Skip to main content

মুক্তগদ্যের জাদুকরি সংকলন - ‘মনোকক্ষের জানালায়’


পৃথিবীতে সবচাইতে দ্রুতগামী নাকি মানুষের মন। চিন্তা করলে দেখা যায় কথাটি ষোলো আনা সত্য। নিরাকার মন চোখের পলকে ঘুরে আসতে পারে এ বিশ্ব। মানুষের মন মগজ জুড়ে রয়েছে চিন্তা নামক এক বিশাল জগৎ। এই জগতের তল খুঁজে পাওয়া নিতান্তই অসাধ্য। প্রতিটি মানুষের চিন্তায় স্তরে স্তরে জমা হয়ে থাকে ঘটনা পরম্পরার মহাসাগরসম অস্তিত্ব। এই মনের হদিশ পাওয়া মোটেই সহজ নয়। এই চিন্তা ভাবনার জগৎকেই বলে মনোজগৎ। মন, মানসিকতা, মনোভাব, মনস্তত্ত্ব - এসব কিছুই এই মনকে নিয়ে। প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েডের মতে মানুষের মন প্রচণ্ড ভাবে গতিশীল। এবং এই ‘মন’ নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্রবৃত্তির তাড়না, বিরোধ, অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অবস্থান করি বিভিন্ন বিরোধ আর বাধাকে গ্রাহ্য করে এবং এর ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ স্বাধীন নই। আমাদের চিন্তারও নেই কোনো স্বতঃস্ফুর্ত প্রবাহ। ফ্রয়েডের মতে মনের চেতন ও অবচেতন স্তরের সমন্বয়ে তৈরি হয় মানুষের অহং। অর্থাৎ মনের ভাবধারা প্রকৃত রূপে বিশ্লেষণ করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং নিরেট গদ্যের বিষয় যদি মন ও মানসিকতা হয় তবে তার অন্ত মেলা দুষ্কর।
কবি, গদ্যকার অভীক কুমার দে লিখেছেন মন নিয়ে। খুলে দিতে চেয়েছেন তাঁর মন-জানালা। তাঁর মনোকক্ষে সঞ্চিত এবং চর্চিত মনালাপ নিয়ে লিখেছেন একগুচ্ছ মুক্ত গদ্য - তাঁর ‘মনোকক্ষের জানালায়’ নামক গ্রন্থে। গ্রন্থের অধিকাংশ লেখাই মানুষ, মানুষের চরিত্র, মানুষের মন এবং মনের মানুষ নিয়ে লিখা। দেখা যাক এই মনোকক্ষের বাতায়ন পেরিয়ে কবিমনে কী ভাবনার সৃষ্টি করে চলেছেন গদ্যকার অভীক। গ্রন্থপাঠে যাওয়ার আগেই দেখা যাক ব্লার্বে কী উঠে এসেছে -
‘মনের উঠোনে বিচরণ করতে মনোচক্ষুর উন্মীলন প্রয়োজন। অন্যথা মনোজগতের হদিশ পাওয়া কঠিন। যিনি মনের ভিন্ন কক্ষে ভিন্ন দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন এবং হাঁটতে পারেন অনায়াসে, উনার যাপন থেকে উঠে আসে জীবনবোধ। ......’।
প্রথম পরিচ্ছদের শুরুটা দেখা যাক এবার -
চরিত্র একটি রহস্যময় অনুভব। যিনি চরিত্রের ভালো খারাপ ফল ঘোষণা দেবার জন্য সার্টিফিকেট দেবার জন্য দাঁত দেখিয়ে হাসেন, তাকেই প্রথমত সংযমী হতে হয় নেশামুক্ত ডাক্তারের মতো।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বা দৃষ্টিনন্দন অবয়বের উপর চরিত্র গঠন বা লালিত হয় না। অভ্যন্তরীণ জিহ্বার স্বাদ কোডের উপর তৈরি হয় মানসিক জগৎ। প্রতিটি মানুষের মানসিক জগৎ আলাদা। সবার ভেতর পরিবেশ সমান নয়। সবার সামাজিক অবস্থান সমান হয় না বলে, ভেতর পরিবেশের সবুজায়ন সমান হয় না। প্রতিটি মানুষ অন্যকে নিজের পরিবেশের কাঠগড়ায় রেখে ব্যাখ্যা ও পরিবেশন করে। এমন চারত্রিক বিশ্লেষণের কোনো অনুশাসন নেই বলে সব মানুষ কিছু না কিছু মানসিক প্রতিবন্ধী ……।’ - কোথাও যেন ভেসে আসে সেই ফ্রয়েডিয় সূত্র।
অর্থাৎ গদ্যকার এখানে স্পষ্ট এবং চাঁচাছোলা বয়ানে ব্রতী হয়েছেন মনোগদ্যের সৃষ্টিতে। পরিবেশের অধ্যয়নসঞ্জাত বিশ্লেষণে তিনি স্পষ্টবাক। এবং গ্রন্থের আদ্যোপান্ত বয়ান একই সুরে বাঁধা। মনোজগতে ছায়া মেলেছে অতিমারির বিভীষিকাও। তবু এই বাস্তব বোধের মনস্তত্ত্বকে সামলেও ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে মানুষ নিজেই আত্মবিস্মৃত। তাই গদ্যকারও এর বাইরে দাঁড়িয়ে নেই। এদিকেও তাঁর প্রখর দৃষ্টি। তাই লিখছেন - ‘আমরা যতই বলি, আমরা নিজেকে ভাঙতে থাকি, বুঝতে পারি, বিশ্লেষণ করতে পারি, এই সবই অনুমানসমৃদ্ধ। আমরা মৃত্যু পর্যন্ত নিজেকেই বুঝতে পারি না। অন্যের চরিত্র উপলব্ধি বা বর্ণনা, তা আকাশ থেকে তারা পেড়ে আনার মতো। এক জীবনে ব্যক্তি মানুষ নিজেকে জানতে চিনতে পারবেন হয়তো (যেমনটা মুবিঋষিরা দাবি করেন), আমি আপনি বা এই জাতীয় মানুষ পারে না কারণ, আমরা অন্যকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে ভুলে যাই। এভাবেই সারাজীবন। পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই যে নিজের কাছে সঠিক নয়। প্রতিটি মানুষ যদি নিজের জানালা খুলে রোদ ঢুকতে দিত, তাহলে ভেতরের ময়লা দেখলে নিজেই আঁতকে উঠতো। …’।
প্রতিটি অধ্যায়ের এই গদ্যময় কাব্যিক বয়ানের বর্ণনায় গদ্যকার এক অপূর্ব ভাষা-ব্যঞ্জনার প্রয়োগ করেছেন যা সাধারণ্যের অধ্যয়নে ভিন্নধর্মী। শব্দসমূহের এক বিচিত্র প্রতিস্থাপন অনুভব করা যায় তাঁর লেখনীতে। উপযুক্ত স্থানে যথাযোগ্য শব্দের প্রতিস্থাপন হয়তো সব ক্ষেত্রে সঠিক মনে নাও হতে পারে কিন্তু বৈচিত্রের ক্ষেত্রে অসাধারণ এক দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন কবিমননে সমৃদ্ধ এই গল্পকার। তাই তাঁর বয়ানে উঠে আসে বৈচিত্রে ভরপুর কিছু অনাস্বাদিত কথামালা -
‘প্রতিটি মানুষের মনের উঠোনে গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধা ফোটে না। একলা একা মানুষের উঠোনেও তেমন ফুল ফোটে। এমনও হতে পারে, হয়তো কোনো দামি ফুল নয়, হতে পারে ঘাসফুল, তবুও চারপাশ জড়িয়ে সেই ছোটো ফুলগুলো, মৃদু রং ছড়ায়। সেই মৃদু রং কোনো একা মানুষের জীবনমুখী সুর খুঁজে নিতে পারে……’।
‘প্রতিটি বুকের ভেতরে একেকটা পৃথিবী। নিজ কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে যার যার মতো কী যেন খুঁজতে থাকে। অফুরন্ত শূন্যতায় ঘিরে বুকের বাতাস লুকিয়ে কত আর খোঁজ করা যায় ? জড়তার মাঝে প্রাণের অজানা রহস্য ভেদ কতে তেমন কি কিছু পাওয়ার থাকে ? স্বপ্নের মতোই ঘুমঘোরের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দের বিকারগ্রস্ত আবহ কেটে গেলে সত্য মিথ্যার ঘেরাটোপ দর্শনের পরেও মনোদর্পণে আলো পড়ে কই ? …’।
মাত্র ৩৫ পৃষ্ঠার এই গদ্যসম্ভারের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নান্দনিক এক বিন্যাস যা নতুন করে ভাবতে শেখায় জীবনবোধকে। আগরতলার নীহারিকা পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের স্পষ্ট ছাপাই ও পাকা বাঁধাইয়ের দুই মলাটের ভেতর যেন লুকিয়ে আছে জীবনধারার এক প্রতিস্রোত। অনিমেষ মাহাতোর প্রচ্ছদ এবং প্রচ্ছদের রং প্রাসঙ্গিক যদিও নামলিপির রঙের ব্যবহার যথাযথ হয়নি, স্পষ্টতার অভাব। কিছু বেয়াড়া বানান ভুল নান্দনিক পাঠে ক্ষণিক ব্যাঘাত ঘটায় - যদিও সংখ্যায় তা খুবই কম। গদ্যকার অভীক তাঁর এই ভূমিকাহীন গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন - ‘লেখক ও প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য’কে।
শেষ কথায় এই মুক্তগদ্যের জাদুকর নিজেকে তুলে ধরেছেন অপূর্ব মায়াময়তায়। শেষ পরিচ্ছদটি গ্রন্থের সামগ্রিক উদ্দেশ্য ব্যাখ্যার জন্য যথোপযুক্ত হবে বলেই মনে হয় - ‘উদয়াচল রঙিন হলেও অন্তিম আলোয় চোখে পড়ে বেশি। বেলা শেষের গায়ে রঙিন তুলোমেঘের আঁচল। পাখিটিকে আঁচলে ডুবে যেতে দেখে, আকাশকে ক্যানভাস মনে হয়। নিম্ন গতি ছায়া জড়িয়ে কাঁদে। মোহনা জল জানে, নিম্নগতি আর শেষের বেলা অজস্র জোয়ারের মুখোমুখি। চরের গায়ে ঢেউগুলো স্তর আঁকছে অনবরত। শক্ত হাড়ের মতো স্তরে স্তরে জমছে শিলা। সব অমিল স্তর, লিখে রাখে - এক নদী জীবনে অসংখ্য অভীক থাকে, কিন্তু অভীকের একটাই জীবন। নদীর সমভূমি। ভেজা বুক ভেজা রাখে মুহুরী গাঙ।’

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘মনোকক্ষের জানালায়’
অভীককুমার দে
মূল্য - ১৪০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৬২২৩৯৬১৬

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...