অক্ষর, শব্দ, বাক্য বিন্যাস যথাযথ এবং নিখুঁত। সামান্য কিছু বানান/ছাপার ভুলের বাইরে এক কথায় এক পুরস্কারযোগ্য এবং অবশ্যপাঠ্য সার্বিক প্যাকেজ এই গল্প সংকলন।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
‘শ্রেষ্ঠ গল্প’
মিথিলেশ ভট্টাচার্য
মূল্য - ৪০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৫৯৯৫১২৩৩
মিথিলেশ ভট্টাচার্য
মূল্য - ৪০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৫৯৯৫১২৩৩
গল্পকার শ্রী মিথিলেশ ভট্টাচার্যর সঙ্গে আমার পরিচয় আজকের নয়, ত্রিশ বছরেরও বেশি,
ReplyDeleteপ্রথম দেখা হয় ' ঈশান ' পত্রিকা আয়োজিত
সাহিত্য বাসরে, স্থানটা ছিল বদরপুর
' অন্বেষক ' সংস্থার নিজস্ব সভাঘর । সেই থেকে এই পরিচয় কখন যে প্রীতিতে রূপ নেয় -
আজ মনে হয় নিছক সংযোগ নয় হয়তো তা ছিলো কোনো এক অতিমানস অভিপ্রায় ।
গত তিন বছর ধরে খুবই অসুস্থ ছিলাম আমি, লেখার সঙ্গে কোনো সংশ্রবই ছিলো না তখন, আমার কোনো মানসিক শক্তিই ছিলো না । করোনার প্রথম আতিমারীর বছরটার পর, তিনি একদিন আমাকে দেখতে আসেন, তারপর তা এক দীর্ঘ পরিক্রমা, তিনি আমার বাড়ীতে আসতেন দেখাসাক্ষাৎ হতো, তাছাড়াও ফোনে যোগাযোগ ছিল বেশী, দিনে যে কতোবার ফোন করতেন, তার ঠিক নেই, একটু একটু করে আমাকে এক দুরূহ প্রচেষ্টায় আবার লেখার জগতে ফিরিয়ে আনলেন , করিয়ে দিলেন চিন্তা প্রকাশনার সঙ্গে যোগাযোগ - ঐ সময়ই উনার শ্রেষ্ঠ গল্প প্রকাশিত হয় চিন্তা প্রকাশনা থেকে ।
তিনি এক বিরাট মাপের সাহিত্যিক অবশ্যই কিন্তু
মানুষ হিসাবে তিনি খুব সহজ সরল প্রকৃতিপ্রেমী
আর আমার কাছে তিনি বন্ধু, দাদা, আমার ফিলোসফার এবং গাইড ।
উনার শ্রেষ্ঠ গল্প সম্বন্ধে শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্তির আলোচনার পর আর কিছু বলার থাকেনা। সুধী পাঠক অবশ্যই উনার গল্পের স্বাদ নেবেন, আমি শুধু মানুষ মিথিলেশ সম্বন্ধে কিছু না বলে পারলাম না, তাছাড়া আমার অসুস্থ অবস্থায় আর মানসিক ভেঙ্গেপরার সময় যে ভাবে পাশে দাড়িয়েছেন, আমাকে আবার কিছু লিখতে প্রেরণা দিয়েছেন, তার জন্য আমি অবশ্যই ঋণী ।
---- অমিতাভ সেনগুপ্ত
সম্পাদক, ঈশান
ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য। সুস্থ থাকুন, সৃষ্টিতে থাকুন।
Delete...... বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
আমিও বইটি নিলাম,পড়বো। সুন্দর আলোচনা।
ReplyDelete