… টিউশন শেষে ঘরে ফেরা
দেরি হলে
অসীম প্রতীক্ষায় পথের বাঁকে
ভেজা শাড়িতে, হ্যারিকেন হাতে
তুমি নির্ভয়, নিরলস বিপন্ন সময়ে
মা আমার
জননী আমার। (কবিতা - মা)
কিংবা -
...আমার আকাশ ছিল মায়ের আঁচল
ডানহাত নাকি পক্ষাঘাতে
অবশ তোমার
যে হাত সাজাত নবান্নের উৎসব
প্রকৃতির সংজ্ঞারূপ তোমরা সেই নারী
আসো বারবার
যে যাই বলুক দাঁড়িয়ে শিয়রে
সয়েছ সংসার তাপ একা ও নীরবে...
তোমার আরোগ্য আনুক ফুলের সৌরভ
এবার নিজেরাই সাজাবে নবান্নের উৎসব। (কবিতা - মা এই আকাশে)।
মা বিষয়ক এবং মাতৃবিষয়ক একগুচ্ছ কবিতার সমাহার কবি বিমলেন্দু চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘মা তুমি আকাশ’। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর কবি বিমলেন্দু নিজেকে জারিত করে তুলেছেন উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠায়। কুশিয়ারা থেকে মহাবাহু বিস্তৃত তাঁর কাব্যচারণ ভূমি। কবি আজ কবিতার উত্তরপূর্বে নিজেকে করে তুলেছেন অপরিহার্য যদিও দুর্ভাগ্যবশত এ যাবৎ এই একটিই কাব্যগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়েছে।
আলোচ্য গ্রন্থের অভ্যন্তরে যাবার পূর্বেই আছে বিশিষ্ট লেখক মানিক দাসের চার পৃষ্ঠা জোড়া ‘গৌরচন্দ্রিকা’ যেখানে আছে গ্রন্থের স্বকৃত চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে বিমলেন্দুর কবিতায় প্রবেশ করলে যে অনুভব অনুভূত হয়ে সেই প্রেক্ষিতে বলা চলে এই গ্রন্থের নির্যাস মূলত যদিও মা তবু রয়েছে আরোও বেশ কিছু বিষয় বা অনুষঙ্গ যেগুলো ফিরে এসেছে বারংবার, নানা কবিতার শরীরে। এমনি উল্লেখযোগ্য কিছু অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রেম, মেঘালয়, ব্রহ্মপুত্র, লুইত, বিহু, প্রতিবাদ, মেঘ, ভাটিয়ালি, উনিশ আদি। অর্থাৎ সার্বিক অবলোকনে আলোচ্য গ্রন্থটি এক বহুমুখী সত্তার প্রকাশ। এবং এটাই সব কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাধারণ বিন্যাস। বিমলেন্দুও এর বাইরে নন। তাঁর কবিতায় ফিরে আসে তাঁর যাপনকালের অনুষঙ্গ, যাবতীয় প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি এবং অনুভবের যাবতীয় প্রকাশমানতা, মনের অন্দরে লুকিয়ে থাকা ভাবনার প্রকাশ। বোমা বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি সমবেদনার পাশাপাশি উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ।
বোধসঞ্জাত ভাবনাবৈচিত্রে এবং সবচেয়ে বড় যে কথাটি হল শব্দের কারুময় প্রতিস্থাপনে কবির অধিকাংশ কবিতা স্থাপিত হয়েছে স্বীয় মর্যাদায়। কিছু কবিতায় যে এই শব্দসুষমার প্রতিস্থাপন কোনও এক জায়গায় এসে বাধাপ্রাপ্ত কিংবা লীন হয়েছে তাও অস্বীকার্য নয়। তবু বিমলেন্দুর কবিতা পাঠ করলে অনুধাবন করা যায় যে প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত যত্ন সহকারে স্থাপন করেছেন তিনি। পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে যে একেবারেই হাঁটেননি তাও কিন্তু নয়। ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা কিংবা আদিখ্যেতা হয়তো তিনি দেখাননি তবে শব্দসুষমায় যে এক স্বত:স্ফুর্ত ছন্দের স্বয়ংক্রিয় অবতারণা হয় সেই প্রমাণটি খুঁজে পাওয়া যায় একের পর এক কবিতায়। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে তাঁর ‘আমার স্বর্গ’ শীর্ষক কবিতার কিছু পঙ্ক্তি -
…সেই সব দিনে,
অশোকের ফুল ঝরে অনাবিল,
নারিকেলের পাতা বেয়ে মৃত্তিকা রোদ
সাজালো সন্ন্যাসী বেশে তোমাকে
শেষের দিনে;
তোমার নিথর শরীর তুলসীতলায়
নিমের পাতার মহুয়া বাতাস -
বৈশাখ দুপুরে…
এমন ধারা বয়ে চলেছে বিশেষোল্লেখে রাখা
কয়েকটি কবিতা জুড়ে -
প্রতিশিশু, ভুল, স্মৃতির
রাত্রি, ওয়ার্ডস লেক, রামধনু উপহার,
আবর্তন, একদিন সহসা, গুয়াহাটির
চিঠি, কেমন আছি ইত্যাদি। গ্রন্থনাম অনুযায়ী মা বিষয়ক কবিতাগুলোর
মধ্যে রয়েছে মা এই আকাশে,
তুমি আছো আলোকলোকে, মা, সবার
মা, মা তুমি আকাশ ইত্যাদি। প্রতিটি কবিতায় শব্দসুষমার এক অনবদ্য
প্রয়োগ দেখা যায় যা পাঠক হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে এক অনাবিল অনুভব। শব্দসুষমায় হারিয়ে যায় ছন্দের চাহিদা। মেঘচিঠি কবিতায় আছে -
… তোমার চিবুক লজ্জায়
উজ্জ্বল
ঘাসনরম ভেজা চুল, ঠাকুরঘর
ধুপের গন্ধ একাকী বাড়ে দূরত্ব
পাইনের ছায়াগুলি সরে সরে
যায়, বেলা যায়, শিশির অশ্রু
আমাকে শেখায় সংলাপ নির্বাক…
সময় এক চোরাস্রোত, চলে যায়
পশ্চিমে অপরাহ্নবেলা, নীড়
চঞ্চল হয় পাখির কলরবে
চাঁদের তরল নিলাম ভরে কলমে
আমাকে নিয়ে যাব তোমার কাছে…
এই শাব্দিক উপস্থাপনায় ছন্দ এসে স্বেচ্ছায়
ধরা দেয় ছন্দহীনতার মাঝেই। এখানেই কবির সার্থকতা।
একদিকে যেমন শুদ্ধ বানান, অপরূপ ভাষা মাধুর্য এবং অসাধারণ শব্দ-দ্যোতনার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় অন্যদিকে তেমনি কিছু দ্বৈতশব্দকে ভেঙে পরবর্তী পঙ্ক্তিতে স্থাপনে সেই শব্দদ্যোতনার ক্ষয়ও উপলব্ধি করা যায় - যেমন মেঘ/দেবতা, মেঘ/মেঘ খেলা ইত্যাদি। কবিতা ও আমি শিরোনামে ২ ও ৩ থাকলেও ১ নেই। রয়েছে কিছু অনর্থক যতিচিহ্নও। এই সব কিছু টেকনিক্যালিটিকে সরিয়ে রাখলে প্রথম প্রয়াসে বিমলেন্দু নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন এ কথা বলা যায় হলফ করে।
গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর প্রকাশিত ৬৪ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘দাদাভাই ও ঠাম্মন’কে। ভেতরের ছাপা, অক্ষরবিন্যাস যথাযথ। পাকা বাঁধাইয়ের গ্রন্থটির প্রাসঙ্গিক ও নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে দীপংকর কর। সব মিলিয়ে এক সহজ ও শৈল্পিক কবিতার পাঠযোগ্য সংকলন - মা তুমি আকাশ।
অসীম প্রতীক্ষায় পথের বাঁকে
ভেজা শাড়িতে, হ্যারিকেন হাতে
জননী আমার। (কবিতা - মা)
কিংবা -
...আমার আকাশ ছিল মায়ের আঁচল
ডানহাত নাকি পক্ষাঘাতে
অবশ তোমার
যে হাত সাজাত নবান্নের উৎসব
প্রকৃতির সংজ্ঞারূপ তোমরা সেই নারী
আসো বারবার
যে যাই বলুক দাঁড়িয়ে শিয়রে
সয়েছ সংসার তাপ একা ও নীরবে...
তোমার আরোগ্য আনুক ফুলের সৌরভ
এবার নিজেরাই সাজাবে নবান্নের উৎসব। (কবিতা - মা এই আকাশে)।
মা বিষয়ক এবং মাতৃবিষয়ক একগুচ্ছ কবিতার সমাহার কবি বিমলেন্দু চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘মা তুমি আকাশ’। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর কবি বিমলেন্দু নিজেকে জারিত করে তুলেছেন উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠায়। কুশিয়ারা থেকে মহাবাহু বিস্তৃত তাঁর কাব্যচারণ ভূমি। কবি আজ কবিতার উত্তরপূর্বে নিজেকে করে তুলেছেন অপরিহার্য যদিও দুর্ভাগ্যবশত এ যাবৎ এই একটিই কাব্যগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়েছে।
আলোচ্য গ্রন্থের অভ্যন্তরে যাবার পূর্বেই আছে বিশিষ্ট লেখক মানিক দাসের চার পৃষ্ঠা জোড়া ‘গৌরচন্দ্রিকা’ যেখানে আছে গ্রন্থের স্বকৃত চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে বিমলেন্দুর কবিতায় প্রবেশ করলে যে অনুভব অনুভূত হয়ে সেই প্রেক্ষিতে বলা চলে এই গ্রন্থের নির্যাস মূলত যদিও মা তবু রয়েছে আরোও বেশ কিছু বিষয় বা অনুষঙ্গ যেগুলো ফিরে এসেছে বারংবার, নানা কবিতার শরীরে। এমনি উল্লেখযোগ্য কিছু অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রেম, মেঘালয়, ব্রহ্মপুত্র, লুইত, বিহু, প্রতিবাদ, মেঘ, ভাটিয়ালি, উনিশ আদি। অর্থাৎ সার্বিক অবলোকনে আলোচ্য গ্রন্থটি এক বহুমুখী সত্তার প্রকাশ। এবং এটাই সব কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাধারণ বিন্যাস। বিমলেন্দুও এর বাইরে নন। তাঁর কবিতায় ফিরে আসে তাঁর যাপনকালের অনুষঙ্গ, যাবতীয় প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি এবং অনুভবের যাবতীয় প্রকাশমানতা, মনের অন্দরে লুকিয়ে থাকা ভাবনার প্রকাশ। বোমা বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি সমবেদনার পাশাপাশি উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ।
বোধসঞ্জাত ভাবনাবৈচিত্রে এবং সবচেয়ে বড় যে কথাটি হল শব্দের কারুময় প্রতিস্থাপনে কবির অধিকাংশ কবিতা স্থাপিত হয়েছে স্বীয় মর্যাদায়। কিছু কবিতায় যে এই শব্দসুষমার প্রতিস্থাপন কোনও এক জায়গায় এসে বাধাপ্রাপ্ত কিংবা লীন হয়েছে তাও অস্বীকার্য নয়। তবু বিমলেন্দুর কবিতা পাঠ করলে অনুধাবন করা যায় যে প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত যত্ন সহকারে স্থাপন করেছেন তিনি। পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে যে একেবারেই হাঁটেননি তাও কিন্তু নয়। ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা কিংবা আদিখ্যেতা হয়তো তিনি দেখাননি তবে শব্দসুষমায় যে এক স্বত:স্ফুর্ত ছন্দের স্বয়ংক্রিয় অবতারণা হয় সেই প্রমাণটি খুঁজে পাওয়া যায় একের পর এক কবিতায়। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে তাঁর ‘আমার স্বর্গ’ শীর্ষক কবিতার কিছু পঙ্ক্তি -
অশোকের ফুল ঝরে অনাবিল,
সাজালো সন্ন্যাসী বেশে তোমাকে
শেষের দিনে;
নিমের পাতার মহুয়া বাতাস -
ঘাসনরম ভেজা চুল, ঠাকুরঘর
পাইনের ছায়াগুলি সরে সরে
যায়, বেলা যায়, শিশির অশ্রু
চাঁদের তরল নিলাম ভরে কলমে
আমাকে নিয়ে যাব তোমার কাছে…
একদিকে যেমন শুদ্ধ বানান, অপরূপ ভাষা মাধুর্য এবং অসাধারণ শব্দ-দ্যোতনার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় অন্যদিকে তেমনি কিছু দ্বৈতশব্দকে ভেঙে পরবর্তী পঙ্ক্তিতে স্থাপনে সেই শব্দদ্যোতনার ক্ষয়ও উপলব্ধি করা যায় - যেমন মেঘ/দেবতা, মেঘ/মেঘ খেলা ইত্যাদি। কবিতা ও আমি শিরোনামে ২ ও ৩ থাকলেও ১ নেই। রয়েছে কিছু অনর্থক যতিচিহ্নও। এই সব কিছু টেকনিক্যালিটিকে সরিয়ে রাখলে প্রথম প্রয়াসে বিমলেন্দু নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন এ কথা বলা যায় হলফ করে।
গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর প্রকাশিত ৬৪ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘দাদাভাই ও ঠাম্মন’কে। ভেতরের ছাপা, অক্ষরবিন্যাস যথাযথ। পাকা বাঁধাইয়ের গ্রন্থটির প্রাসঙ্গিক ও নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে দীপংকর কর। সব মিলিয়ে এক সহজ ও শৈল্পিক কবিতার পাঠযোগ্য সংকলন - মা তুমি আকাশ।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ৬০ টাকা
যোগাযোগ - ৯১২৭০৫৬৪৮৪
Comments
Post a Comment