Skip to main content

আত্মখননে উঠে আসা রত্নরাজিতে ‘বিকশিত’ কাব্যগ্রন্থ ‘আত্মজীবনীর পরাবাস্তব’


প্রকৃত সত্য নাকি কেবল অবচেতনেই বিরাজ করে। সুরারিয়েলিজম বা পরাবাস্তববাদ সেই অবচেতনেরই শিল্পরূপ। সেই অর্থে বাস্তব কথনের উপর এক আপাত, আবছা কল্পনার চাদর জড়িয়ে থাকলেও আসলে এই আবছা আচ্ছাদনই প্রকৃত সত্যের এক অনির্বচনীয় শিল্পরূপ।
কবি বিকাশ সরকার যতটা কবি ততটাই গদ্যকার। বলা ভালো গদ্যশিল্পী। কিংবা হয়তো তাঁর গদ্য-শিল্প ছাড়িয়ে যেতে পারে কাব্যগুণকে। এটাও অস্বীকার্য নয়। এই মূল্যায়ন বড় সহজ কথা নয় যদিও আমরা নিজেদের মতো করেই একটা প্রোটোটাইপ তৈরি করে ফেলি কবি-লেখকদের নিয়ে। সেই সূত্রে কবি বিকাশ সরকারই বেশি পরিচিত। উত্তরপূর্বের কবিতা বিশ্বে এক ভিন্ন ঘরানার কবি বিকাশ। এখানে আর কোনও দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। হ্যাঁ বিকাশ একশো শতাংশই উত্তরপূর্বের কবি যদিও কেউ কেউ এমন সীমায়নের পক্ষে নন। তবু বলা যায় ঈশান বাংলার বাইরে সর্বাধিক পরিচিত ও প্রকাশিত কবি বিকাশ। তাঁর কবিতার ধাঁচ, শব্দের প্রয়োগ, কাব্য-সাবলীলতা অতুলনীয় ও অনতিক্রম্য।
আর এমন প্রতিভাবান কবি যদি পরাবাস্তবভিত্তিক কবিতা লিখেন সেই কবিতার কাব্যসুধা পাঠকের অন্তঃকরণে কেমন লহর তুলবে তা না বললেও চলে। ‘আত্মজীবনীর পরাবাস্তব’ বিকাশ সরকারের ‘বহুর মধ্যে একটি’ কাব্যগ্রন্থ। ৬৪ পৃষ্ঠার পাকা বাঁধাই এই গ্রন্থে রয়েছে ৩৬টি কবিতা। প্রথম কবিতা ‘দুর্গা লোহার’। চার পৃষ্ঠা জুড়ে চারটি পর্বে লেখা এই আস্ত কবিতাটিই যেন এক পরাবাস্তব মূর্তির গায়ে এক বাস্তবের চাদর হয়ে ধরা দিয়েছে পাঠক-মননে। এই যে শুরু তার শেষ কোথায় ? শেষ হয়েছে গ্রন্থনাম শীর্ষক শেষ কবিতায়। পরাবাস্তব কাঠামো যেন উৎকর্ষের শেষ সীমা ছুঁয়েছে এখানে এসে। দুর্গা লোহার দর্শন থেকে শুরু করে আত্মজীবনীতে এসে কবি বিকাশ আকাশ ছুঁয়েছেন উৎকর্ষের। প্রতিটি কবিতার প্রতিটি চরণ, স্তবক, পঙ্‌ক্তি জুড়ে লুকিয়ে আছে শুধুই এক ঘোর লাগা বিস্ময়, এক বিন্যস্ত ছন্দ। অন্ত্যমিলে সততই অপ্রতিরোধ্য বিকাশ। এ অন্ত্যমিল শুধুই আক্ষরিক অন্ত্যমিল নয়। অঙ্ক কষা, নিক্তি ধরা ছন্দের অনুপস্থিতিতেও স্বচ্ছন্দ, স্বতঃপ্রণোদিত সুললিত এক অন্ত্যমিল যা কবি বিকাশকে নিয়ে গেছে স্বকীয়তার পরাকাষ্ঠায়। ৩৬টি কবিতা থেকে আলাদা করে বেছে নেওয়ার কোনও সুযোগ রাখেননি বিকাশ যদিও প্রতিটি কবিতা নিয়েই হতে পারে স্বতন্ত্র আলোচনা, প্রতিটি পঙ্‌ক্তি তুলে ধরা যেতে পারে উদ্ধৃতি হিসেবে। সেই পরিসর যেহেতু নেই তাই কিছু পঙ্‌ক্তি এলোমেলো ভাবেই তুলে ধরা যাক নাহয়। নিজেকে নিয়ে, প্রেম, প্রকৃতি, যৌনতা, বিরহ, বিচ্ছেদ, কবিতা নিয়ে কী ভাবেন কবি ? চোখ রাখা যাক অগুনতি থেকে এলোমেলো বেছে নেওয়া কিছু অনাবিল পঙ্‌ক্তি। চোখ রাখা যাক কবিতার শিরোনাম, শব্দক্ষেপণ, শব্দচয়ন, অলংকার ও বিষয় বৈচিত্রে -
...যেখানেই যাই, আসলে আমি তো এক গেঁয়োগুর্বো বোকা কবিয়াল
আলোকিত জাদুজামবনে আমার রয়েছে শুধু এক সঙ্গী হরিয়াল। (কবিতা - মেছুয়াপাড়ের এক গূঢ় হরিয়াল)।
তুমি তো টগর, তোমার পাপড়ি ছুঁয়ে মৃদু এক বুনোসুর বাজে
আমরা দুজন তবে দমনপুরেই যাব হিমবন্ত শরতের মাঝে।... (কবিতা - দমনপুর)।
তোমাকে জড়াই আর মনে হয় এ পাহাড়ের, ঝরনার, অরণ্যের রহস্য জানি
আমি এক নাঙাভুখা রাখালবালক, উমিয়ামে থাকি আর তুমি মেঘেদের রানি
এই স্যাঁতসেঁতে ভেজা ভেজা প্রেম, সাক্ষী সব কুয়াশার ঝরনাপাহাড়
এই জন্মে না হলেও পরজন্মে, রানি, মেঘেদের রথে চড়ে আসব আবার। (কবিতা - মেঘমালাদের রানি)
শহরের মেয়ে বুকে হাত রেখে বলো দেখি তুমি কি এসব বোঝো ?
কবিতার গলা টিপে ধরে তুমি শুধু ছন্দ ও মাত্রার ভুল খোঁজো।... (কবিতা - সের্গেই আর্তুর গখ)।    
না, বিকাশের কবিতায় ভুল ধরার বা ভুল খোঁজার পণ্ডশ্রম করার কোনো মানেই হয় না। তার চেয়ে ঢের সহজ তাঁর কবিতায় মনোনিবেশ করা। এখানেই সাধারণ পাঠক থেকে বোদ্ধা পাঠক সবাই স্বতঃস্ফুর্ত। সবার জন্য লিখেন বিকাশ। সবার কাছেই তাই পৌঁছে যায় কবিতার পুরো নির্যাস। ছন্দের কিংবা ছন্দহীনতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছন্দের দোলায় দোলে ওঠে পাঠক-হৃদয়। শব্দের কী অমোঘ ব্যবহার। রূপক, দ্যোতনা, দ্বিত্ব, অনুপ্রাসে ভরপুর সব কবিতা। গ্রন্থের মাঝখান থেকে একটি কবিতা ও সেখান থেকে প্রথম ও শেষ দুটি চরণ এখানে খানিকটা নেড়েচেড়ে দেখা যেতে পারে। শিরোনাম - ‘রোজ রোজ হয়েছি রচিত’। পঙ্‌তি -
আমাকে কবি বলো না, আমি কি রচনা করেছি আকাশ ?
আমি কি রচনা করেছি কোনো হরিৎমুখর কচি দূর্বাঘাস ?...
কিছুই রচনা করিনি আমি, সব যেন ছিল, আছে, আছে চিত্রার্পিত
প্রকৃত কবির খাতায় আমি শুধু রোজ রোজ ভবিতব্যে হয়েছি রচিত।
মাঝের পুরো কবিতা উদ্ধৃত না করেই কেমন এক নির্ধারিত সাযুজ্য। কী অসীম নিবেদন। কী মুখরিত সমর্পণ। যেন ঘোরের আবহে এক আস্ত আত্মজীবনী। না বলা কথা, অপ্রকাশিত ব্যথা ও পরাবাস্তব সত্যকে নির্লিপ্ত উদাসীনতায় কবি উদ্‌ঘাটিত করেছেন তুমুল গরিমায়। নিজেকে প্রকাশিত করেছেন আদ্যোপান্ত। কিংবা হয়তো শুধু কবিতারই আহ্বানে কবিতায় উৎসারিত হয়েছেন কবি নিজেই।
বিকাশের কবিতা আর ‘গয়েরকাটা’ থাকবে না, এ কি হয় ? আছে তার কথা ‘পুড়ে যাওয়া শিউলির গন্ধ’ শীর্ষক এক দহন-কবিতায়। ‘ব্রাত্য কবিতার চর’ এক বিচিত্র অনুভবের চিত্রায়িত দীর্ঘ কবিতা। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘মুন্নি ছেত্রি, ভটু গোয়ালা, সরবজিৎ কাউর, বিদ্যুৎ বসু, কালিয়া লোহার ও শুভ্র চট্টোপাধ্যায়’ - তাঁর অকালপ্রয়াত বন্ধুদের স্মৃতির উদ্দেশে। তাঁদের নিয়েই লিখেছেন কবিতা - ‘যেতে অল্প দেরি হবে’। কী নিদারুণ সারল্যে কবি বলছেন -
...এত ডাকাডাকি কেন ? যাবই তো তবে রহস্য রয়েছে কিছু বাকি
এ জীবন যে এক অক্ষয় ফাঁকি ...
কিছু কাজ বাকি আছে, এখন যাব না, অল্প হবে দেরি।
শেষ কবিতা গ্রন্থনামশীর্ষক - ‘আত্মজীবনীর পরাবাস্তব’। এই একটি কবিতার হাত ধরেই কবি নির্দ্বিধায় পৌঁছে যান কাব্যবিশ্বের আনাচে কানাচে। নিজেকে যেন নিজেই খনন করে এনেছেন কবি। উজাড় করে দিয়েছেন সব অঘোষিত জবানবন্দি। বিকাশ নিজেকে নিজেই করেছেন উদঘাটিত, প্রকাশিত, বিকশিত। এই একটি কবিতার জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকবেন এই কবিতাবিশ্বে।
কলিকাতা লেটারপ্রেস থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির চমৎকার প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন দেবাশিস সাহা। দুটি ব্লার্ব ও শেষ মলাট কথাশূন্য হয়ে রইল যেখানে উচ্চারিত হতে পারত বহু কথা। পাঠক বঞ্চিত। ছাপা স্পষ্ট হলেও পঙ্‌ক্তিসমূহ অধিক বিন্যস্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। কবিতার শিরোনামে থাকা অক্ষর-আকার খানিকটা বড়ো হলে স্পষ্টতা ও দৃষ্টিনান্দনিকতা বেড়ে যেত। শুদ্ধ বানান পঠনসুখের আমেজ এনে দেয় সততই। এই আমেজ আর এই ঘোর লাগাই আলোচ্য গ্রন্থের সম্পদ। পাঠশেষে নিমগ্ন পাঠকের বইয়ের তাক নিশ্চিতই সমৃদ্ধ করবে এই গ্রন্থ।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১৫০ টাকা।
যোগাযোগ - ৯৮৩১৪০২৩৩১ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...