ভূমিকায় আছে - ‘স্বাচ্ছন্দ্য ও
নিমগ্নতার কবি প্রাণজি বসাকের এ যাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সম্ভবত দুই
ডজন। একের পর এক কাব্যগ্রন্থে কবি নিজেকে উদ্ভাসিত করে চলেছেন নতুন থেকে নতুনতর
আঙ্গিকে। প্রথমেই যে কথাটি বলে নেয়া আবশ্যক তা হল কবির গ্রন্থনাম। শব্দচমকে ও
দ্যোতনায় সুচয়িত গ্রন্থনাম সহজেই আকর্ষণ করে নেয় পাঠকের প্রথম ইন্দ্রিয়। এবং এটাও
এক অমোঘ সত্য যে পাঠক একবার গ্রন্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে আদ্যন্ত পাঠের বাইরে
আর গত্যন্তর থাকে না বেরিয়ে আসার। এ এক আশ্চর্য ব্যূহ বইকী।’
‘সব ছাই কেন ওড়ে শীত মাসে’ শীর্ষক এই গ্রন্থেও ধরা আছে গ্রন্থনামের সেই বাহাদুরি। এখানে তিনি আবারও মেতে উঠেছেন আঙ্গিকের নতুনত্বে। দুটি দীর্ঘ কবিতা সহ সবগুলো কবিতাই এবার গদ্যকবিতা। আপাতমননে গদ্যকবিতা শব্দবন্ধটি চেতনাগত বোধে ‘সোনার পাথরবাটি’ গোছের এক ভাবনার জন্ম দেয় যদিও গদ্যকবিতার আছে এক ভিন্নধর্মী প্রকাশ। ছন্দহীন কবিতা কিংবা আধুনিক বা অত্যাধুনিক কবিতার পথে নয়, গদ্যকবিতার ভেতরে প্রকৃতার্থে লুকিয়ে রয়েছে এমন এক আঙ্গিক যা মূলত গদ্যনির্ভর এবং গদ্যসঞ্জাত কিন্তু অনর্নিহিতে বয়ে যায় পদ্য বা কাব্যগুণ সম্বলিত এক চোরা ছন্দলালিত্য। রবীন্দ্রনাথ পদ্য-ছন্দকে ভেঙে গদ্য বা গদ্যকবিতার সৃষ্টি করতে চাননি! তাঁর গদ্যই রূপান্তরিত হয়েছে গদ্যকবিতায় বা পদ্যে।
প্রাণজির কবিতায় যখন দেখতে পাই - ‘সব কিছু কেন যেন জলে ভেসে গেছে, সব কথা কেন মনে মনে ভাসে, সব ছায়া কেন যেন পোড়ে আজ বুকে। সব ছাই কেন যেন ওড়ে শীত মাসে।’ কিংবা ‘যাকেই ডেকে শোনাই ছাই আর মাটির কাহিনি, বলে - সেটা বড় কথা নয়, সেটা বড় কথা নয়। জীবন শ্মশানমাঠ আগুন ফিরে ফিরে আসে। আমাদের ফেরা আর চলে যাওয়া যুগপৎ কিনা হাওয়া কান পাতে মাঝখানে, সেটা বড় কথা নয়......।’ - তখনই মনে হয় কবিতার নির্যাসে প্রাণজি গদ্যকে এমনই প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছেন প্রথা মেনে, পাঠক-মনন মেনে, সাফল্যের দায় মেনে। শব্দপ্রয়োগেও যথারীতি ধরে রাখতে পেরেছেন তাঁর বিশেষত্ব। ইংরেজি, হিন্দি, স্থানিক শব্দকে ব্যবহার করেছেন যথার্থ চারু ও কারুময়তায়। সামগ্রিক ভাবে এক আপন জীবনবোধের কথাই ব্যক্ত করেছেন কবি তাঁর কবিতায় - দেশত্যাগ, দেশভাবনা, স্মৃতি, গরজ ও প্রত্যয়ের এক সুষম সুষমায়।
৬৪ পৃষ্ঠার আলোচ্য গ্রন্থে আছে মোট ৫২ টি কবিতা। দুই বা তিন বা ততোধিক প্যারাগ্রাফে সুললিত গদ্যে লেখা কবিতাগুলি যেন অজান্তেই প্রবেশ করে পাঠক মননে, তার আপন বৈভবে, শব্দে, বর্ণে, সৌরভে। শব্দের কারুকার্যময় বন্ধনে জেগে ওঠে কবিতা -
‘সূর্যের কাছে আজ খুলে রেখেছ বল্কল মুকুট পরিধেয় বেবাক। আজ যৌথ পরব মন্দিরে মন্দিরে বাজে কাঁসরঘণ্টা অবিরাম। প্রতিমার কী যায় আসে কোন ঘাটে বিসির্জন ? ডুবে যায় অপঠিত কাহিনি, গুলে যায় আলপনা, হাসিমুখে সূর্যোদয়ের মানচিত্র ভাসে, মাঠে মাঠে বোঝাই ভূগোলের ইতিহাস। পাড়াতুতো নদীটিকে একজন ছাড়া সবাই পাগল ভাবে।
এভাবেই পঞ্চায়েত চলে দিনরাত রাতদিন। সূর্যাস্ত এলে ভিন্ন মানচিত্র খোলে গোপনে। কেউ কেউ বেশ চুপচাপ থাকে সকালসন্ধে, কেউ ঘুরপাক খায় নাই-কথায় আসে যায়। শিরীষের হাওয়া আসে, সারা দেহে লাগে চমক। পত্রপুস্পে জাগে শিহরণ এই বুঝি এখন খেলা হবে। কেন তবু খেলে যায় মায়া কুয়াশার পরতে পরতে, বল্কল মুকুট পরিধেয় খুলেছ আজ নিজের কাছ নিজেই।’ (কবিতা - প্রশ্ন শেষে)।
শেষ দুটি দীর্ঘ কবিতা - ‘কে কবে মুছে দেয় অঙ্ক’ ও ‘একটা শহর ডুবে যাচ্ছে’। এখানে গদ্যছন্দের সেই একই সুষমা যদিও কবিতার অবয়ব এখানে তন্বী সুষমামণ্ডিত - যতিচিহ্নবিহীন। সব মিলিয়ে সার্বিক এক পরীক্ষা নিরীক্ষার খেলা গ্রন্থ জুড়ে, কবিতা জুড়ে।
অক্ষর পাবলিকেশন, ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন কবি সন্তোষ রায়কে। পুস্পল দেব-এর প্রচ্ছদ যথারীতি প্রাসঙ্গিক, নান্দনিক। ছাপা, বাঁধাই উৎকৃষ্ট মানের হলেও ‘অক্ষর’ থেকে প্রকাশিত সব বইয়েরই মতো এখানেও যুক্তাক্ষরগুলোর বন্ধনমুক্ত ব্যবহার সহজ পঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ স্বরূপ - কৃষ্ণ বানানের ণ যদি ষ-এর পাশে না বসে নীচে বসে থাকে তাহলে বানানটি বুঝে উঠতেও খানিক হোঁচট খেতে হয় বইকী। এমনই সব যুক্তাক্ষর। নিরেট শুদ্ধ বানান গ্রন্থটির অন্যতম সম্পদ। সব মিলিয়ে ভিন্নতর আঙ্গিকে এক নান্দনিক পাঠের ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ ‘সব ছাই কেন ওড়ে শীত মাসে’।
‘সব ছাই কেন ওড়ে শীত মাসে’ শীর্ষক এই গ্রন্থেও ধরা আছে গ্রন্থনামের সেই বাহাদুরি। এখানে তিনি আবারও মেতে উঠেছেন আঙ্গিকের নতুনত্বে। দুটি দীর্ঘ কবিতা সহ সবগুলো কবিতাই এবার গদ্যকবিতা। আপাতমননে গদ্যকবিতা শব্দবন্ধটি চেতনাগত বোধে ‘সোনার পাথরবাটি’ গোছের এক ভাবনার জন্ম দেয় যদিও গদ্যকবিতার আছে এক ভিন্নধর্মী প্রকাশ। ছন্দহীন কবিতা কিংবা আধুনিক বা অত্যাধুনিক কবিতার পথে নয়, গদ্যকবিতার ভেতরে প্রকৃতার্থে লুকিয়ে রয়েছে এমন এক আঙ্গিক যা মূলত গদ্যনির্ভর এবং গদ্যসঞ্জাত কিন্তু অনর্নিহিতে বয়ে যায় পদ্য বা কাব্যগুণ সম্বলিত এক চোরা ছন্দলালিত্য। রবীন্দ্রনাথ পদ্য-ছন্দকে ভেঙে গদ্য বা গদ্যকবিতার সৃষ্টি করতে চাননি! তাঁর গদ্যই রূপান্তরিত হয়েছে গদ্যকবিতায় বা পদ্যে।
প্রাণজির কবিতায় যখন দেখতে পাই - ‘সব কিছু কেন যেন জলে ভেসে গেছে, সব কথা কেন মনে মনে ভাসে, সব ছায়া কেন যেন পোড়ে আজ বুকে। সব ছাই কেন যেন ওড়ে শীত মাসে।’ কিংবা ‘যাকেই ডেকে শোনাই ছাই আর মাটির কাহিনি, বলে - সেটা বড় কথা নয়, সেটা বড় কথা নয়। জীবন শ্মশানমাঠ আগুন ফিরে ফিরে আসে। আমাদের ফেরা আর চলে যাওয়া যুগপৎ কিনা হাওয়া কান পাতে মাঝখানে, সেটা বড় কথা নয়......।’ - তখনই মনে হয় কবিতার নির্যাসে প্রাণজি গদ্যকে এমনই প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছেন প্রথা মেনে, পাঠক-মনন মেনে, সাফল্যের দায় মেনে। শব্দপ্রয়োগেও যথারীতি ধরে রাখতে পেরেছেন তাঁর বিশেষত্ব। ইংরেজি, হিন্দি, স্থানিক শব্দকে ব্যবহার করেছেন যথার্থ চারু ও কারুময়তায়। সামগ্রিক ভাবে এক আপন জীবনবোধের কথাই ব্যক্ত করেছেন কবি তাঁর কবিতায় - দেশত্যাগ, দেশভাবনা, স্মৃতি, গরজ ও প্রত্যয়ের এক সুষম সুষমায়।
৬৪ পৃষ্ঠার আলোচ্য গ্রন্থে আছে মোট ৫২ টি কবিতা। দুই বা তিন বা ততোধিক প্যারাগ্রাফে সুললিত গদ্যে লেখা কবিতাগুলি যেন অজান্তেই প্রবেশ করে পাঠক মননে, তার আপন বৈভবে, শব্দে, বর্ণে, সৌরভে। শব্দের কারুকার্যময় বন্ধনে জেগে ওঠে কবিতা -
‘সূর্যের কাছে আজ খুলে রেখেছ বল্কল মুকুট পরিধেয় বেবাক। আজ যৌথ পরব মন্দিরে মন্দিরে বাজে কাঁসরঘণ্টা অবিরাম। প্রতিমার কী যায় আসে কোন ঘাটে বিসির্জন ? ডুবে যায় অপঠিত কাহিনি, গুলে যায় আলপনা, হাসিমুখে সূর্যোদয়ের মানচিত্র ভাসে, মাঠে মাঠে বোঝাই ভূগোলের ইতিহাস। পাড়াতুতো নদীটিকে একজন ছাড়া সবাই পাগল ভাবে।
এভাবেই পঞ্চায়েত চলে দিনরাত রাতদিন। সূর্যাস্ত এলে ভিন্ন মানচিত্র খোলে গোপনে। কেউ কেউ বেশ চুপচাপ থাকে সকালসন্ধে, কেউ ঘুরপাক খায় নাই-কথায় আসে যায়। শিরীষের হাওয়া আসে, সারা দেহে লাগে চমক। পত্রপুস্পে জাগে শিহরণ এই বুঝি এখন খেলা হবে। কেন তবু খেলে যায় মায়া কুয়াশার পরতে পরতে, বল্কল মুকুট পরিধেয় খুলেছ আজ নিজের কাছ নিজেই।’ (কবিতা - প্রশ্ন শেষে)।
শেষ দুটি দীর্ঘ কবিতা - ‘কে কবে মুছে দেয় অঙ্ক’ ও ‘একটা শহর ডুবে যাচ্ছে’। এখানে গদ্যছন্দের সেই একই সুষমা যদিও কবিতার অবয়ব এখানে তন্বী সুষমামণ্ডিত - যতিচিহ্নবিহীন। সব মিলিয়ে সার্বিক এক পরীক্ষা নিরীক্ষার খেলা গ্রন্থ জুড়ে, কবিতা জুড়ে।
অক্ষর পাবলিকেশন, ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন কবি সন্তোষ রায়কে। পুস্পল দেব-এর প্রচ্ছদ যথারীতি প্রাসঙ্গিক, নান্দনিক। ছাপা, বাঁধাই উৎকৃষ্ট মানের হলেও ‘অক্ষর’ থেকে প্রকাশিত সব বইয়েরই মতো এখানেও যুক্তাক্ষরগুলোর বন্ধনমুক্ত ব্যবহার সহজ পঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ স্বরূপ - কৃষ্ণ বানানের ণ যদি ষ-এর পাশে না বসে নীচে বসে থাকে তাহলে বানানটি বুঝে উঠতেও খানিক হোঁচট খেতে হয় বইকী। এমনই সব যুক্তাক্ষর। নিরেট শুদ্ধ বানান গ্রন্থটির অন্যতম সম্পদ। সব মিলিয়ে ভিন্নতর আঙ্গিকে এক নান্দনিক পাঠের ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ ‘সব ছাই কেন ওড়ে শীত মাসে’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য
- ১৭৫ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৬১২১১০৯
যোগাযোগ - ৯৪৩৬১২১১০৯
Comments
Post a Comment