Skip to main content

প্রেম-বিরহের অনবদ্য গুঞ্জন - ‘ঝরা কথাদের সিম্ফনি এবং নীলাঞ্জন’


প্রথমেই মোদ্দা কথাটি বলে নেয়া যায় অনায়াসে এবং সেটা হল - প্রেম-বিরহ বিষয়ক একটি উচ্চস্তরীয় কাব্যগ্রন্থ বহুদিন পর প্রকাশিত হল আমাদের এই একান্ত আপন সাহিত্যবিশ্বের সম্পদ হিসেবে। শ্রীভূমি থেকে উঠে আসা কবি ছন্দা দাম কবিতা লিখে চলেছেন এক অনায়াসলব্ধ দক্ষতায়, বহুদিন ধরে। কবির শেষতম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা কথাদের সিম্ফনি এবং নীলাঞ্জন’ তাঁর সার্বিক কাব্যচর্চার উৎকৃষ্টতম প্রকাশ বলতে কোনও দ্বিধা থাকার কথা নয়।
গ্রন্থের ৫৯টি কবিতাই এক নির্দিষ্ট সুরে গ্রথিত হলেও কবিতাসমূহকে কবি স্পষ্ট দুটি ভাগে বিন্যস্ত করতে চেয়েছেন। বলা যায় প্রথম ভাগে রয়েছে এক তীব্র না পাওয়ার বেদনা, আপশোশ, অভিমান এবং শেষভাগে রয়েছে এক সমর্পণ, উৎসর্গের ইঙ্গিত। কবিতাগুলোর মধ্যে কিছু ভিনভাষার শব্দের, পঙ্‌ক্তির, শায়েরির প্রয়োগ এক কথায় অনবদ্য। অন্যদিকে আঞ্চলিক কথ্য বাংলায় লেখা হয়েছে দুটি আস্ত কবিতা। বৈচিত্রের প্রতি, অগতানুগতিকতার প্রতি কবির এক ঝুঁকে থাকা, পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিলাষ স্পষ্ট। শব্দের অমোঘ প্রয়োগ কবিতার মান বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। কিছু পঙ্‌ক্তি উল্লেখযোগ্য -
‘...চাও যদি দিতে পারি কৃষ্ণচূড়া মাখা বৃষ্টি ভেজা দিন/ আর একমুঠো পলাশের অভিমান,/ আর নাহলে দেবো তোমায় দখিনা হাওয়ার ঋণ/ একচিমটি এলাচ ফুলের ঘ্রাণ। .../ আর চাও না যদি, এক পৃথিবী ভাঁজ করা রইল/ এনভেলাপের থরে থরে, /ছুঁয়ে দিতে চাইলে দিও ছুঁয়ে, শাওন ঝরবে দেখো/ ভাদরেও অঝোরে।’ (কবিতা - চাও যদি)।
এই কবিতাটি এবং আরোও অনেক কবিতায় ছন্দের এক নান্দনিক প্রয়োগও দ্রষ্টব্য। এভাবেই কবিনামের সার্থকতা ফুটে উঠেছে সর্বত্র। আলাদা করে বিশেষ কবিতা বেছে নেওয়ার জো নেই। সব কবিতাই সমমানের, সমান গরজের। প্রেম, ভালোবাসা, বিরহের আবহে এক একটি অন্তর ছোঁয়া পঙ্‌ক্তি অনিবার্য দোলায় দোলায়িত করবেই পাঠকমন।
৫৯টি কবিতার মধ্যে শেষ দশটি কবিতা সরাসরি ‘নীলাঞ্জন’-এর উদ্দেশে লেখা যদিও সিম্ফনি সিরিজের একটি কবিতায়ও স্বরিত হয়েছে এই নাম। নীলাঞ্জন চরিত্রটি কবির কলমে হয়ে উঠেছে জীবন্ত। পাঠকমনের জিজ্ঞাসা ঘুচাতে কবি লিখেন -
তোমাতেই থেমে থাকে পৃথিবীটা.../ ...ছুঁয়েও ছুঁতে না পারা এক দুরারোগ্য ব্যাধি নীলাঞ্জন।/ ...তুমি কল্লোলিত ঢেউ, অবচেতনের লালিত কেউ.../ তোমার শূন্যতায় পূর্ণতা তুমি, তুমিই একমেব নীলাঞ্জন। (কবিতা - একমেব নীলাঞ্জন)।
এভাবেই এক ঘোরলাগা শব্দগুঞ্জনের সব কবিতা। পেপারব্যাকে প্রকাশিত গ্রন্থে রয়েছে কবির সংক্ষিপ্ত ভূমিকা এবং লেখক, কবি মৃন্ময় রায়ের শুভেচ্ছাবার্তা। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর সর্বকনিষ্ঠ বোন বর্ষা দাম ও একমাত্র কন্যাসন্তান শ্রেয়া রায়কে। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে সুদীপ প্রামাণিক। ছাপা, বর্ণবিন্যাস যথাযথ হলেও রয়ে গেছে বেশ কিছু বানানজনিত ত্রুটি, এমনকি শিরোনামেও। এসব কাটিয়ে এক অনবদ্য উৎকৃষ্ট কবিতার সম্ভার আলোচ্য গ্রন্থটি।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - শব্দগুচ্ছ প্রকাশনা, কলকাতা, মূল্য - ১২০ টাকা; যোগাযোগ - ৭৬৩৬৯৬৬৪১৭

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...