– এ তো দারুণ হবে কাকু। আমি ভাবতেই পারছি না। তুমি কবে আসছ ?
মোবাইলের ও প্রান্তে খুবই উত্তেজিত শোনাচ্ছে জয়ন্তকে - আমি সব ব্যবস্থা করব। শুধু কী করতে হবে বলে দিও আমাকে। তুমি কোন চিন্তা করো না।
আশ্বস্ত করে জয়ন্ত। তবু চিন্তা আর স্বপ্নেরা এসে ভিড় করে মস্তিষ্কে। অলকেশ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়কে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন জনসমক্ষে। পরিকল্পনা নিখুঁত হওয়া দরকার। এমনিতেই অলকেশ সব ব্যাপারে অত্যন্ত ফিটফাট। প্রথম জীবনের কিছু উপদেশ, কিছু সিদ্ধান্ত মাথায় ঢুকে যায় চিরদিনের জন্য। এই ফিটফাট থাকার ব্যাপারটাও তেমনি। তখন নতুন চাকরিতে জয়েন করেছেন অলকেশ। প্রথম যৌবনের প্রজাপতির পাখনা মেলার দিন তখন। যৌবনের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে সাকার করার তাগিদ একদিকে আর অন্য দিকে পরিবর্তিত দেহরূপ নিয়ে নিত্যদিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা। সদ্য গজানো গোঁফ দাড়ি নিয়ে বিস্ময়মাখা এক অহংকার। একদিন সাইট ডিউটিতে উচ্চপদস্থ অফিসার এসেছেন পরিদর্শনে। তাঁর কথা আগেই শুনেছে অলকেশ। ভীষণ রকমের পরিপাটি। কাজের ব্যাপারে সব কিছু নিখুঁত হওয়া চাই। সেভাবেই তৈরি হয়ে আছে অলকেশ। বিগত বেশ ক’টি রাত জেগে কাগজ পত্রের কাজ যথাসম্ভব গুছিয়ে রেখেছে। সাইটের ব্যবস্থাপনাও ঠিকঠাক মতো করার নির্দেশ দিয়ে নিজে দেখে এসেছে গিয়ে। তবু ভিতরে ভিতরে এক চাপা উত্তেজনা থেকেই যায়। কোথাও কিছু ত্রুটি থেকে যায়নি তো ?
যথাসময়ে শেষ হলো পরিদর্শন। অফিসার অলকেশের কাজে এবং ব্যবস্থাপনায় তৃপ্ত। কাছে ডেকে বললেনও সে কথা - যতটুকু সম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ছে অলকেশের। আগেও এমনটা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপ ধরে রাখার পর এমন একটি সফল সমাপনে দেহমন ফুরফুরে হয়ে ওঠে সাময়িক। ইচ্ছে হয় যেন খানিক উড়ে বেড়াই আকাশ জুড়ে। কিন্তু এবার সব শেষে যে কথাটি বললেন অফিসার সেই একটি কথা যেন তিরের মতো গেঁথে রইল অলকেশের বুকে - আজীবন।
– অলকেশ, কাজ যথাযথ এগোচ্ছে। আমি স্যাটিস্ফাইড। এভাবে যেন বজায় থাকে কাজের ধারা। আর কাজে যেন দেরি হয় না এ কথাটি কন্ট্রাক্টরদের বলে দিও ভালো করে। সময়ের কাজ সময়ে শেষ হওয়া চাই। আর হ্যাঁ, একটি ব্যক্তিগত কথা বলি তোমাকে। তোমার সুপুরুষ-সুলভ চেহারা। নতুন চাকরি। চেষ্টা করবে সব সময় ফিটফাট থাকতে। এই যে ক’দিনের না কামানো দাড়ি, এ তোমার চেহারা এবং চাকরির সঙ্গে মানানসই হয়নি মোটেও। কথাটা খেয়াল রেখো। আশা করি অন্যভাবে নেবে না।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল অলকেশ। এক
বার গালে হাত বুলিয়ে মনে হলো যেন বেয়াড়া দাড়িগুলো তাকে নিমেষে পথের ভিখারি বানিয়ে
ছেড়ে দিয়েছে। এবং সেই এক শুরু। সারাটি জীবন শুধু বেশভূষায় নয় - কথায়, কাজেও
ফিটফাট থাকতে সচেষ্ট থেকেছেন অলকেশ। আজও মনে মনে অন্তরের অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান সেই
নমস্য ব্যক্তিত্বের প্রতি।
আজ দু’দিন হলো নিজেই সবকিছু
তদারকি করবেন বলে চলে এসেছেন অলকেশ তাঁর পৈতৃক গ্রাম চন্দ্রপুরে। গ্রামে পা রাখা
অবধি চব্বিশ ঘণ্টা জুড়ে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন এক আকাশছোঁয়া নস্টালজিয়ায়। প্রতিটি
পদক্ষেপে, প্রতিটি কথায় অবারিত স্মৃতিকথারা এসে ভিড় জমায় অন্তরে। বিশেষ করে
প্রতিটি মুহূর্তে পরলোকগত মা ও বাবার স্মৃতি এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে
অলকেশকে। প্রতিনিয়ত তাঁদের অ-শরীরী উপস্থিতি অনুভব করতে পারছেন অলকেশ। যেদিকে তাকান
সেদিকেই ভেসে ওঠে তাঁদের ছবি। রাস্তায় বেরোলেই -
– অলক না ?
কিংবা - কাকু ? জেঠু ?
অবাক হয়ে যান অলকেশ। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়ও এই মানুষগুলো এবং তাঁদের সন্তানসন্ততিরা তাঁকে কেমন মনে রেখেছেন। সবার সাথে তাঁর শেকড়ের সম্পর্ক। ইচ্ছে হয় দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন অনন্ত সময় ধরে। কিন্তু প্রথমত তাদের সবাইকে এখন আর চিনতে পারছেন না অলকেশ। লজ্জার মাথা খেয়ে তাই জিজ্ঞেস করতেই হয় পরিচয়। এবং পরিচয় পেতেই যেন গুচ্ছ স্মৃতি এসে আঁকড়ে ধরে আপাদমস্তক। এদিকে হাতে সময়ও নেই বেশি। দু’দিন পরই এখানে, অনাদরে পড়ে থাকা তাঁর জন্মভিটেয় অনুষ্ঠিত হবে তাঁর স্বপ্নের গ্রন্থ উন্মোচন অনুষ্ঠান। ষাটোর্ধ্ব অলকেশ তাঁর সারা জীবনের আয়াসলব্ধ অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে তুলে এনেছেন রত্নখচিত স্মৃতির টুকরো টুকরো কোলাজ। যে কোলাজের একটি মোটা অংশ নিরবচ্ছিন্নভাবে অধিকার করে আছে এই গ্রাম, এই গ্রামের হারিয়ে যাওয়া চরিত্রগুলো, এই ভিটে আর তাঁর হারানো শৈশব, যৌবন। ছোট বড় সেই সব অভিজ্ঞতাকে, যাপিত কথাকে গল্পের মোড়কে সাজিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর একুশটি ছোটগল্পের সংকলন ‘ঘুড়ি মন’।
জয়ন্ত অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। জয়ন্তদের ঘর হচ্ছে অলকেশের জন্মভিটের পাশের ঘরটি। সেখানেই উঠেছেন অলকেশ। জয়ন্ত অন্য কিছু ভাবার অবকাশ রাখেনি। বয়সে বহু ছোট জয়ন্ত যেন আজ অলকেশের আগমনে হয়ে উঠেছে উদ্ভাসিত। সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলেছে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। চোখে চোখে রাখছে সবাই মিলে অলকেশকে। সে অর্থে অলকেশের বলতে গেলে করার মতো আর তেমন কিছুই নেই। সবাইকে নিমন্ত্রণপত্রও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে একবার গ্রামটি দেখতে বেরোলেন অলকেশ।
তাঁর শৈশবের, কৈশোরের যাত্রাপথের পরিক্রমার শুরুতেই উত্তর অভিমুখে সহপাঠী বন্ধু খোকন আর প্রদ্যুম্নের বাড়ির দিকে এগোলেন। এখনও শীতের সকালে আগেরই মতো ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয় চারপাশ। এখনো পথার ধারের গুল্মলতায় চতুর মাকড়সার পাতা ফাঁদে আটকে থাকা শিশিরবিন্দুতে প্রতিফলিত হয় প্রথম সকালের রবিকিরণ। মনে পড়ে গ্রামের লোক প্রদ্যুম্নের নাম উচ্চারণ করতে পারত না। বলত - পদন্য। সেদিকেই - আজও বয়ে চলেছে সেই ছোট্ট জলধারা যার উপর দিয়ে হাতলবিহীন শুধু মাত্র এক-বাঁশের সাঁকো পেরোতে শিখেছিলেন অলকেশ। অথচ কী অবাক কাণ্ড, একদিনও পড়ে যাননি নীচে। আজও কথাটা ভেবে শিউরে উঠলেন। তেমনি আছে সব কিছু। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এখনও এখানে। মনটা খুশিতে ভরে উঠল অলকেশের। এর পর পুবে মোড় নিয়ে সন্ন্যাসী টিলার নিচ দিয়ে সোজা গ্রামের সেই পাঠশালাটির কাছাকাছি পৌঁছতেই আবারও একবার স্মৃতির ভারে আক্রান্ত হয়ে উঠলেন শিশিরস্নাত অলকেশ। স্কুলঘরটি বদলে গেছে এখন। সেই কাঁঠালগাছটিও আর নেই যার তলায় দাঁড়িয়ে জীবনের প্রথম ছবি আঁকতে শিখেছিলেন একটি কাঁঠাল পাতার। সেই বারান্দাটিও একই রকম নেই আর - যেখানে দাঁড়িয়ে সুর ধরে নামতা পাঠ করতে শিখেছিলেন - এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই ......। সেই অঙ্ক আজও কষে চলেছেন নিরলস। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের সব শিক্ষক শিক্ষিকার ছবি। চোখের সামনে এসে দাঁড়ালেন জ্যেঠিমা, জয়ন্তের ঠাকুমা - যাঁর হাত ধরে বিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করেছিলেন একদিন। ভেসে এল সেইসব বালক বেলার সহপাঠী বন্ধু বান্ধবীর ছবিও। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন অলকেশ। মালার মৃত্যু হয়েছে। তাপুর খবর নেই। খবর নেই নমিতা, বুলবুলেরও। তবে পাওয়া গেছে ইসলামকে। এত দিন রিকশা চালাত ইসলাম। পড়াশোনা সেই প্রাথমিক স্তর পর্যন্তই। এখন নাকি কিছুই করে না। চলে গেছে এ গাঁ ছেড়ে আরোও দূরে ভিন গাঁয়ে। রিকশা চালাতে চালাতে পায়ের পেশিতে টান ধরে শয্যাশায়ী ছিল বহু দিন। সেই থেকে ঘরবন্দি। গরিবির অভিশাপে ক্লিষ্ট ইসলাম দুস্থ জীবন যাপন করছে কোনওক্রমে। অলকেশের নিমন্ত্রণ পৌঁছে গেছে তার কাছেও। জয়ন্ত বলেছে ইসলাম আসবে অনুষ্ঠানে। অভিভূত অলকেশ। ইচ্ছে আছে ইসলামের হাতে তুলে দেবেন এদিনের বইবিক্রির পুরো টাকাটা।
বিদ্যালয় এখন নতুন সাজে সেজে উঠেছে। ঘর-বারান্দা পাকা হয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া। কিন্তু জয়ন্ত বলছিল - এখন আর আগের মতো ছাত্র নেই বিদ্যালয়ে। অনেকগুলো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খুলেছে এখানে। সেখানেই আজকাল ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। চোখ সার্থক হলেও মন খারাপ হয়ে গেল অলকেশের। স্মৃতিরা হারিয়ে গেলে যেমন হয়।
নাহ্। অনেক সময় হয়েছে বেরিয়েছেন। এবার ফেরা যাক। ফিরে আসার পথে হঠাৎ -
– দাদা, কবে এসেছ ?
চিনতে পারছেন না অলকেশ। বুঝতে পেরে মধ্যবয়স্ক লোকটি বলে -
– আমি তোমার রমেনকাকার ছেলে।
– ময়না ? চকিতে নামটি মনে পড়ে গেল। কিছুটা অবাকই হলেন বটে অলকেশ।
– হ্যাঁ। কাল নাকি তোমার বই বেরোবে ? শুনেছি আমি।
– হ্যাঁ রে ময়না। আসিস কাল। কাকিমার খবর কী ?
অলকেশের সারাটি হৃদয় জুড়ে এখন রমেনকাকার ছবি। এই একটি মানুষ ছিলেন, যাঁর প্রত্যক্ষ মদত না থাকলে সুস্থ ভাবে খেয়ে পরে বাঁচার পথ বহু বিঘ্নিত হতো এক সময়। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মন।
– মা বিছানায় দাদা। বয়স হয়েছে তো। একবার এসো আমাদের বাড়ি।
– সময় পেলে নিশ্চয় যাব রে ময়না। দেখছিস তো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে আছি। আসিস কিন্তু কাল।
কথায় সায় দিয়ে মাথা নেড়ে এগোয় ময়না। ধীরে ধীরে ফিরে আসেন অলকেশ। দু’জন মজদুর কাজ করছে সকাল থেকে। জয়ন্ত একটু বেরিয়েছে কাজে। অলকেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন কালকের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কাজ।
নীচের সমতল জায়গাটিও অলকেশদেরই। সেখানেই কাল বিকেলে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। কাল সকালেই প্যান্ডেল তৈরি হয়ে যাবে। জায়গাটা কেটেকুটে সমান করা হয়েছে। মাথার উপর ত্রিপল থাকবে। পিছনে হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা।
এখান থেকে সোজা উপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রায় তিরিশটির মতো সিঁড়ি হবে। তবে এ কংক্রিটের সিঁড়ি নয়। মাটির খাঁজ কেটে কেটে তৈরি করা প্রশস্ত সিঁড়ি। যে কোনও সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে জিরোনো যায় খামিকটা সময়। অনেকটা মূল সিঁড়ির আদল দিতে সচেষ্ট থেকেছে মজদুররা জয়ন্তের নির্দেশ মতো। সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে যেখানটায় সেখানেই, একেবারে অলকেশের জন্মভিটের উপরেই করা হয়েছে মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন। সব কিছু অলকেশের পরিকল্পনামাফিক এবং জয়ন্তের নির্দেশ মতো। ইতিমধ্যে তিন দিক স্ক্রীণ দিয়ে ঘেরাও করে অনুষ্ঠানস্থলী বলতে গেলে তৈরি হয়েই গেছে। কাল শুধু কার্পেটটি বিছিয়ে টেবিল চেয়ার বসালেই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে আয়োজন। এর আগেও অনেক বই উন্মোচন হয়েছে অলকেশের। কিন্তু এবারের আয়োজন অনেকটাই অভিনব বটে। পুরোটাই অলকেশের মস্তিষ্কপ্রসূত। কোথাও যেন এক দায়বদ্ধতার, কৃতজ্ঞতার আকাংক্ষা। ইচ্ছেপূরণের স্বপ্ন - কিংবা স্বপ্নপূরণের আয়োজন।
অলকেশ ধীরে ধীরে উঠতে লাগলেন
সিঁড়ি ধরে। প্রথমেই বাঁদিকে ছিল পুরুষ্টু হরীতকীর গাছ। নেই। এরপর বাড়ির গৌরব কদমের
বিশাল বৃক্ষ। নেই আজ সেও। উদাস হয়ে গেলেন অলকেশ। মা ও বাবার সাথে হারিয়ে গেছে
তাঁদের সব দোসররাও। বর্ষার আগমন বার্তা পেলেই কেমন শোভায় সৌরভে ফুলেফেঁপে উঠত
কৃষ্ণসখা কদম। আজ সবাই গত। নাহয় কোথাও একাকী দাঁড়িয়ে স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। অলকেশ গিয়ে দাঁড়ালেন ভিটের উপর।
মুহূর্তে হারিয়ে গেলেন স্মৃতির আড়ালে। যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন সব কিছু। ওই তো মা বসে রয়েছেন উনুনের
সামনে। এখনই খেতে বসবেন অলকেশ। বাবা বসে আছেন বারান্দায়। ‘বুড়ি’ গাই নতুন বাচ্চা
দিয়েছে। তার জন্য পাটের রশি দিয়ে ‘পাগা’ বানাচ্ছেন বসে বসে। হাঁটতে গিয়েই থমকে
গেলেন সতর্ক অলকেশ। না, ওখান দিয়ে যাওয়া যাবে না। ওখানে ঠাকুরঘর ছিল। ভগবানের
আসনের পাশেই ছিল দিদির খাট। এই তো পাশেই বারান্দার একটা অংশ জুড়ে ছিল দাদার পড়ার
ঘর। দাদার চাকরি হয়ে যাওয়ার পর সেটা তাঁর হেফাজতে এসে গিয়েছিল স্বাভাবিক
প্রক্রিয়ায়। সদ্য কৈশোর পেরোনো অলকেশের সেই এক চিলতে ঘরের পড়ার টেবিলের কত বিচিত্র
স্মৃতি।
নাহ্। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো ঠিক হবে না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন অলকেশ। উপর দিয়েই জয়ন্তদের ঘরে যাওয়ার রাস্তা। এখনও আছে আগেরই মতো। সেই রাস্তা ধরে সেখানে গিয়ে উঠলেন অলকেশ। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। অপেক্ষমান জয়ন্তর স্ত্রী অম্পি। খেয়েদেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিতে হবে। অনেকটা ধকল গেছে আজ। কাল তো আরো অনেক ধকল সইতে হবে। দৌড়ঝাঁপের ইচ্ছে হলেও বয়েসের কথা মনে রেখে নিবৃত্ত করতে হয় নিজেকে। এখন বিকেল।
###
পরদিন সকাল হতেই ভিতরে ভিতরে এক চাপা উত্তেজনা অলকেশের। দূর দূরান্ত থেকে অতিথিরা আসবেন। তাঁদের সঠিক আপ্যায়ন হওয়া চাই। দায়িত্ব নিয়েছে জয়ন্ত আর অলকেশের বালক বেলার বন্ধু রঞ্জন। রঞ্জন তাঁর সহপাঠী ছিল না। বলা যায় পাড়াতুতো বন্ধু। খবর পেয়ে গত সন্ধ্যায় রঞ্জন এসেছিল একবার। এরপর থেকেই দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়েছে আসরে। বিকেল তিনটেয় অনুষ্ঠান। শীতের বিকেল। সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। ছ’টার মধ্যে সবকিছু গুটিয়ে ফেলতে হবে। দুপুরের মধ্যেই আপ্যায়নের জায়গা আর অনুষ্ঠানস্থলী পুরোপুরি তৈরি। জয়ন্ত আর রঞ্জন এক্কেবারে পারফেক্ট কাজ করেছে। কোথাও কোন ত্রুটি রাখেনি। জন্মভিটের উপর টেবিলের উপর এনে রাখা হয়েছে নতুন বইয়ের একাধিক প্যাকেট। প্যাকেট খুলে জয়ন্তর ছেলে জিৎ বইগুলো সাজিয়ে রাখবে যথাসময়। বই গোছানোর দায়িত্ব পেয়ে জিৎ যথেষ্ট উত্তেজিত। ছোট্ট বোন অস্মিকে সাথে নিয়ে ঘুরঘুর করছে তখন থেকে। একটু পর পরই গিয়ে জিজ্ঞেস করছে -
– বাবা, খুলব প্যাকেট ?
– না, না এখন নয়। সময় হলে বলব।
– কখন সময় হবে ?
জয়ন্ত হাতের ইশারায় তাকে নিরস্ত করে সাময়িক। দেখতে পেয়ে অলকেশ বললেন -
– কী দাদুভাই ? কী বলছিলে ?
– দাদু, প্যাকেট কখন খুলব ? সাজিয়ে রাখতে হবে না ?
– আমি বলব দাদুভাই। বইগুলো দেখতে খুব ইচ্ছে করছে বুঝি ? কিন্তু এ বই তো তুমি এখনও পড়ে উঠতে পারবে না। এ তো বড়দের বই। তবে তোমাকেও একটা বই দেব। আরোও একটু বড় হয়ে পড়বে। কেমন ?
জিৎ যেন দমে গেল খানিকটা। নজর এড়াল না অলকেশের। তার উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে যেন এক টুকরো কালো মেঘের ছায়া ক্ষণিকের জন্য হলেও দেখতে পেলেন অলকেশ। মনে মনে ভাবলেন কেন যে ছাই একটাও শিশু সাহিত্যমূলক বই আজও লিখে উঠে পারলেন না। কিংবা বলা যায় সেভাবে ভাবেনওনি কোনোদিন। আজ অলকেশের পনেরোতম গ্রন্থের উন্মোচন। অথচ এর মধ্যে একটিও শিশুদের পড়ার বই নেই। নিজের উপরে খানিকটা বিরক্তই হলেন অলকেশ।
জয়ন্ত অলকেশের কাছে এগিয়ে এসে বলল -
– কাকু। দু’একজন করে আসতে শুরু করেছেন। আমার মনে হয় আমরা নীচে চলে যাই। সবাই এলে একসাথে উপরে উঠে আসব।
– হ্যাঁ, তাই চলো জয়ন্ত।
সিঁড়ি ধরে নীচে নামতে লাগলেন অলকেশ। পাশে সতর্ক জয়ন্ত। আজ ডিউটি থেকে ছুটি নিয়েছে। আজ জয়ন্তর বড় গর্বের দিন। এই অলকেশ কাকুর প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই জয়ন্তদের। ছোট থাকতে কত কিছু শিক্ষা যে পেয়েছে তাঁর থেকে। গর্বিত শুধু জয়ন্ত নয়। আজ গর্বিত গোটা গাঁয়ের লোক। সবার কাছে পৌঁছে গেছে খবর। গাঁয়েরই ছেলে, আজকের বিশাল মাপের সাহিত্যিক, সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত অলকেশের বই আজ উন্মোচিত হবে তাঁরই জন্মভিটেয়। এ সম্মান সারা গাঁয়ের। এই শুভ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকতে চায় তাই সবাই।
লোকজন আসতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যে। চমৎকার আবহাওয়া। শীতের শেষ দুপুরে গরম রোদের আমেজ। চারদিকে সবুজের সমারোহ। পাতা ঝরার দিন সমাগত। সদ্য কাটা ধানি গন্ধে ভরপুর চরাচর। গাঁয়ের কৃষকদের এখন অফুরান অবসর। তাঁরাও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছেন এদিকে। এক ঝাঁক বিশিষ্ট সাহিত্যিকরাও আজ আমন্ত্রিত আজকের অনুষ্ঠানে। প্রথমেই একটি গাড়িতে করে এলেন পাঁচজন বরিষ্ঠ লেখক। এঁরা সবাই অলকেশের বিশেষ পরিচিত। গাড়ি থেকে নেমেই জড়িয়ে ধরলেন অলকেশকে। বহুদিন পর দেখা। অলকেশ অভিভূত। সবাইকে নিয়ে বসানো হলো নির্দিষ্ট জায়গায়। এর পর একে একে প্রায় সবাইই এসে পৌঁছে গেলেন। আশেপাশের অঞ্চল থেকেও এসেছেন অনেকে খবর পেয়ে। অলকেশের কিছু বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজনরাও এসেছেন। বসে চা মিষ্টি খাচ্ছেন অনেকেই। গল্পগুজবে মশগুল অলকেশ এবং আগত অতিথিবৃন্দ। কেউ কেউ আবার অস্থায়ী প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে গ্রামের সবুজাভায় সার্থক করে নিচ্ছেন দু’চোখ। পাশেই একটি পুকুর। পুকুর পাড়ে নীলাভ দাঁতরাঙার অগুনতি গুল্ম। বাসরাস্তা থেকে অলকেশদের বাড়ি অবধি গ্রামের রাস্তার দু’ধারেও থোকা থোকা ফুটে রয়েছে দাঁতরাঙা - অলকেশের শৈশবের লুটকি। এই ফুল যেন এই গ্রামটির শোভা হয়ে থাকত বছরের একটা সময়। স্কুলে আসতে যেতে পেড়ে নিত একের পর এক ফুল।
অলকেশের মনে পড়ছিল ইসলামের কথা। কিন্তু আসেনি ইসলাম। একগাদা বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী এসে জড়ো হয়েছে। কাউকেই চেনার কথা নয় অলকেশের। তাদের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। যেন কোনও উৎসবে শামিল হতে এসেছে। তাদের উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। অলকেশের অন্তর উৎফুল্লিত হয়ে উঠল।
কথায় কথায় জমে উঠেছে আলাপন। অলকেশের হৃদয় আজ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে প্রাপ্তিসুখে। এখানে, এই জন্মভিটেয় এ অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা আজ সার্থক হয়েছে। জীবনে যত পুরস্কার পেয়েছেন আজ যেন এই প্রাপ্তি ছাপিয়ে গেছে সেসব কিছুকে। এর থেকে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না। ঘোরাঘুরি, কথাবার্তার মধ্যেই জয়ন্ত বলল -
– কাকু, দেরি হচ্ছে। এবার সবাই উপরে চলুন।
অমনি যেন মাটিতে ফিরে এলেন অলকেশ। সবাইকে বলা হলো উপরে অনুষ্ঠানের মঞ্চে চলে আসতে। সবাই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বসে পড়লেন মঞ্চের সামনে পেড়ে রাখা চেয়ারে। মঞ্চে টেবিলের উপর যথাসময়ে সুন্দর করে প্রকাশিতব্য বইগুলো সাজিয়ে রেখেছে জিৎ। এক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে আরোও অনেকগুলো ছেলে-মেয়েদের সাথে। সবাই এখন জমায়েত হয়েছে সেই কাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠানটি উপভোগ করবে বলে। অলকেশ ধীরে ধীরে অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক্রফোনটি হাতে নিলেন। সবাই চুপ। অলকেশের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল এই ছেলেটি আজ সাহিত্যিক অলকেশ নয়, কিশোর বেলার সেই অলক শুধু। এক্ষুনি হয়তো মা এসে বলবেন - অলক কোথায় ? খেতে বোস। এখনই হয়তো দেখবে বাবাও বসে রয়েছেন সামনের কোনও এক চেয়ারে। হাসছেন মিটিমিটি।
নাহ্। এই মুহূর্তে আর ভাবতে পারছেন না অলকেশ। জোর করে হলেও বেরিয়ে আসতে হবে এ নস্টালজিয়া থেকে। এখন নিজেকে সামলে নিতে হবে ঝটিতি। বলতে শুরু করলেন অলকেশ -
– আজ আমার জীবনের একটি বিশেষ দিন। এক স্বপ্নপূরণের দিন। বহু বছর আগে এই মাটিতে, এখানেই আমার জন্ম। আমার পরলোকগত পিতামাতার আশীর্বাদধন্য এই ভিটেতেই আমার শৈশব, কৈশোর। আজকের এই বিশেষ দিনে আপনারা যাঁরা আজ এখানে বহু শারীরিক শ্রম ব্যয় করে, আপনাদের বহু মূল্যবান সময় খরচ করে এই অনুষ্ঠানে শামিল হতে উপস্থিত হয়েছেন, আপনাদের সবাইকে আমার অন্তরের উজাড় করা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক শ্রী সুমন্ত ভট্টাচার্যকে এবং নবপ্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমার অত্যন্ত প্রিয় আত্মীয়সম বালক জিৎকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এই মঞ্চে এসে আমার গ্রন্থটি উন্মোচন করতে। এই গ্রন্থে আমি এই জন্মভিটে, এই গ্রামের কথাই লিখেছি আমার অধিকাংশ গল্পের মধ্যে। আশা করি আপনাদের কাছে সমাদৃত হবে আমার এই গ্রন্থটি।
থামলেন অলকেশ। সামনের চেয়ার থেকে
উঠে মঞ্চের দিকে এগোলেন সাহিত্যিক সুমন্ত। অলকেশের আকস্মিক ঘোষণায় জয়ন্ত এবং জিৎ
স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। আবেগের আক্রমণ থেকে কোনওক্রমে নিজেকে সামলে জয়ন্ত এগিয়ে দিল
পুত্র জিৎকে। জিৎ যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াল মঞ্চে।
অলকেশ তাঁরা দু’জনের হাতে তুলে দিলেন তাঁর বহু সাধনার সঞ্চিত ধন। সাড়ম্বরে
উন্মোচিত হলো ‘ঘুড়ি মন’। সমবেত দর্শকের করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল দীর্ঘদিন ধরে
অবহেলায়, অনাদরে একাকী পড়ে থাকা ভিটেখানি। এই ভিটের সুযোগ্য সন্তানের কৃতিত্বে যেন
ধন্য হলো আজ।
অলকেশ সবাইকে আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন -
– আমার ইচ্ছে ছিল আমার বালক বেলার সহপাঠী বন্ধু ইসলামও উপস্থিত থাকবে এই মঞ্চে। কিন্তু সম্ভবত অসুস্থতার জন্য সে আসতে পারেনি। খুব মিস করছি আজ তাকে। আমার ইচ্ছে এই গ্রামের কোনো এক বালক-বালিকা আমার এই গ্রন্থের ভূমিকা আপনাদের সামনে পড়ে শোনায়। নবপ্রজন্মের মধ্যে আমি ছড়িয়ে দিতে চাই মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের আনন্দ। কে পড়বে ভূমিকা ?
অলকেশ সপাট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন উপস্থিত কচিকাঁচাদের উদ্দেশে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতে চাইছিল না। অলকেশ ভাবলেন সম্ভবত এ এক জড়তাজনিত অনিচ্ছা। তিনি জিৎ-এর দিকে তাকালেন। অপ্রস্তুত জিৎ তাকাল জয়ন্তর দিকে। জয়ন্ত এসে কানে কানে কিছু একটা বলল অলকেশকে। ভ্রু কুঞ্চিত করে অলকেশ তাকালেন অন্য সবার দিকে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। অলকেশ বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। তাঁর সামনে থেকে যেন পৃথিবীটা ক্রমে তলিয়ে যেতে থাকল গভীর এক খাদের দিকে। আজকের এই শ্রম যেন এক পণ্ডশ্রমে পরিণত হতে চলেছে। কীসের সাহিত্য রচনা করছেন অলকেশ ? কার জন্য এই আয়োজন, এই কৃচ্ছসাধন ? কে পড়বে তাঁর সাহিত্য ? মাতৃভাষায় পড়া একটিও ছেলে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া গেল না এই পাড়াগাঁয়েও। সবাই আজ ইংরেজি স্কুলের দিকে ধাবমান। মুখ ফিরিয়েছে মাতৃভাষা শিক্ষার দিক থেকে। ভাবীকালের হাতে কী সমর্পণ করে যাবেন আজকের কৃতী সাহিত্যিক অলকেশ ? হতাশায় নিমজ্জিত হতে হতে যেন ক্রমাৎ ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। এই ভবিতব্য তাঁর কাছে অকল্পনীয় মনে হতে লাগল। এ অবস্থায় তিনি যখন মাইক হাতে নিচ্ছেন কিছু বলার জন্য তখনই দেখা গেল ভিড়ের মধ্য থেকে একটি জামা পরা মেয়ে উশখুশ করতে করতে দু’পা এগিয়ে আবার এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে যেন। অলকেশের দৃষ্টি এড়াল না তা। তিনি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে -
– তুমি কিছু বলবে
মা ?
– আমি পড়ব জেঠু।
আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল মেয়েটি। চমকে উঠলেন অলকেশ। হাতে ধরে নিয়ে এলেন মঞ্চে। মেয়েটিকে বললেন -
– প্রথমে তোমার পরিচয় দাও। তার পর পড়বে। মেয়েটি অলকেশের পায়ের ধুলো নিয়ে বলল -
– নমস্কার। আমার নাম জেসমিনা। জেঠুর বন্ধু ইসলাম আমার বড় চাচা। তাঁর শরীর আজ ভালো নেই বলে আমাকে পাঠালেন এখানে। বললেন তোর জেঠুকে বলবি আমি ভালো আছি। আমি তাঁকে ভুলিনি।
আজ আমি আমার বন্ধু অতসীর সঙ্গে এখানে এসেছি। আমরা দু’জনই আমাদের গ্রাম সৈয়জানগরের মানব কল্যাণ বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমি এখন জেঠুর লিখা বই পড়ব।
আবেগে, আবেশে অলকেশ যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিলেন। সমবেত দর্শকাসনে পিন-পড়া নীরবতা। পড়তে শুরু করল জেসমিনা। অলকেশ হারিয়ে যাচ্ছিলেন মহাশূন্যে। এক মুহূর্ত আগেও যেন মনে হচ্ছিল দিগন্ত ছাপিয়ে তাঁর দিকে ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’। আবার এখন ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরে বাঁচার আশার মতো জেসমিনা যেন তাঁর দেহে তার সুকণ্ঠ পঠনে ঢেলে দিচ্ছে অমৃতসুধা। পুরো গ্রামটির মধ্যে যেখানে একটিও ছেলে-মেয়ে নেই যে বাংলা পড়তে পারে, বলতে পারে না - ‘আ-এ আমটি খাব পেড়ে’ সেখানে জেসমিনা যেন কোন দূর দেশ থেকে আসা বিদ্যাবতী দূতী হয়ে পাঠ করে চলেছে তাঁর বহু আশার গ্রন্থখানি। অলকেশ যেন সাগরের অথই জলে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ করে বেঁচে থাকার এক সম্বল খুঁজে পেয়েছেন। এই তো আছে এখনো এই জেসমিনা, অতসীরা - যারা ডুবন্ত তরীর বৈঠা হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যারা ভাবীকালকে আপন গরিমায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নেমে পড়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। এই জেসমিনাদের মতো সৈনিকদের জন্যই হয়তো বেঁচে যাবে আজকের ক্ষয়িষ্ণু ভাষা সাহিত্যের নিভন্ত বহ্নি।
ততক্ষণে সন্ধ্যার আবেশে গ্রামের
ঘর গেরস্থালিতে বেজে উঠছে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনামন্ত্র। শূন্য আকাশে ভোকাট্টা হতে
হতে আবার হাতের মুঠোয় সুরক্ষিত চলে আসে অলকেশের ঘুড়ি মন।
মোবাইলের ও প্রান্তে খুবই উত্তেজিত শোনাচ্ছে জয়ন্তকে - আমি সব ব্যবস্থা করব। শুধু কী করতে হবে বলে দিও আমাকে। তুমি কোন চিন্তা করো না।
আশ্বস্ত করে জয়ন্ত। তবু চিন্তা আর স্বপ্নেরা এসে ভিড় করে মস্তিষ্কে। অলকেশ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়কে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন জনসমক্ষে। পরিকল্পনা নিখুঁত হওয়া দরকার। এমনিতেই অলকেশ সব ব্যাপারে অত্যন্ত ফিটফাট। প্রথম জীবনের কিছু উপদেশ, কিছু সিদ্ধান্ত মাথায় ঢুকে যায় চিরদিনের জন্য। এই ফিটফাট থাকার ব্যাপারটাও তেমনি। তখন নতুন চাকরিতে জয়েন করেছেন অলকেশ। প্রথম যৌবনের প্রজাপতির পাখনা মেলার দিন তখন। যৌবনের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে সাকার করার তাগিদ একদিকে আর অন্য দিকে পরিবর্তিত দেহরূপ নিয়ে নিত্যদিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা। সদ্য গজানো গোঁফ দাড়ি নিয়ে বিস্ময়মাখা এক অহংকার। একদিন সাইট ডিউটিতে উচ্চপদস্থ অফিসার এসেছেন পরিদর্শনে। তাঁর কথা আগেই শুনেছে অলকেশ। ভীষণ রকমের পরিপাটি। কাজের ব্যাপারে সব কিছু নিখুঁত হওয়া চাই। সেভাবেই তৈরি হয়ে আছে অলকেশ। বিগত বেশ ক’টি রাত জেগে কাগজ পত্রের কাজ যথাসম্ভব গুছিয়ে রেখেছে। সাইটের ব্যবস্থাপনাও ঠিকঠাক মতো করার নির্দেশ দিয়ে নিজে দেখে এসেছে গিয়ে। তবু ভিতরে ভিতরে এক চাপা উত্তেজনা থেকেই যায়। কোথাও কিছু ত্রুটি থেকে যায়নি তো ?
যথাসময়ে শেষ হলো পরিদর্শন। অফিসার অলকেশের কাজে এবং ব্যবস্থাপনায় তৃপ্ত। কাছে ডেকে বললেনও সে কথা - যতটুকু সম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ছে অলকেশের। আগেও এমনটা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপ ধরে রাখার পর এমন একটি সফল সমাপনে দেহমন ফুরফুরে হয়ে ওঠে সাময়িক। ইচ্ছে হয় যেন খানিক উড়ে বেড়াই আকাশ জুড়ে। কিন্তু এবার সব শেষে যে কথাটি বললেন অফিসার সেই একটি কথা যেন তিরের মতো গেঁথে রইল অলকেশের বুকে - আজীবন।
– অলকেশ, কাজ যথাযথ এগোচ্ছে। আমি স্যাটিস্ফাইড। এভাবে যেন বজায় থাকে কাজের ধারা। আর কাজে যেন দেরি হয় না এ কথাটি কন্ট্রাক্টরদের বলে দিও ভালো করে। সময়ের কাজ সময়ে শেষ হওয়া চাই। আর হ্যাঁ, একটি ব্যক্তিগত কথা বলি তোমাকে। তোমার সুপুরুষ-সুলভ চেহারা। নতুন চাকরি। চেষ্টা করবে সব সময় ফিটফাট থাকতে। এই যে ক’দিনের না কামানো দাড়ি, এ তোমার চেহারা এবং চাকরির সঙ্গে মানানসই হয়নি মোটেও। কথাটা খেয়াল রেখো। আশা করি অন্যভাবে নেবে না।
কিংবা - কাকু ? জেঠু ?
অবাক হয়ে যান অলকেশ। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়ও এই মানুষগুলো এবং তাঁদের সন্তানসন্ততিরা তাঁকে কেমন মনে রেখেছেন। সবার সাথে তাঁর শেকড়ের সম্পর্ক। ইচ্ছে হয় দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন অনন্ত সময় ধরে। কিন্তু প্রথমত তাদের সবাইকে এখন আর চিনতে পারছেন না অলকেশ। লজ্জার মাথা খেয়ে তাই জিজ্ঞেস করতেই হয় পরিচয়। এবং পরিচয় পেতেই যেন গুচ্ছ স্মৃতি এসে আঁকড়ে ধরে আপাদমস্তক। এদিকে হাতে সময়ও নেই বেশি। দু’দিন পরই এখানে, অনাদরে পড়ে থাকা তাঁর জন্মভিটেয় অনুষ্ঠিত হবে তাঁর স্বপ্নের গ্রন্থ উন্মোচন অনুষ্ঠান। ষাটোর্ধ্ব অলকেশ তাঁর সারা জীবনের আয়াসলব্ধ অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে তুলে এনেছেন রত্নখচিত স্মৃতির টুকরো টুকরো কোলাজ। যে কোলাজের একটি মোটা অংশ নিরবচ্ছিন্নভাবে অধিকার করে আছে এই গ্রাম, এই গ্রামের হারিয়ে যাওয়া চরিত্রগুলো, এই ভিটে আর তাঁর হারানো শৈশব, যৌবন। ছোট বড় সেই সব অভিজ্ঞতাকে, যাপিত কথাকে গল্পের মোড়কে সাজিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর একুশটি ছোটগল্পের সংকলন ‘ঘুড়ি মন’।
জয়ন্ত অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। জয়ন্তদের ঘর হচ্ছে অলকেশের জন্মভিটের পাশের ঘরটি। সেখানেই উঠেছেন অলকেশ। জয়ন্ত অন্য কিছু ভাবার অবকাশ রাখেনি। বয়সে বহু ছোট জয়ন্ত যেন আজ অলকেশের আগমনে হয়ে উঠেছে উদ্ভাসিত। সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলেছে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। চোখে চোখে রাখছে সবাই মিলে অলকেশকে। সে অর্থে অলকেশের বলতে গেলে করার মতো আর তেমন কিছুই নেই। সবাইকে নিমন্ত্রণপত্রও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে একবার গ্রামটি দেখতে বেরোলেন অলকেশ।
তাঁর শৈশবের, কৈশোরের যাত্রাপথের পরিক্রমার শুরুতেই উত্তর অভিমুখে সহপাঠী বন্ধু খোকন আর প্রদ্যুম্নের বাড়ির দিকে এগোলেন। এখনও শীতের সকালে আগেরই মতো ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয় চারপাশ। এখনো পথার ধারের গুল্মলতায় চতুর মাকড়সার পাতা ফাঁদে আটকে থাকা শিশিরবিন্দুতে প্রতিফলিত হয় প্রথম সকালের রবিকিরণ। মনে পড়ে গ্রামের লোক প্রদ্যুম্নের নাম উচ্চারণ করতে পারত না। বলত - পদন্য। সেদিকেই - আজও বয়ে চলেছে সেই ছোট্ট জলধারা যার উপর দিয়ে হাতলবিহীন শুধু মাত্র এক-বাঁশের সাঁকো পেরোতে শিখেছিলেন অলকেশ। অথচ কী অবাক কাণ্ড, একদিনও পড়ে যাননি নীচে। আজও কথাটা ভেবে শিউরে উঠলেন। তেমনি আছে সব কিছু। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এখনও এখানে। মনটা খুশিতে ভরে উঠল অলকেশের। এর পর পুবে মোড় নিয়ে সন্ন্যাসী টিলার নিচ দিয়ে সোজা গ্রামের সেই পাঠশালাটির কাছাকাছি পৌঁছতেই আবারও একবার স্মৃতির ভারে আক্রান্ত হয়ে উঠলেন শিশিরস্নাত অলকেশ। স্কুলঘরটি বদলে গেছে এখন। সেই কাঁঠালগাছটিও আর নেই যার তলায় দাঁড়িয়ে জীবনের প্রথম ছবি আঁকতে শিখেছিলেন একটি কাঁঠাল পাতার। সেই বারান্দাটিও একই রকম নেই আর - যেখানে দাঁড়িয়ে সুর ধরে নামতা পাঠ করতে শিখেছিলেন - এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই ......। সেই অঙ্ক আজও কষে চলেছেন নিরলস। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের সব শিক্ষক শিক্ষিকার ছবি। চোখের সামনে এসে দাঁড়ালেন জ্যেঠিমা, জয়ন্তের ঠাকুমা - যাঁর হাত ধরে বিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করেছিলেন একদিন। ভেসে এল সেইসব বালক বেলার সহপাঠী বন্ধু বান্ধবীর ছবিও। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন অলকেশ। মালার মৃত্যু হয়েছে। তাপুর খবর নেই। খবর নেই নমিতা, বুলবুলেরও। তবে পাওয়া গেছে ইসলামকে। এত দিন রিকশা চালাত ইসলাম। পড়াশোনা সেই প্রাথমিক স্তর পর্যন্তই। এখন নাকি কিছুই করে না। চলে গেছে এ গাঁ ছেড়ে আরোও দূরে ভিন গাঁয়ে। রিকশা চালাতে চালাতে পায়ের পেশিতে টান ধরে শয্যাশায়ী ছিল বহু দিন। সেই থেকে ঘরবন্দি। গরিবির অভিশাপে ক্লিষ্ট ইসলাম দুস্থ জীবন যাপন করছে কোনওক্রমে। অলকেশের নিমন্ত্রণ পৌঁছে গেছে তার কাছেও। জয়ন্ত বলেছে ইসলাম আসবে অনুষ্ঠানে। অভিভূত অলকেশ। ইচ্ছে আছে ইসলামের হাতে তুলে দেবেন এদিনের বইবিক্রির পুরো টাকাটা।
বিদ্যালয় এখন নতুন সাজে সেজে উঠেছে। ঘর-বারান্দা পাকা হয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া। কিন্তু জয়ন্ত বলছিল - এখন আর আগের মতো ছাত্র নেই বিদ্যালয়ে। অনেকগুলো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খুলেছে এখানে। সেখানেই আজকাল ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। চোখ সার্থক হলেও মন খারাপ হয়ে গেল অলকেশের। স্মৃতিরা হারিয়ে গেলে যেমন হয়।
নাহ্। অনেক সময় হয়েছে বেরিয়েছেন। এবার ফেরা যাক। ফিরে আসার পথে হঠাৎ -
– দাদা, কবে এসেছ ?
চিনতে পারছেন না অলকেশ। বুঝতে পেরে মধ্যবয়স্ক লোকটি বলে -
– আমি তোমার রমেনকাকার ছেলে।
– ময়না ? চকিতে নামটি মনে পড়ে গেল। কিছুটা অবাকই হলেন বটে অলকেশ।
– হ্যাঁ। কাল নাকি তোমার বই বেরোবে ? শুনেছি আমি।
– হ্যাঁ রে ময়না। আসিস কাল। কাকিমার খবর কী ?
অলকেশের সারাটি হৃদয় জুড়ে এখন রমেনকাকার ছবি। এই একটি মানুষ ছিলেন, যাঁর প্রত্যক্ষ মদত না থাকলে সুস্থ ভাবে খেয়ে পরে বাঁচার পথ বহু বিঘ্নিত হতো এক সময়। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মন।
– মা বিছানায় দাদা। বয়স হয়েছে তো। একবার এসো আমাদের বাড়ি।
– সময় পেলে নিশ্চয় যাব রে ময়না। দেখছিস তো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে আছি। আসিস কিন্তু কাল।
কথায় সায় দিয়ে মাথা নেড়ে এগোয় ময়না। ধীরে ধীরে ফিরে আসেন অলকেশ। দু’জন মজদুর কাজ করছে সকাল থেকে। জয়ন্ত একটু বেরিয়েছে কাজে। অলকেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন কালকের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কাজ।
নীচের সমতল জায়গাটিও অলকেশদেরই। সেখানেই কাল বিকেলে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। কাল সকালেই প্যান্ডেল তৈরি হয়ে যাবে। জায়গাটা কেটেকুটে সমান করা হয়েছে। মাথার উপর ত্রিপল থাকবে। পিছনে হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা।
এখান থেকে সোজা উপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রায় তিরিশটির মতো সিঁড়ি হবে। তবে এ কংক্রিটের সিঁড়ি নয়। মাটির খাঁজ কেটে কেটে তৈরি করা প্রশস্ত সিঁড়ি। যে কোনও সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে জিরোনো যায় খামিকটা সময়। অনেকটা মূল সিঁড়ির আদল দিতে সচেষ্ট থেকেছে মজদুররা জয়ন্তের নির্দেশ মতো। সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে যেখানটায় সেখানেই, একেবারে অলকেশের জন্মভিটের উপরেই করা হয়েছে মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন। সব কিছু অলকেশের পরিকল্পনামাফিক এবং জয়ন্তের নির্দেশ মতো। ইতিমধ্যে তিন দিক স্ক্রীণ দিয়ে ঘেরাও করে অনুষ্ঠানস্থলী বলতে গেলে তৈরি হয়েই গেছে। কাল শুধু কার্পেটটি বিছিয়ে টেবিল চেয়ার বসালেই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে আয়োজন। এর আগেও অনেক বই উন্মোচন হয়েছে অলকেশের। কিন্তু এবারের আয়োজন অনেকটাই অভিনব বটে। পুরোটাই অলকেশের মস্তিষ্কপ্রসূত। কোথাও যেন এক দায়বদ্ধতার, কৃতজ্ঞতার আকাংক্ষা। ইচ্ছেপূরণের স্বপ্ন - কিংবা স্বপ্নপূরণের আয়োজন।
নাহ্। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো ঠিক হবে না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন অলকেশ। উপর দিয়েই জয়ন্তদের ঘরে যাওয়ার রাস্তা। এখনও আছে আগেরই মতো। সেই রাস্তা ধরে সেখানে গিয়ে উঠলেন অলকেশ। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। অপেক্ষমান জয়ন্তর স্ত্রী অম্পি। খেয়েদেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিতে হবে। অনেকটা ধকল গেছে আজ। কাল তো আরো অনেক ধকল সইতে হবে। দৌড়ঝাঁপের ইচ্ছে হলেও বয়েসের কথা মনে রেখে নিবৃত্ত করতে হয় নিজেকে। এখন বিকেল।
###
পরদিন সকাল হতেই ভিতরে ভিতরে এক চাপা উত্তেজনা অলকেশের। দূর দূরান্ত থেকে অতিথিরা আসবেন। তাঁদের সঠিক আপ্যায়ন হওয়া চাই। দায়িত্ব নিয়েছে জয়ন্ত আর অলকেশের বালক বেলার বন্ধু রঞ্জন। রঞ্জন তাঁর সহপাঠী ছিল না। বলা যায় পাড়াতুতো বন্ধু। খবর পেয়ে গত সন্ধ্যায় রঞ্জন এসেছিল একবার। এরপর থেকেই দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়েছে আসরে। বিকেল তিনটেয় অনুষ্ঠান। শীতের বিকেল। সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। ছ’টার মধ্যে সবকিছু গুটিয়ে ফেলতে হবে। দুপুরের মধ্যেই আপ্যায়নের জায়গা আর অনুষ্ঠানস্থলী পুরোপুরি তৈরি। জয়ন্ত আর রঞ্জন এক্কেবারে পারফেক্ট কাজ করেছে। কোথাও কোন ত্রুটি রাখেনি। জন্মভিটের উপর টেবিলের উপর এনে রাখা হয়েছে নতুন বইয়ের একাধিক প্যাকেট। প্যাকেট খুলে জয়ন্তর ছেলে জিৎ বইগুলো সাজিয়ে রাখবে যথাসময়। বই গোছানোর দায়িত্ব পেয়ে জিৎ যথেষ্ট উত্তেজিত। ছোট্ট বোন অস্মিকে সাথে নিয়ে ঘুরঘুর করছে তখন থেকে। একটু পর পরই গিয়ে জিজ্ঞেস করছে -
– বাবা, খুলব প্যাকেট ?
– না, না এখন নয়। সময় হলে বলব।
– কখন সময় হবে ?
জয়ন্ত হাতের ইশারায় তাকে নিরস্ত করে সাময়িক। দেখতে পেয়ে অলকেশ বললেন -
– কী দাদুভাই ? কী বলছিলে ?
– দাদু, প্যাকেট কখন খুলব ? সাজিয়ে রাখতে হবে না ?
– আমি বলব দাদুভাই। বইগুলো দেখতে খুব ইচ্ছে করছে বুঝি ? কিন্তু এ বই তো তুমি এখনও পড়ে উঠতে পারবে না। এ তো বড়দের বই। তবে তোমাকেও একটা বই দেব। আরোও একটু বড় হয়ে পড়বে। কেমন ?
জিৎ যেন দমে গেল খানিকটা। নজর এড়াল না অলকেশের। তার উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে যেন এক টুকরো কালো মেঘের ছায়া ক্ষণিকের জন্য হলেও দেখতে পেলেন অলকেশ। মনে মনে ভাবলেন কেন যে ছাই একটাও শিশু সাহিত্যমূলক বই আজও লিখে উঠে পারলেন না। কিংবা বলা যায় সেভাবে ভাবেনওনি কোনোদিন। আজ অলকেশের পনেরোতম গ্রন্থের উন্মোচন। অথচ এর মধ্যে একটিও শিশুদের পড়ার বই নেই। নিজের উপরে খানিকটা বিরক্তই হলেন অলকেশ।
জয়ন্ত অলকেশের কাছে এগিয়ে এসে বলল -
– কাকু। দু’একজন করে আসতে শুরু করেছেন। আমার মনে হয় আমরা নীচে চলে যাই। সবাই এলে একসাথে উপরে উঠে আসব।
– হ্যাঁ, তাই চলো জয়ন্ত।
সিঁড়ি ধরে নীচে নামতে লাগলেন অলকেশ। পাশে সতর্ক জয়ন্ত। আজ ডিউটি থেকে ছুটি নিয়েছে। আজ জয়ন্তর বড় গর্বের দিন। এই অলকেশ কাকুর প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই জয়ন্তদের। ছোট থাকতে কত কিছু শিক্ষা যে পেয়েছে তাঁর থেকে। গর্বিত শুধু জয়ন্ত নয়। আজ গর্বিত গোটা গাঁয়ের লোক। সবার কাছে পৌঁছে গেছে খবর। গাঁয়েরই ছেলে, আজকের বিশাল মাপের সাহিত্যিক, সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত অলকেশের বই আজ উন্মোচিত হবে তাঁরই জন্মভিটেয়। এ সম্মান সারা গাঁয়ের। এই শুভ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকতে চায় তাই সবাই।
লোকজন আসতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যে। চমৎকার আবহাওয়া। শীতের শেষ দুপুরে গরম রোদের আমেজ। চারদিকে সবুজের সমারোহ। পাতা ঝরার দিন সমাগত। সদ্য কাটা ধানি গন্ধে ভরপুর চরাচর। গাঁয়ের কৃষকদের এখন অফুরান অবসর। তাঁরাও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছেন এদিকে। এক ঝাঁক বিশিষ্ট সাহিত্যিকরাও আজ আমন্ত্রিত আজকের অনুষ্ঠানে। প্রথমেই একটি গাড়িতে করে এলেন পাঁচজন বরিষ্ঠ লেখক। এঁরা সবাই অলকেশের বিশেষ পরিচিত। গাড়ি থেকে নেমেই জড়িয়ে ধরলেন অলকেশকে। বহুদিন পর দেখা। অলকেশ অভিভূত। সবাইকে নিয়ে বসানো হলো নির্দিষ্ট জায়গায়। এর পর একে একে প্রায় সবাইই এসে পৌঁছে গেলেন। আশেপাশের অঞ্চল থেকেও এসেছেন অনেকে খবর পেয়ে। অলকেশের কিছু বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজনরাও এসেছেন। বসে চা মিষ্টি খাচ্ছেন অনেকেই। গল্পগুজবে মশগুল অলকেশ এবং আগত অতিথিবৃন্দ। কেউ কেউ আবার অস্থায়ী প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে গ্রামের সবুজাভায় সার্থক করে নিচ্ছেন দু’চোখ। পাশেই একটি পুকুর। পুকুর পাড়ে নীলাভ দাঁতরাঙার অগুনতি গুল্ম। বাসরাস্তা থেকে অলকেশদের বাড়ি অবধি গ্রামের রাস্তার দু’ধারেও থোকা থোকা ফুটে রয়েছে দাঁতরাঙা - অলকেশের শৈশবের লুটকি। এই ফুল যেন এই গ্রামটির শোভা হয়ে থাকত বছরের একটা সময়। স্কুলে আসতে যেতে পেড়ে নিত একের পর এক ফুল।
অলকেশের মনে পড়ছিল ইসলামের কথা। কিন্তু আসেনি ইসলাম। একগাদা বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী এসে জড়ো হয়েছে। কাউকেই চেনার কথা নয় অলকেশের। তাদের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। যেন কোনও উৎসবে শামিল হতে এসেছে। তাদের উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। অলকেশের অন্তর উৎফুল্লিত হয়ে উঠল।
কথায় কথায় জমে উঠেছে আলাপন। অলকেশের হৃদয় আজ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে প্রাপ্তিসুখে। এখানে, এই জন্মভিটেয় এ অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা আজ সার্থক হয়েছে। জীবনে যত পুরস্কার পেয়েছেন আজ যেন এই প্রাপ্তি ছাপিয়ে গেছে সেসব কিছুকে। এর থেকে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না। ঘোরাঘুরি, কথাবার্তার মধ্যেই জয়ন্ত বলল -
– কাকু, দেরি হচ্ছে। এবার সবাই উপরে চলুন।
অমনি যেন মাটিতে ফিরে এলেন অলকেশ। সবাইকে বলা হলো উপরে অনুষ্ঠানের মঞ্চে চলে আসতে। সবাই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বসে পড়লেন মঞ্চের সামনে পেড়ে রাখা চেয়ারে। মঞ্চে টেবিলের উপর যথাসময়ে সুন্দর করে প্রকাশিতব্য বইগুলো সাজিয়ে রেখেছে জিৎ। এক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে আরোও অনেকগুলো ছেলে-মেয়েদের সাথে। সবাই এখন জমায়েত হয়েছে সেই কাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠানটি উপভোগ করবে বলে। অলকেশ ধীরে ধীরে অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক্রফোনটি হাতে নিলেন। সবাই চুপ। অলকেশের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল এই ছেলেটি আজ সাহিত্যিক অলকেশ নয়, কিশোর বেলার সেই অলক শুধু। এক্ষুনি হয়তো মা এসে বলবেন - অলক কোথায় ? খেতে বোস। এখনই হয়তো দেখবে বাবাও বসে রয়েছেন সামনের কোনও এক চেয়ারে। হাসছেন মিটিমিটি।
নাহ্। এই মুহূর্তে আর ভাবতে পারছেন না অলকেশ। জোর করে হলেও বেরিয়ে আসতে হবে এ নস্টালজিয়া থেকে। এখন নিজেকে সামলে নিতে হবে ঝটিতি। বলতে শুরু করলেন অলকেশ -
– আজ আমার জীবনের একটি বিশেষ দিন। এক স্বপ্নপূরণের দিন। বহু বছর আগে এই মাটিতে, এখানেই আমার জন্ম। আমার পরলোকগত পিতামাতার আশীর্বাদধন্য এই ভিটেতেই আমার শৈশব, কৈশোর। আজকের এই বিশেষ দিনে আপনারা যাঁরা আজ এখানে বহু শারীরিক শ্রম ব্যয় করে, আপনাদের বহু মূল্যবান সময় খরচ করে এই অনুষ্ঠানে শামিল হতে উপস্থিত হয়েছেন, আপনাদের সবাইকে আমার অন্তরের উজাড় করা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক শ্রী সুমন্ত ভট্টাচার্যকে এবং নবপ্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমার অত্যন্ত প্রিয় আত্মীয়সম বালক জিৎকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এই মঞ্চে এসে আমার গ্রন্থটি উন্মোচন করতে। এই গ্রন্থে আমি এই জন্মভিটে, এই গ্রামের কথাই লিখেছি আমার অধিকাংশ গল্পের মধ্যে। আশা করি আপনাদের কাছে সমাদৃত হবে আমার এই গ্রন্থটি।
অলকেশ সবাইকে আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন -
– আমার ইচ্ছে ছিল আমার বালক বেলার সহপাঠী বন্ধু ইসলামও উপস্থিত থাকবে এই মঞ্চে। কিন্তু সম্ভবত অসুস্থতার জন্য সে আসতে পারেনি। খুব মিস করছি আজ তাকে। আমার ইচ্ছে এই গ্রামের কোনো এক বালক-বালিকা আমার এই গ্রন্থের ভূমিকা আপনাদের সামনে পড়ে শোনায়। নবপ্রজন্মের মধ্যে আমি ছড়িয়ে দিতে চাই মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের আনন্দ। কে পড়বে ভূমিকা ?
অলকেশ সপাট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন উপস্থিত কচিকাঁচাদের উদ্দেশে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতে চাইছিল না। অলকেশ ভাবলেন সম্ভবত এ এক জড়তাজনিত অনিচ্ছা। তিনি জিৎ-এর দিকে তাকালেন। অপ্রস্তুত জিৎ তাকাল জয়ন্তর দিকে। জয়ন্ত এসে কানে কানে কিছু একটা বলল অলকেশকে। ভ্রু কুঞ্চিত করে অলকেশ তাকালেন অন্য সবার দিকে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। অলকেশ বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। তাঁর সামনে থেকে যেন পৃথিবীটা ক্রমে তলিয়ে যেতে থাকল গভীর এক খাদের দিকে। আজকের এই শ্রম যেন এক পণ্ডশ্রমে পরিণত হতে চলেছে। কীসের সাহিত্য রচনা করছেন অলকেশ ? কার জন্য এই আয়োজন, এই কৃচ্ছসাধন ? কে পড়বে তাঁর সাহিত্য ? মাতৃভাষায় পড়া একটিও ছেলে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া গেল না এই পাড়াগাঁয়েও। সবাই আজ ইংরেজি স্কুলের দিকে ধাবমান। মুখ ফিরিয়েছে মাতৃভাষা শিক্ষার দিক থেকে। ভাবীকালের হাতে কী সমর্পণ করে যাবেন আজকের কৃতী সাহিত্যিক অলকেশ ? হতাশায় নিমজ্জিত হতে হতে যেন ক্রমাৎ ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। এই ভবিতব্য তাঁর কাছে অকল্পনীয় মনে হতে লাগল। এ অবস্থায় তিনি যখন মাইক হাতে নিচ্ছেন কিছু বলার জন্য তখনই দেখা গেল ভিড়ের মধ্য থেকে একটি জামা পরা মেয়ে উশখুশ করতে করতে দু’পা এগিয়ে আবার এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে যেন। অলকেশের দৃষ্টি এড়াল না তা। তিনি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে -
– আমি পড়ব জেঠু।
আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল মেয়েটি। চমকে উঠলেন অলকেশ। হাতে ধরে নিয়ে এলেন মঞ্চে। মেয়েটিকে বললেন -
– প্রথমে তোমার পরিচয় দাও। তার পর পড়বে। মেয়েটি অলকেশের পায়ের ধুলো নিয়ে বলল -
– নমস্কার। আমার নাম জেসমিনা। জেঠুর বন্ধু ইসলাম আমার বড় চাচা। তাঁর শরীর আজ ভালো নেই বলে আমাকে পাঠালেন এখানে। বললেন তোর জেঠুকে বলবি আমি ভালো আছি। আমি তাঁকে ভুলিনি।
আজ আমি আমার বন্ধু অতসীর সঙ্গে এখানে এসেছি। আমরা দু’জনই আমাদের গ্রাম সৈয়জানগরের মানব কল্যাণ বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমি এখন জেঠুর লিখা বই পড়ব।
আবেগে, আবেশে অলকেশ যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিলেন। সমবেত দর্শকাসনে পিন-পড়া নীরবতা। পড়তে শুরু করল জেসমিনা। অলকেশ হারিয়ে যাচ্ছিলেন মহাশূন্যে। এক মুহূর্ত আগেও যেন মনে হচ্ছিল দিগন্ত ছাপিয়ে তাঁর দিকে ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’। আবার এখন ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরে বাঁচার আশার মতো জেসমিনা যেন তাঁর দেহে তার সুকণ্ঠ পঠনে ঢেলে দিচ্ছে অমৃতসুধা। পুরো গ্রামটির মধ্যে যেখানে একটিও ছেলে-মেয়ে নেই যে বাংলা পড়তে পারে, বলতে পারে না - ‘আ-এ আমটি খাব পেড়ে’ সেখানে জেসমিনা যেন কোন দূর দেশ থেকে আসা বিদ্যাবতী দূতী হয়ে পাঠ করে চলেছে তাঁর বহু আশার গ্রন্থখানি। অলকেশ যেন সাগরের অথই জলে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ করে বেঁচে থাকার এক সম্বল খুঁজে পেয়েছেন। এই তো আছে এখনো এই জেসমিনা, অতসীরা - যারা ডুবন্ত তরীর বৈঠা হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যারা ভাবীকালকে আপন গরিমায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নেমে পড়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। এই জেসমিনাদের মতো সৈনিকদের জন্যই হয়তো বেঁচে যাবে আজকের ক্ষয়িষ্ণু ভাষা সাহিত্যের নিভন্ত বহ্নি।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
অপূর্ব! কি। বলবো কবি,চোখের জল আটকানো গেলো না। মন ছুঁয়ে দিলো।
ReplyDeleteএত ভালো কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখানে কমেন্টদাতার নাম আসে না।তাই বুঝতে পারছি না। নামটা লিখে দিন প্লিজ।
ReplyDelete