Skip to main content

কবিতা নিয়ে এক আত্মমগ্নতার প্রতিভাস ‘রোমন্থন ৪’


আরবি শব্দশতরঞ্জ সেখান থেকেই চতুরঙ্গ হয়ে বাংলায় এলেও সচরাচর ব্যবহৃত হতে দেখা যায় নাশতরঞ্জ কা খেলঅর্থাৎ দাবা অর্থে চৌষট্টি ঘরের এক বিশেষ খেলা এই আট বাই আট-এর সূত্র ধরেই কবিতার সূত্রপাত বর্ণমালা প্রকাশনী, ত্রিপুরা থেকে চন্দ্রশেখর বসাক কর্তৃক প্রকাশিত আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকায় অপর এক নামি লেখক, প্রকাশক সৈকত মজুমদার এ নিয়ে লিখছেন - ‘…এক নতুন গড়নরীতির কবিতা ২০২৫ বইমেলায় দাবাছকের দিকপাশে আট ঘরের মতো প্রতিটি রচনা আট শব্দে ও আট লাইনে সমৃদ্ধ দাবার প্রতিশব্দ দিয়েই গড়নটিরও স্বতপ্রবৃত্ত নামকরণশতরঞ্জকরেছেন রচয়িতা কবিতায় বারোটি মাস, নদী ও জনপদের স্বতন্ত্র চিত্র পাওয়া যাবে, যা আগে রচিত হয়নি হলেও সবগুলি হয়নি যথাসম্ভব তথ্যযুক্ত, মেদবর্জিত ও নন্দিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা একান্ত কিশোরপাঠ্যও
অনেকটাই খেই ধরিয়ে দেওয়া হল সংক্ষিপ্ত এই ভূমিকায় গ্রন্থটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে উৎসর্গ করা হয়েছেকিরাত দেশবাসীকে কোথায় এই কিরাত দেশ ? এই প্রশ্নের উত্তর জানা আলোচ্য গ্রন্থের কবিতা পড়ার আগে আবশ্যক মূলত চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও প্রাচীন বরাক উপত্যকা জুড়ে যে বিশাল ভূমিখণ্ড তারই নাম ছিল কিরাতভূমি এবং সেখানকার অধিবাসীদের কিরাত হিসেবে চিহ্নিত করা হতো ক্রমে এই অঞ্চল বৃহৎ বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় শিক্ষায়, সাহিত্যে, কৃষ্টি সংস্কৃতিতে
ত্রিপুরার কবি চন্দন পাল-এর কাব্যগ্রন্থরোমন্থন ৪ প্রথম প্রকাশ সদ্য অনুষ্ঠিত আগরতলা বইমেলা ২০২৫ ৪ কেন এই ব্যাপারে স্পষ্ট কোনও ধারণা করা গেল না কবির তরফে কোনো ভূমিকা কিংবা ‘ইতিপূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থাবলি’র কোনো হদিশ না থাকায়। গ্রন্থের প্রথম ব্লার্ব খালি থাকলেও দ্বিতীয় ব্লার্বে অতি সংক্ষিপ্ত কবি-পরিচিতির এক জায়গায় আছে কবিরনতুনত্বউদ্ভাবনের কথা এবং সেই সূত্রেই কবিতার এই নতুন ধাঁচের প্রকাশ কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্ত নেই চলে আসছে যুগ যুগান্তর ধরে একের পর এক ছন্দ, বিন্যাস এসেছে বাংলা সাহিত্যে তারই এক বিস্তার বলা যায় আলোচ্য গ্রন্থের সন্নিবিষ্ট কবিতাগুলি আট লাইনের কবিতা হলেও সেই অর্থে এগুলোকে সেইসব স্বীকৃতঅষ্টচরণ কবিতার পর্যায়ে ফেলা যাবে না কারণ এখানে প্রতি লাইনে আটটি শব্দের সংযোজনের ব্যাপারটিও থেকে গেছে
ফেরা যাক কিরাত ভূমির গন্তব্যে। কারণ সূচিপত্র অনুযায়ী গ্রন্থে রয়েছে মোট চারটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায় - ‘কিরাত ভূমির তেরো পার্বণ’। বারো মাসের নামে বারোটি কবিতা। সেই চৌষট্টি শব্দের কবিতা আট শব্দ করে আটটি লাইন। একটি কবিতা এখানে তুলে দেওয়া যেতেই পারে -
কবিতা - মাঘ
ঘুম থেকে নেমে দেখি, একী! ঘামঘাম জল কুয়াশা
দরজা হাতল চটি সড়ক, ফুল পাতায় লেপা কুয়াশা
ঘুমন্ত গাছে টিন চালে খড়ের গাদায় হিম কুয়াশা
মেঠো পথে ঝোপের আড়ে লাউ মাচায় চুপ কুয়াশা
গাভির পিঠে শালিক বসে তার ওপরে শ্বেত কুয়াশা
নদীর পারে রহিম গাঁয়ে রামের দেশে এক কুয়াশা
ধুম কুয়াশা শীত কুয়াশা মাঘ ঢাকা অন্ধ কুয়াশা
আলো চোরা ঘন কুয়াশা, নববর্ষে ওই জাগেরে আশা।
দ্বিতীয় অধ্যায় - ‘কিরাত ভূমির স্রোত’। রয়েছে স্রোতস্বিনী বারোটি নদীর নামে বারোটি কবিতা। গোমতী, হাওড়া, মনু, সুমলি, ফেনি, মুহুরি, বুড়িমা (বিজয়), জুরি, খোয়াই, ধলাই, লঙ্গাই ও দেও। তুলে দেওয়া যাক এখান থেকেও একটি কবিতা -
কবিতা - মুহুরি
দেবতামুড়ার দেবী তুমি, নেমে ভরো কলসি, ছলকায় মুহুরীপুর।
সাজাও মাঠ ঘাট, লাউগাঙ বাজার, রতনে ভরো রতনপুর।
আখ তরমুজ উচ্ছে বেগুন, আউশ আমন দু’কুল ফোটে,
পারে পারে পানবর ঘুমায়, মাটির সন্তান হেসে ওঠে।
বিদ্যাবহর প্রাচীন শহর, বিলোনিয়া বনকর ঘাট মুহুরি পারে
রেল ঝমাঝম বাদল ওড়ে, রামঠাকুর নিবাস মুহুরি ঘিরে।
বেয়ে আসে বাঁশ দূর শহরে, বর্ষণে মাছের নাচন।
শীতে বুক ভাসাও তুমি, কালিদাস চরে ফেনি মিলন।
তৃতীয় অধ্যায় - কিরাত ভূমির জনপদ। রয়েছে বারোটি জনপদের সন্ধানযুক্ত কবিতা। আমলিঘাট, বিলোনিয়া, সুপারিখোলা, সাতমুড়া, বক্সনগর, কেমতলি, অমরপুর, ডালাক, তারানগর, নেতাজিনগর, কাঞ্চনপুর ও তিলথৈ। বলা বাহুল্য সবক’টিই বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত জনপদএকটি কবিতা -
সাতমুড়া
সাত টিলার মাঝখানে যে, সে গাঁয়ের নাম সাতমুড়া
বিদ্যাপীঠ, বৈদ্য, এক নং টিলা, বিলোনিয়ায় ভাঙে আড়মোড়া।
রামঠাকুর স্মৃতি, মুহুরি চর, সাতমুড়া ছুঁয়ে সামান্য দূরে,
তৃষ্ণা বাইসন মৈত্রী পার্ক, দশমিনিটের পথ টোটো চড়ে।
বাজার মিলে সকাল বিকাল - পান, সবজি, ডিম, মাছ,
বইখাতা, মনোহারি, গুনা, পকুড়া - আছে মহামায়া কালীর সাজ।
কলেজ, রেডিও রেল তেল, সাতমুড়া গাঁয়ের গা ঘেঁষে,
শ্রমিক, নাপিত, চাকুরে, দোকানি, শিক্ষা সংস্কারে উন্নত বসবাসে।
চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে ছয়টি কবিতা ‘বিবিধ’ বিভাগ-নামে। অধিনায়ক, জাগঘুম, মালি, কবিতাঘর, প্রতিমা ও শিল্পী - সব অর্থপূর্ণ কবিতা। গ্রন্থে সব মিলিয়ে ৪২টি কবিতা। নিজ রাজ্যের, নিজভূমের স্থান, নদী নিয়ে অন্ত্যমিল ছন্দ মিলিয়ে এমন প্রয়াস একদিকে যেমন কবির কবিত্বের পরিচিতি তুলে ধরেছে তেমনি প্রকাশিত হয়েছে স্বভূমির প্রতি তাঁর অন্তরে সজ্জিত প্রেম ভালোবাসা ও আন্তরিকতার প্রতিচ্ছবি। এসব কবিতায় অক্ষর, মাত্রা কিংবা স্বরবৃত্তের অঙ্ক মেলানো একেবারেই দুরূহ যদিও এই অন্ত্যমিলের প্রচেষ্টা একাধারে এনে দিয়েছে ব্যতিক্রমী পঠনসুখ এবং কবির ছন্দমোহের হদিশ। আবার শন্দ, পঙ্‌ক্তি কিংবা নামসমূহের উল্লেখে হারিয়ে যায়নি বয়ান, হারিয়ে যায়নি মানবতার স্লোগান। দাবার মতোই কবিতার খেলায় মেতে উঠেছেন আত্মমগ্ন কবি।
৪৮ পৃষ্ঠার হার্ড বোর্ড বাঁধাই গ্রন্থের কাগজের মান, ছাপার স্পষ্টতা যথাযথ। আধুনিক বানান অনুসৃত হলেও কিছু বানান বিভ্রাট রয়ে গেছে যেমন থেকেই যায় অনবধানতায়। কবির আঁকা প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন। সব মিলিয়ে এক ভিন্ন আঙ্গিকের আয়াসসাধ্য প্রয়াস - ‘রোমন্থন - ৪’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২৫১ টাকা
যোগাযোগ - ৮৭৮৭৫৯৪৫২৩ 

Comments

  1. সুন্দর আলোচনা দাদা,,,, প্রেরণা পেলাম।
    আসলে প্রচ্ছদ আসার পর বুঝেছি বইটিতে ব্লার্ব থাকবে। আগের ১,২,৩ বইগুলি চটি (একফর্মা) ছিল, তাই এই বিচ্যুতি। রোমন্থন ১- মুদ্রনে হাতেখড়ি দুহাজার সালে লিফলেট আকারে। দুহাজার একুশের পরে ২ ও ৩ কবিতা বই হয়েছে সময়োপযোগী বিষয়বস্তু নিয়ে, সাথে ব্যয় সংকোচ নীতি !! এছাড়া ২০১৮ এর পর বিভক্ত স্বরলিপি নামে দুটি বোর্ড বাধাই কবিতার বইও হয়েছে । গুণাগুণ পাঠকের জন্য তোলা রইল। নমস্কার।

    ReplyDelete
  2. ভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা।ভালো লাগল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুশি হলাম দাদা,,💗
      বিবিধ অধ্যায়ের আরও বারোটি কবিতা রোমন্থন-৩ এ আগেই ঢুকে গিয়েছিল, তাই ৪ এ আনিনি। পৃষ্ঠা সীমাবদ্ধ করলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষার অন্ত নেই,,🙏

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...