জীবন বা পরিবেশ সম্বন্ধে কতখান
উদাসীন অইলে এমন কুনো হঠকারী পরিস্থিতির শিকার অইতে লাগে, আইজ তার এক
মোক্ষম হদিশ পাইলা দীপেন্দুবাবু। শীতর দিন। বন্ধবারে সকালো নরম রইদর
আমেজ মাখিয়া একটু ফুরফুরা অইতে কার না মন চায় ? বউত ভাবিয়া চিন্তিয়া কইতে গেলে এক আনুক্কা
অভিযানো বারইলা দীপেন্দু, তবে বেশি দূর কুনুখানো নায়
- কাছাকাছি অউ, নূতন কিনা স্কুটি অখান লইয়া।
বছরখানেক অইল দীপেন্দু তারা নূতন কিনা ফ্ল্যাটো আইয়া উঠছইন টাউনর এক কিনারো সবুজ-ঘিরা, প্রদূষণহীন এই এলাকাত। এলাকাটা খালি টাউনর অউ নায়, অবস্থিত রাজ্যসীমানারও কাছে। এর ধারো অউ আছে মেঘালয়র লম্বা সীমানা। কাছর রাজ্য থাকি নামিয়া আওয়া লম্বা পাড়র নীচদিক ঘিরিয়া ই নুতন আবাসিক এলাকা ইখান। ইনো আবহাওয়া বারোমাস অউ মধুর। শীতর সকালো কুয়াশার চাদ্দরে ঢাকা থাকে বউত সময়। গরমে পাড়র নরম, ঠাণ্ডা বাতাস আইয়া জান বাঁচায় রাস্তাবায় চলা মানুষর, আবাসিকহকলর। এলাকার রাস্তাঘাট ইতা ওখনও চিনা জানা অইছে না পুরাপুরি। তবে সরকারি ব্যবস্থায় প্রত্যেকটা রাস্তার ধারো সন্ধ্যা অইলে অউ জ্বলি উঠে ইলেকট্রিক লাইট। কিছু লাইট জ্বলে পাড়র গাতও। যারা পাড়র গাত বসতি স্থাপন করিয়া থাকে তারার উঠান পারইয়া ই বাত্তি রাস্তার মানুষর মনমগজো উৎসবর আমেজ জাগায়।
দীপেন্দু প্রায় অউ সান্ধ্য ভ্রমণো বারইয়া আশ্চর্য অইয়া দেখইন ই বাত্তির বাহার। পাড়র বুক চিরিয়া যেমন আলোর ফুলঝুরি। মানুষে ভরি যার পাড়-পর্বত। ই কয়দিনো অউ তান বড় ভালা লাগি গেছে এলাকাটা। তবে সান্ধ্য ভ্রমণো বারইয়া এক আনুক্কা জীবনধারার আত্মচিন্তাত মগ্ন অই যাইন তাইন রোজ। পাও দুইটা যখন চলাত থাকে ছন্দ মিলাইয়া, মন তখন অফসর। এই অফসরে প্রত্যেক দিন নিজর জীবনোর স্ন্যাপশট যেমন সাজাইল গুছাইল ছবির মতন ভাসিয়া উঠে চউখর সামনে।
সন্ধ্যাকাল তান সবথাকি সমৃদ্ধ আছিল কিশোর বেলায় বা প্রথম যৌবনর দিনগুলায়। পরীক্ষার পড়ার চাপ যখন থাকত না তখন এক দঙ্গল বন্ধু মিলিয়া কদমতলার চা’র দোকানো ঝড় উঠত কথার। অনর্গল কথা শেষ অইতে না অইতে অউ দঙ্গল যাইত বাসরাস্তা ধরিয়া আটিয়া আটিয়া কুনু এক কালভার্টর ধারো। পাশ-কম রাস্তার দুইধারো কালভার্টর রেলিংরে বেঞ্চ বানাইয়া বইয়া চলত জমাইল আড্ডা। প্রত্যেকটা ঘরোর দুর্দশার দিন কাটানির বদলা যেমন আরকি। ধর্মীয় রেষারেষির জেরে ভিটামাটি হারাইল পরিবারগুলা একলগে আইয়া বাড়ি বানাইছলা হিখানো। দীপেন্দু তারার হনো অউ জন্ম, হনো অউ প্রাথমিক শিক্ষা। মাথা থাকা কিশোর বা সদ্য যুবক দীপেন্দু আছিল আড্ডার শিরোমণি। পড়াশোনা বা পরীক্ষার ডর থাকি বাঁচার লাগি কিছু অইলেও বাকি বন্ধুরার দায় তাইন মাথা পাতিয়া লইছিল।। কথা ইখান ই বয়সো আইয়াও স্বীকার করে সবে।
কয়েকদিন আগে ছুটোবেলার বন্ধু, আইজকুর প্রতিষ্ঠিত চাকরিয়ান বন্ধু ধ্রুব আইছিল দীপেন্দুর টাউনো, গৌহাটি। ধ্রুবর মেয়ের চাকরির পরীক্ষা আছিল। দীপেন্দু অউ গাড়ি করিয়া লইয়া গেল পরীক্ষা হলও। মেয়ে পরীক্ষা হলও ঢুকার পরে প্রায় ঘণ্টা তিনেক অফসর। প্রস্তাবটা দীপেন্দু অউ দিল - চল দীপর বিলর পারও গিয়া বই। গৌহাটির অন্য এক কিনারো দীপর বিল।
প্রস্তাব লুফিয়া লইল ধ্রুবয়। সময় কাটানির এমন মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না কেউ অউ। প্রকৃতির কুলো তারা বড়
অইছে, গতিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ তারার খুব প্রিয়। ইদিন ছিল রবিবার। শীতর আমেজো বিলর ধারো বিরাট এলাকা লইয়া চলের বনভোজন উৎসব, মানে পিকনিক আরকি। মানুষ আর গাড়ির মেলা বইছে যেমন। দীপেন্দু গাড়িটারে বেশ কিছু দূরই আউজ্ঞাইয়া লইয়া গিয়া ভিড়মুক্ত অইয়া দাঁড় করাইলা একটা বড় বটজাতীয় গাছর নীচে, বিলর পার ঘেষিয়া। নামিয়া আইলা দুই বন্ধু। খোলা দুই চউখর সামনে বিশাল দীপর বিল। কিন্তু মনর মধ্যে ভাসিয়া উঠল শৈশবর হউ আপন শনবিল। আয়তনে শনবিলর কাছে শিশু ই বিল ইখান। তবুও চউখর সামনে ইলাখান বিশাল জলাশয় যেমন দুই বন্ধুর বুকো আবার ঢেউ তুলছে বউতদিন পরে। দুনিয়ার সব কথা আইয়া যেমন আচ্ছন্ন করি লাইছে দুই হৃদয়। ধ্রুবয় কয় - তোর মনো আছে নি আমরার দল বান্ধিয়া হউ শনবিল ভ্রমণর কথা ?
– মনো নাই ? আমার সাইকেলটা অউত্তো আছিল সবর শেষে। আর পারছিলাম না চালাইতে। অতো দূর চালাইতে চালাইতে আমি যেন নিঃশেষ হই গেছলাম। তোমরা তখন আউজ্ঞাই গেছ কত দূর।
– ঠিক, ঠিক। চাইয়া দেখি তুই নাই। ফিরিয়া পিছাইয়া আইয়া আবিষ্কার করলাম তোরে। এরপরে এক দুকানো সাইকেল রাখিয়া নৌকা লইয়া মোকাম কালীবাড়ি। কী যে সুন্দর আছিল রে দিনটাইন।
– একদম রে। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। হিদিন সন্ধ্যার সময় কালীবাড়ি বাজারর চা’র দোকানো কিতা হইছিল মনো আছে নি ?
হো হো করি হাসিয়া ওঠে ধ্রুব। চউখর সামনে ভাসিয়া উঠে অপরিণত বয়সর প্রেমভাবজনিত হউ অপরূপ ঘটনাবলির দৃশ্য। চা পরিবেশনকারী হউ সুন্দরী মেয়েটার কথা আইজও ভুলছে না ধ্রুব।
কথায় কথায় পার অই গেছে বউত সময়। ফিরিয়া আইলা দুইও জন পরীক্ষা হলও। পরীক্ষার পরে ধ্রুব আর তার মেয়ে গেল গিয়া সুজা বাস ডিপোর দিকে বাড়িত ফিরিয়া যাওয়ার লাগি। ইবায় একলা একলা ঘরো ফিরিয়া আইয়া আর হিদিন সান্ধ্য ভ্রমণো বারইলা না মনমরা দীপেন্দু। পরর দিন সকাল অইতে ওউ ফির মন আনচান। কিতা যে লুকাই রইছে ভিতরে, খালি বাইরম বাইরম মন। জীবনর কত কত দিন ধরিয়া হউ যে সবুজ যেতা আছিল তান নিত্যদিনর আওয়া যাওয়া পথোর ধারো ছড়াইল রাশি রাশি, হউ সবুজর আলিঙ্গন থাকি পড়ি রইছইন বউত দূর। আইজ কয়দিন থাকি অউ মনর মধ্যে হউ সবুজর এক তীব্র টান। হউ সবুজ ই পাড়র দূর থাকি দেখা সবুজ নায়। হি সবুজ আছিল হাতের লাগালও, হাটা পথর দুইধারো - বেজান।
হি সবুজ ছাড়িয়া আইতে গিয়া অতো কিচ্ছু অনুভব করছিলা না দীপেন্দু। কিন্তু পরে যত দিন গড়াইছে তত অউ যেমন বুকর মধ্যে গাড়িয়া বইছে বেশি করিয়া। প্রত্যেক দিন রাইত বিছনাত গেলে অউ মন ছুটিয়া যায়গি হউ পারইয়া আওয়া দিনো। স্পষ্ট বাস্তব অইয়া যেমন ধরা দেয় কল্পনার হউ ছবিগুলা। লায় লায় এক সবুজঘিরা শান্ত শরীরর দুই চউখ জড়াইয়া ঘুম আয়। স্বপ্নেও আয় হউ ছবি প্রায় অউ, স্ন্যাপশটর মতো সাজাইল গুছাইল।
ইস্কুল থাকি ফিরার সময় হউ ছুটো হাটা পথ। দুই আত বাড়াইলে অউ পাড়র গাত লাগি থাকা গাছগাছালির আলিঙ্গন। আর হউ পথখান পারইলে অউ হাটা পথর দুই সাইডে শস্যসবুজ ধানর খেত। হালি থাকি ভরন্ত যৌবনবতী ধানর বাড়িয়ায় উঠা দেখি দেখি চউখে মনে কী যে এক বিরাট শান্তি। মাজে মাজে ইস্কুল বন্ধর দিনো আইলপথ ধরি ঘুরিয়া বেড়ানি বা বৃষ্টির জলো ভাইয়া আওয়া ছুটো ছুটো মাছরে পাকড়াও করার লাগি ইবায় হিবায় ছুটাছুটি। হিতা পারইয়া আওয়া দিনর জ্বলজ্বল ছবি যেমন ভিতরে বাসা বান্ধিলাইছে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র মতো।
###
কয়দিন ধরি অউ তেমন এক পরিবেশর মধ্যে নিজেরে লইয়া যাওয়ার লাগি উন্মুখ হই রইছইন দীপেন্দু। নানা কামর চাপে আর সম্ভব অইছিল না অতদিন। আইজ রবিবার। আগের দিন সারিলাওয়ায় বাজারহাটর চাপ কম। সকাল সকাল হকলতা সারিয়া সকালর চা-টিফিন খাইয়া অউ গৃহিণীরে কইলা - ‘আমি একটু আই গিয়ে’। জবাবর অপেক্ষা না করিয়া অউ তাইন বারই গেলা স্কুটি লইয়া। আইজ কিছু সময় কাটাইতে অউ লাগব সবুজর লগে।
পাড়র গা ঘেষিয়া যে রাস্তাটা গেছে তার প্রথম দিকে পাড় অইলেও পরে আছে পাড়র উলটা সাইডে কিছু সমতল ভূমি। হউ ভূমি অউ আইজ তান গন্তব্য। বুকর ভিতরে ফলবতী ধানখেতর ডাক, সবুজর ডাক। সফর শুরু করলা দীপেন্দু। উচা পথ পারইয়া অখন রাস্তা নীচে নামছে যদিও রাস্তার দুই দিকে অউ খালি বাড়িঘর চউখো পড়ল দীপেন্দুর। ইতা দেখিয়া মুটে অউ ভালা লাগের না যদিও কিছু নূতন বসতি যেমন গড়িয়া উঠছে দেখলা অউ অঞ্চল জুড়িয়া। দীপেন্দুর জানা আছিল না। ইতা এলাকার নামও শুনছইন না তাইন। গোবিন্দপুর, উদয়পুর, পাথরকুচি, লতাকাটা অতা এলাকা পারইয়া ছুটিয়া যাইরা তাইন আর দেখরা সব কলম্বাসের চউখ দিয়া, পাওয়া নি যায় সবুজ খেত। কিন্তু কই তান ভিতরে থাকা হি সবুজ ? আবার একটু উপরে উঠা, একটু নীচে নামা। বাউদিকে কাছে অউ পার্শ্ববর্তী রাজ্যর পাড়র ঢল। গতিকে তাইন ডাইনদিকে চাইয়া চাইয়া যাইরা হউ ধানিজমি খুঁজিয়া। স্কুটি চলের মাইলর পরে মাইল কিন্তু সবুজ খেত আর চউখো পড়ে না দীপেন্দুর। এক এক করিয়া জনবসতি পারইয়া হঠাৎ করি কিছু খালি সমভূমি চউখো পড়ল দীপেন্দুর। আনন্দে আর ধরে না। কিন্তু উৎসাহী অইয়া কাছে আইতে অউ নিরাশ অইলা। না, ধানর জমি নায় ইতা। বা অইলেও অখন খালি এবড়োখেবড়ো মাটির উপরে জঞ্জালের মতো কিছু ঘাসর মতো। হতাশ অইয়া ফির চলতে থাকলা। যাইতে যাইতে অলা আরো কিছু সমভূমি বা মাঠর মতো জমি চউখো পড়ল যদিও সব অউ ফাঁকা। যাইতে যাইতে দূর, বউত দূর পৌঁছার পরে দীপেন্দুয়ে আবিষ্কার করলা তাইন ঘুরিয়া ঘুরিয়া আবার তান আবাসনর কাছাকাছি আই গেছইন। ইদিকে পথঘাট কিছুটা তান চিনা। গতিকে নিরাশ অইয়া অখন ঘরর দিকে অউ স্কুটির মুখ ঘুরাইলা দীপেন্দু। বুঝলা আইজ আর হি সবুজর দর্শন তান কপালো নাই।
মনে মনে আশ্চর্য অইলা দীপেন্দু। অত অত নিচু জেগা থাকলেও কুনু ধান গাছ নাই কেনে ? জমিত ফসল নাই কেনে ? ইতা জেগাত তো অনায়াসে ফলানো যাইত ফসল। ভাবতে ভাবতে আবাসনো পৌছতে অউ চউখো পড়ল সরস্বতী পুজার প্যান্ডেল বানানির কাম শুরু অইছে। আর ঠিক তখন হঠাৎ করিয়া যেন চমকাইয়া উঠলা ভিতরে ভিতরে। নিজে অউ আবিষ্কার করলা তান চিন্তাশক্তির দুর্বলতা। এই ভরা মাঘ মাসো মাঠ কিতা আর ভরা থাকে নি ধানর গাছে ? আবিষ্কার করলা নিজেরে আর একবার। বড় অসহায়, বড় দুর্বল লাগল নিজেরে। প্রকৃতির রূপটা অউ খালি উপভোগ করছইন অতদিন। গাছর জীবনযাত্রার লগে নিজেরে পরিচিত করাইছইন না কুনুদিন।
হতাশার মধ্যেও নিজর নির্বুদ্ধিতার লাগি নিজেরে অউ শাপশাপান্ত করতে থাকলা দীপেন্দু। মনে মনে ভাবলা মাস তিনেক পরে আরেকবার বারইবা এমন অউ এক সফরো।
বছরখানেক অইল দীপেন্দু তারা নূতন কিনা ফ্ল্যাটো আইয়া উঠছইন টাউনর এক কিনারো সবুজ-ঘিরা, প্রদূষণহীন এই এলাকাত। এলাকাটা খালি টাউনর অউ নায়, অবস্থিত রাজ্যসীমানারও কাছে। এর ধারো অউ আছে মেঘালয়র লম্বা সীমানা। কাছর রাজ্য থাকি নামিয়া আওয়া লম্বা পাড়র নীচদিক ঘিরিয়া ই নুতন আবাসিক এলাকা ইখান। ইনো আবহাওয়া বারোমাস অউ মধুর। শীতর সকালো কুয়াশার চাদ্দরে ঢাকা থাকে বউত সময়। গরমে পাড়র নরম, ঠাণ্ডা বাতাস আইয়া জান বাঁচায় রাস্তাবায় চলা মানুষর, আবাসিকহকলর। এলাকার রাস্তাঘাট ইতা ওখনও চিনা জানা অইছে না পুরাপুরি। তবে সরকারি ব্যবস্থায় প্রত্যেকটা রাস্তার ধারো সন্ধ্যা অইলে অউ জ্বলি উঠে ইলেকট্রিক লাইট। কিছু লাইট জ্বলে পাড়র গাতও। যারা পাড়র গাত বসতি স্থাপন করিয়া থাকে তারার উঠান পারইয়া ই বাত্তি রাস্তার মানুষর মনমগজো উৎসবর আমেজ জাগায়।
দীপেন্দু প্রায় অউ সান্ধ্য ভ্রমণো বারইয়া আশ্চর্য অইয়া দেখইন ই বাত্তির বাহার। পাড়র বুক চিরিয়া যেমন আলোর ফুলঝুরি। মানুষে ভরি যার পাড়-পর্বত। ই কয়দিনো অউ তান বড় ভালা লাগি গেছে এলাকাটা। তবে সান্ধ্য ভ্রমণো বারইয়া এক আনুক্কা জীবনধারার আত্মচিন্তাত মগ্ন অই যাইন তাইন রোজ। পাও দুইটা যখন চলাত থাকে ছন্দ মিলাইয়া, মন তখন অফসর। এই অফসরে প্রত্যেক দিন নিজর জীবনোর স্ন্যাপশট যেমন সাজাইল গুছাইল ছবির মতন ভাসিয়া উঠে চউখর সামনে।
সন্ধ্যাকাল তান সবথাকি সমৃদ্ধ আছিল কিশোর বেলায় বা প্রথম যৌবনর দিনগুলায়। পরীক্ষার পড়ার চাপ যখন থাকত না তখন এক দঙ্গল বন্ধু মিলিয়া কদমতলার চা’র দোকানো ঝড় উঠত কথার। অনর্গল কথা শেষ অইতে না অইতে অউ দঙ্গল যাইত বাসরাস্তা ধরিয়া আটিয়া আটিয়া কুনু এক কালভার্টর ধারো। পাশ-কম রাস্তার দুইধারো কালভার্টর রেলিংরে বেঞ্চ বানাইয়া বইয়া চলত জমাইল আড্ডা। প্রত্যেকটা ঘরোর দুর্দশার দিন কাটানির বদলা যেমন আরকি। ধর্মীয় রেষারেষির জেরে ভিটামাটি হারাইল পরিবারগুলা একলগে আইয়া বাড়ি বানাইছলা হিখানো। দীপেন্দু তারার হনো অউ জন্ম, হনো অউ প্রাথমিক শিক্ষা। মাথা থাকা কিশোর বা সদ্য যুবক দীপেন্দু আছিল আড্ডার শিরোমণি। পড়াশোনা বা পরীক্ষার ডর থাকি বাঁচার লাগি কিছু অইলেও বাকি বন্ধুরার দায় তাইন মাথা পাতিয়া লইছিল।। কথা ইখান ই বয়সো আইয়াও স্বীকার করে সবে।
কয়েকদিন আগে ছুটোবেলার বন্ধু, আইজকুর প্রতিষ্ঠিত চাকরিয়ান বন্ধু ধ্রুব আইছিল দীপেন্দুর টাউনো, গৌহাটি। ধ্রুবর মেয়ের চাকরির পরীক্ষা আছিল। দীপেন্দু অউ গাড়ি করিয়া লইয়া গেল পরীক্ষা হলও। মেয়ে পরীক্ষা হলও ঢুকার পরে প্রায় ঘণ্টা তিনেক অফসর। প্রস্তাবটা দীপেন্দু অউ দিল - চল দীপর বিলর পারও গিয়া বই। গৌহাটির অন্য এক কিনারো দীপর বিল।
– ঠিক, ঠিক। চাইয়া দেখি তুই নাই। ফিরিয়া পিছাইয়া আইয়া আবিষ্কার করলাম তোরে। এরপরে এক দুকানো সাইকেল রাখিয়া নৌকা লইয়া মোকাম কালীবাড়ি। কী যে সুন্দর আছিল রে দিনটাইন।
– একদম রে। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। হিদিন সন্ধ্যার সময় কালীবাড়ি বাজারর চা’র দোকানো কিতা হইছিল মনো আছে নি ?
কথায় কথায় পার অই গেছে বউত সময়। ফিরিয়া আইলা দুইও জন পরীক্ষা হলও। পরীক্ষার পরে ধ্রুব আর তার মেয়ে গেল গিয়া সুজা বাস ডিপোর দিকে বাড়িত ফিরিয়া যাওয়ার লাগি। ইবায় একলা একলা ঘরো ফিরিয়া আইয়া আর হিদিন সান্ধ্য ভ্রমণো বারইলা না মনমরা দীপেন্দু। পরর দিন সকাল অইতে ওউ ফির মন আনচান। কিতা যে লুকাই রইছে ভিতরে, খালি বাইরম বাইরম মন। জীবনর কত কত দিন ধরিয়া হউ যে সবুজ যেতা আছিল তান নিত্যদিনর আওয়া যাওয়া পথোর ধারো ছড়াইল রাশি রাশি, হউ সবুজর আলিঙ্গন থাকি পড়ি রইছইন বউত দূর। আইজ কয়দিন থাকি অউ মনর মধ্যে হউ সবুজর এক তীব্র টান। হউ সবুজ ই পাড়র দূর থাকি দেখা সবুজ নায়। হি সবুজ আছিল হাতের লাগালও, হাটা পথর দুইধারো - বেজান।
হি সবুজ ছাড়িয়া আইতে গিয়া অতো কিচ্ছু অনুভব করছিলা না দীপেন্দু। কিন্তু পরে যত দিন গড়াইছে তত অউ যেমন বুকর মধ্যে গাড়িয়া বইছে বেশি করিয়া। প্রত্যেক দিন রাইত বিছনাত গেলে অউ মন ছুটিয়া যায়গি হউ পারইয়া আওয়া দিনো। স্পষ্ট বাস্তব অইয়া যেমন ধরা দেয় কল্পনার হউ ছবিগুলা। লায় লায় এক সবুজঘিরা শান্ত শরীরর দুই চউখ জড়াইয়া ঘুম আয়। স্বপ্নেও আয় হউ ছবি প্রায় অউ, স্ন্যাপশটর মতো সাজাইল গুছাইল।
ইস্কুল থাকি ফিরার সময় হউ ছুটো হাটা পথ। দুই আত বাড়াইলে অউ পাড়র গাত লাগি থাকা গাছগাছালির আলিঙ্গন। আর হউ পথখান পারইলে অউ হাটা পথর দুই সাইডে শস্যসবুজ ধানর খেত। হালি থাকি ভরন্ত যৌবনবতী ধানর বাড়িয়ায় উঠা দেখি দেখি চউখে মনে কী যে এক বিরাট শান্তি। মাজে মাজে ইস্কুল বন্ধর দিনো আইলপথ ধরি ঘুরিয়া বেড়ানি বা বৃষ্টির জলো ভাইয়া আওয়া ছুটো ছুটো মাছরে পাকড়াও করার লাগি ইবায় হিবায় ছুটাছুটি। হিতা পারইয়া আওয়া দিনর জ্বলজ্বল ছবি যেমন ভিতরে বাসা বান্ধিলাইছে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র মতো।
###
কয়দিন ধরি অউ তেমন এক পরিবেশর মধ্যে নিজেরে লইয়া যাওয়ার লাগি উন্মুখ হই রইছইন দীপেন্দু। নানা কামর চাপে আর সম্ভব অইছিল না অতদিন। আইজ রবিবার। আগের দিন সারিলাওয়ায় বাজারহাটর চাপ কম। সকাল সকাল হকলতা সারিয়া সকালর চা-টিফিন খাইয়া অউ গৃহিণীরে কইলা - ‘আমি একটু আই গিয়ে’। জবাবর অপেক্ষা না করিয়া অউ তাইন বারই গেলা স্কুটি লইয়া। আইজ কিছু সময় কাটাইতে অউ লাগব সবুজর লগে।
পাড়র গা ঘেষিয়া যে রাস্তাটা গেছে তার প্রথম দিকে পাড় অইলেও পরে আছে পাড়র উলটা সাইডে কিছু সমতল ভূমি। হউ ভূমি অউ আইজ তান গন্তব্য। বুকর ভিতরে ফলবতী ধানখেতর ডাক, সবুজর ডাক। সফর শুরু করলা দীপেন্দু। উচা পথ পারইয়া অখন রাস্তা নীচে নামছে যদিও রাস্তার দুই দিকে অউ খালি বাড়িঘর চউখো পড়ল দীপেন্দুর। ইতা দেখিয়া মুটে অউ ভালা লাগের না যদিও কিছু নূতন বসতি যেমন গড়িয়া উঠছে দেখলা অউ অঞ্চল জুড়িয়া। দীপেন্দুর জানা আছিল না। ইতা এলাকার নামও শুনছইন না তাইন। গোবিন্দপুর, উদয়পুর, পাথরকুচি, লতাকাটা অতা এলাকা পারইয়া ছুটিয়া যাইরা তাইন আর দেখরা সব কলম্বাসের চউখ দিয়া, পাওয়া নি যায় সবুজ খেত। কিন্তু কই তান ভিতরে থাকা হি সবুজ ? আবার একটু উপরে উঠা, একটু নীচে নামা। বাউদিকে কাছে অউ পার্শ্ববর্তী রাজ্যর পাড়র ঢল। গতিকে তাইন ডাইনদিকে চাইয়া চাইয়া যাইরা হউ ধানিজমি খুঁজিয়া। স্কুটি চলের মাইলর পরে মাইল কিন্তু সবুজ খেত আর চউখো পড়ে না দীপেন্দুর। এক এক করিয়া জনবসতি পারইয়া হঠাৎ করি কিছু খালি সমভূমি চউখো পড়ল দীপেন্দুর। আনন্দে আর ধরে না। কিন্তু উৎসাহী অইয়া কাছে আইতে অউ নিরাশ অইলা। না, ধানর জমি নায় ইতা। বা অইলেও অখন খালি এবড়োখেবড়ো মাটির উপরে জঞ্জালের মতো কিছু ঘাসর মতো। হতাশ অইয়া ফির চলতে থাকলা। যাইতে যাইতে অলা আরো কিছু সমভূমি বা মাঠর মতো জমি চউখো পড়ল যদিও সব অউ ফাঁকা। যাইতে যাইতে দূর, বউত দূর পৌঁছার পরে দীপেন্দুয়ে আবিষ্কার করলা তাইন ঘুরিয়া ঘুরিয়া আবার তান আবাসনর কাছাকাছি আই গেছইন। ইদিকে পথঘাট কিছুটা তান চিনা। গতিকে নিরাশ অইয়া অখন ঘরর দিকে অউ স্কুটির মুখ ঘুরাইলা দীপেন্দু। বুঝলা আইজ আর হি সবুজর দর্শন তান কপালো নাই।
মনে মনে আশ্চর্য অইলা দীপেন্দু। অত অত নিচু জেগা থাকলেও কুনু ধান গাছ নাই কেনে ? জমিত ফসল নাই কেনে ? ইতা জেগাত তো অনায়াসে ফলানো যাইত ফসল। ভাবতে ভাবতে আবাসনো পৌছতে অউ চউখো পড়ল সরস্বতী পুজার প্যান্ডেল বানানির কাম শুরু অইছে। আর ঠিক তখন হঠাৎ করিয়া যেন চমকাইয়া উঠলা ভিতরে ভিতরে। নিজে অউ আবিষ্কার করলা তান চিন্তাশক্তির দুর্বলতা। এই ভরা মাঘ মাসো মাঠ কিতা আর ভরা থাকে নি ধানর গাছে ? আবিষ্কার করলা নিজেরে আর একবার। বড় অসহায়, বড় দুর্বল লাগল নিজেরে। প্রকৃতির রূপটা অউ খালি উপভোগ করছইন অতদিন। গাছর জীবনযাত্রার লগে নিজেরে পরিচিত করাইছইন না কুনুদিন।
হতাশার মধ্যেও নিজর নির্বুদ্ধিতার লাগি নিজেরে অউ শাপশাপান্ত করতে থাকলা দীপেন্দু। মনে মনে ভাবলা মাস তিনেক পরে আরেকবার বারইবা এমন অউ এক সফরো।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
Comments
Post a Comment